ভবঘুরে ভাবনার বাতাস
প্রবুদ্ধ বাগচী
অপরাধ জগৎ নিয়ে যারা চর্চা করেন তাঁরা তাঁদের নিরীক্ষায় দেখেছেন, প্রতিটি অপরাধীর হয়ে ওঠার পেছনে অন্য কোনও এক বড় মাথা থাকে; অপরাধীদের পরিভাষায় যাদের বলা হয় ‘গডফাদার’। এটা আমরা সকলেই জানি ও বুঝি যে কেউ মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়েই অপরাধী হয় না- অপরাধী হয়ে ওঠার একটা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থাকে। দুনিয়ার সিংহভাগ অপরাধীদের ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষাপট একটা জোরালো ফ্যাক্টর। মোদ্দা কথাটা হল, একটা জগৎ থেকে আরেকটা অন্য জগতে চলে আসার ক্ষেত্রে এই ‘পাকা মাথা’রা একটা সেতুর মতো।
কিন্তু স্বাভাবিক জীবনস্রোত থেকে অন্ধকার জীবনে ঢুকে পড়ার ক্ষেত্রে এই ‘গডফাদার’ কথাটা যেমন বাঁকা অর্থে প্রয়োগ করা হয়, তেমনি কিন্তু এর একটা ইতিবাচক ব্যঞ্জনাও আছে। চার্লস শোভরাজ বা দায়ুদ ইব্রাহিম কিংবা বীরাপ্পান'এর মতো দাগী অপরাধীদের ক্ষেত্রে যেমন কোনও ‘দাদা কাহিনি’ আছে তেমনি ‘দস্যুরাণী’ ফুলন দেবীর জীবনে বন্দুক ছিল তার নিপীড়িত জীবনকাহিনির এক প্রত্যুত্তর। কিন্তু অপরাধের এই কালো বৃত্ত ছেড়ে যদি আমরা চোখ রাখি অন্যদিকে তাহলেও দেখব এই একই চিত্র।
শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা সফল ও উল্লেখ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদেরও বেড়ে ওঠার একটা পর্যায়ে এসে পড়েছিলেন এমন একেকজন যাদের প্রভাব তাঁদের জীবনকে পাল্টে দিয়েছে অন্য খাতে। হিন্দু কলেজে ডিরোজিও ছিলেন এমনই এক শিক্ষক যিনি তাঁর একদল ছাত্রকে নতুন জীবন দর্শনে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন। এইসব ছাত্ররা পরের জীবনে সকলেই কৃতবিদ্য। ঠাকুরবাড়ির দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনে রামমোহন রায় ছিলেন এমনই এক পথপ্রদর্শক- বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও তাঁদের গভীর সখ্য এত দূর ছিল যে নিজের ব্যক্তি জীবনের সংকটের সময়েও দ্বারকানাথ আশ্রয় পেতে চাইতেন রামমোহনের কাছে। তাই প্রবাসে রামমোহনের অকালমৃত্যু তাঁর কাছে ছিল প্রায় পিতৃহারা হওয়ার মতোই তীব্র শোকাবহ। একটা সময় অবধি কেশবচন্দ্র সেন তাঁর গুরু হিসেবে বিবেচনা করতেন দেবেন ঠাকুরকে, পরে অবশ্য তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরে। রামকৃষ্ণদেবকে নিজের পথের দিশারী হিসেবে না-পেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের কাছে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠতে পারতেন কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
নিজের কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ পুরুষ ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী, এটা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, ইউরোপের শিল্পী হ্যাভেলের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁর শিল্পভাবনার ক্ষেত্রে এক বড় প্রভাব ফেলে। আর ‘মাস্টারমশাই’ নন্দলাল বসু একেবারে আক্ষরিক অর্থেই নিজের মাস্টারমশাই হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথকে। সত্যজিৎ রায় আবার নন্দলাল বসুর গুণমুগ্ধ হয়েও আলাদা করে গুরুত্ব দিতেন বিনোদবিহারীকে, যার প্রতি শ্রদ্ধায় তিনি তৈরি করে ফেলেন তাঁর ‘ইনার আই’ তথ্যচিত্র। রবীন্দ্রনাথের সমকালীন কবিরা প্রায় ঘোষিত ভাবেই তাঁদের লেখালিখির আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, যার ব্যতিক্রম কাজী নজরুল ও মোহিতলাল মজুমদার। পরে অবশ্য ‘কল্লোল’ যুগের কবিরা সচেতনভাবে এই প্রভাব কেটে বেরিয়ে আসতে চান।
সংগীত মূলত একটি গুরুমুখি বিদ্যা। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পুরোটাই ঘরানা-নির্ভর। ফলে, শাস্ত্রীয় সংগীতে যাদের সিদ্ধি তাঁদের সঙ্গে যুক্ত আছে কোনও না কোনও গুরুর নাম। কিন্তু বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত যে রবীন্দ্রসংগীত, তার কাঠামো পোক্ত হলেও তার পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত একেক রকমের প্রশিক্ষণধারা। তাই একদল গায়কের কাছে এক সময় দিনু ঠাকুর ছিলেন তাঁদের গুরু, পরে সেই জায়গা নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। শৈলজারঞ্জনের ধারায় প্রশিক্ষিত হয়েও আবার পরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুচিত্রা মিত্র বা সুবিনয় রায়, মায়া সেন'রা একেক রকম শিষ্যগোষ্ঠী তৈরি করে নেন। আলাদা পথে সেই কাজ করতে থাকেন দেবব্রত বিশ্বাসও। এঁদের অনুগামী সকলের কাছেই তাঁদের শিক্ষাগুরুর পথই অনুসরণযোগ্য পথ- ব্যাপারটার মধ্যে একটা ধার্মিক ঝোঁক থাকলেও এটাই হয়ে এসেছে বা এখনও চলছে।
বাঙালির রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই গুরুবাদ যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। বাংলায় গুপ্ত সমিতির উন্মেষ কালে গ্যারিবল্ডি, ম্যাতসিনি এঁদের বিপ্লবী ভাবধারা দূর থেকে উদ্দীপ্ত করলেও একটা সময় একে সুগঠিত চেহারা দিতে বাংলায় এলেন অরবিন্দ ঘোষ। তিনি তখন বিপ্লবী রাজনীতির পথপ্রদর্শক। তাঁর আদেশে যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় গেলেন বরদায় অস্ত্রশিক্ষা নিতে, বাকিরা সলতে পাকানোর কাজ করতে ছড়িয়ে পড়লেন নানা জায়গায়। মুরারিপুকুর বোমার মামলায় সেই আন্দোলন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও এবং পরে অরবিন্দ ঘোষ অন্য জগতে চলে গেলেও তিনি যে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তার আঁচ কিন্তু নেভেনি। রাসবিহারী বসু তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন চন্দননগরে তাঁর এক গুরুর কথা, যিনি তাঁকে বিপ্লবী আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট করেন। কল্পনা দত্তের স্মৃতিচারণে দেখি, মাস্টারদা সূর্য সেন কীভাবে উদ্বোধিত করছেন তাঁর তরুণী ছাত্রদের, যার মধ্যে আছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। অভাবী পরিবারের এই তরুণী মাস্টারদার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের মঞ্চে। অনুশীলন সমিতির ইতিহাসেও পাই এমন অনেকের নাম যারা এক সময়ে তরুণদের মধ্যে সঞ্চারিত করতেন দেশপ্রেমের উন্মাদনা ও আবেগ। স্বদেশি যুগে এঁদের একটা সময় বলা হত ‘ছেলেধরা’। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’তে দেখি, সন্দীপের আকর্ষণে মুগ্ধ ছিল তাঁর তরুণ শিষ্য অমূল্য। সুভাষচন্দ্র বসু অকুন্ঠে স্বীকার করে গেছেন, গান্ধীজী নন, তাঁর রাজনৈতিক গুরু আসলে চিত্তরঞ্জন দাশ।
অবশ্য ‘ছেলেধরা’র এই অভিধা পরে জুটেছে আরও অনেকেরই কপালে যার ব্যঞ্জনা সবটাই রাজনৈতিক বিচারে ইতিবাচক। বরিশালের অশ্বিনী দত্ত বা ঢাকার পুলিনবিহারী দাস এমনই কিছু প্রোজ্জ্বল চরিত্র। কংগ্রেসি রাজনীতির সেকাল-একালেও পাওয়া যাবে এমন সব নাম যারা দলের সাংগঠনিক দিক ম্যানেজ করতেন। বাংলার রাজনীতিতে অতুল্য ঘোষ ও পরের পর্বে প্রিয় দাসমুন্সির নাম তো এই প্রসঙ্গে না করলেই নয়। সাম্যবাদী রাজনীতির গোড়ার যুগে বিবেকানন্দ'র অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এমনই এক চরিত্র যার সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল নজিরবিহীন, অথচ তিনি কখনও সরাসরি দেশের কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত হননি। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির ঊষাকাল থেকেই তা সংগঠন-নির্ভর আর সেই কাঠামোকে সজীব রাখতে গেলে এইরকম ‘ছেলেধরা’ বা ‘গডফাদার’দের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না।
খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন'এও লেনিন বা পরে স্তালিনকে এরকম এক কিংবদন্তী হিসেবে দেখা হয়েছে অনেক দিন। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ হলেও দেশে দেশে লেনিন বা স্তালিনের শৌর্য নিয়ে গান চলচ্চিত্র নাটক রচিত হয়েছে প্রচুর। এ দেশের নকশালপন্থীরা তো এক সময় চিনের চেয়ারম্যান মাও'কে তাঁদের চেয়ারম্যান বলেই ঘোষণা করেছিলেন, মাওই ছিলেন তাঁদের ‘পথপ্রদর্শক’। চারু মজুমদারকে তাঁরা অনেকেই এখনও ঈশ্বরের মতো ভক্তি করেন। মহাদেব মুখার্জি নামে এক নকশাল নেতা তাঁর দলের পোস্টারে বিশেষণ হিসেবে লিখতেন ‘চারু মজুমদারের হাতে গড়া’- এই ঘোষণার সঙ্গে বালক ব্রহ্মচারীর ‘সন্তান দল’ শিষ্যদের কি খুব মূলগত প্রভেদ পাওয়া যাবে ?
দল বা গোষ্ঠী ছেড়ে দিলেও একেবারে আমাদের ব্যক্তিগত ন-আনা ছয়-আনা জীবনেও এমন কিছু মানুষকে আমরা খুঁজে পাই যাদের সংস্পর্শ আমাদের চেতনা ও ভাবনাচিন্তাকে কিছুটা পরিশুদ্ধতর করে অথবা ঘটিয়ে দেয় এক বাঁক বদল। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল যিনি আমায় শঙ্খ ঘোষ, সুধীর চক্রবর্তী ও অশোক মিত্রের লেখার সঙ্গে পরিচিত করান। অনেকেই মনে করতে পারবেন এমন অনেকের কথা, যারা হয়তো তাঁর পাড়াতুতো দাদা বা দিদি অথবা শিক্ষক-শিক্ষিকা- এঁরা কারও কারও জীবনে কিছু কিছু আলো জ্বেলে দিয়ে যান। এঁদের যে নামেই ডাকি না কেন, এই মানুষগুলোর একটা ইতিবাচক ভূমিকা কোথাও বোধহয় আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
অর্থনীতির কাঠামো সমাজে তার প্রতিবিম্ব ফেলে যায় নিশ্চয়ই। ইদানীং বেশ কয়েক দশক আমাদের সামাজিক সংগঠন অনেক শিথিল, আমাদের সামাজিক দূরত্ব প্রায় এক ব্যাধির মতোই বিস্তৃত। অধুনা অতিমারি সেই সামাজিক দূরত্ব যাপনকে শারীরিক দূরত্বের সঙ্গে কৌশলে প্রতিস্থাপন করে তাকেই আমাদের বেঁচে থাকার বাধ্যতা বলে দাগিয়ে দিয়েছে। তাই এইসব ব্যক্তি মানুষগুলি আজ কে কোথায় ছিটকে গিয়েছেন তার হদিশ পাওয়া সহজ নয়। বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, শুধু তাই পবিত্র যা ব্যক্তিগত। সাহিত্য শিল্পের আওতায় যাই হোক, সামাজিক ক্ষেত্রে এতটা বিপজ্জনক উচ্চারণে অবশ্যই আমাদের আস্থা নেই। কিন্তু ব্যক্তির জীবনে ব্যক্তির ভূমিকা- সে কি একেবারেই পরিত্যাজ্য ? ব্যক্তি কি ইতিহাসেরও উপাদান নয়? ব্যক্তিকে কি আমরা এত দূর পর্যন্ত বসিয়ে রাখতে পারি আমাদের বিচারবোধের চৌকাঠের বাইরে? আপাতত এই ভবঘুরে ভাবনার এলোমেলো বাতাস পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে-বাইরে।
রাজনীতির কচ্কচি বাদ দিয়ে একদম ভিন্ন স্বাদের একটি মিষ্টি লেখা । 💟🌹👌🏼
ReplyDelete📌 হ্যাঁ প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে বেশ কিছু ব্যক্তির যথেষ্ট ভূমিকা থাকে । অনেকে তা বুঝতে পারে, অনেকে পারে না, আবার অনেকে বুঝেও স্বীকার করতে চায়না । এই যা পার্থক্য । 👍🏻🕴️
পরিস্কার বক্তব্য, ভালো লাগলো।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। তথ্য সমৃদ্ধ অথচ সাবলীল। সত্যিই মুগ্ধ হলাম।
ReplyDelete