Thursday 23 September 2021

সবাই এত চুপ কেন?

গুজরাত ও নভি মুম্বইয়ের বন্দরগুলি কি 

মাদক পাচারের আখড়া হয়ে উঠেছে?

শোভনলাল চক্রবর্তী

সম্প্রতি গুজরাতের মুন্দ্রা বন্দরে ডাইরেক্টরেট অফ রেভেনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই)'এর আমেদাবাদ সার্কল আটক করল তিন হাজার কেজি হেরোইন; আন্তর্জাতিক বাজারে যার অর্থমূল্য একুশ হাজার কোটি টাকা। প্রথমেই বলা দরকার যে, হেরোইন অনেক ছোট ওজনের একক মিলিগ্রাম বা গ্রামে বিক্রি হয়। সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যার তদন্তে নেমে নায়িকা রিয়া চক্রবর্তীর কাছে নাকি ১০ গ্রাম মারিজুয়ানা পাওয়া গিয়েছিল। পরে দীপিকা পাড়ুকোনের কাছেও পাওয়া কিছু মাদক নিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলতে থাকা ব্রেকিং নিউজ আমাদের অনেকের স্মৃতিতেই আজও উজ্জ্বল। 

সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! আজ যখন ডিআরআই জানাচ্ছে যে মুন্দ্রা বন্দরে আটক হেরোইন পৃথিবীর সব চেয়ে বড় হেরোইন আটক অভিযানের অন্যতম, তখনও কোনও হেলদোল নেই মিডিয়ার। কেন এই নিরুৎসাহ? আমরা আসব সেই প্রশ্নের উত্তরে। তার আগে একটু আন্দাজ করে নেওয়া যাক একুশ হাজার কোটি টাকা ঠিক কত টাকা? 

দুটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। প্রথমত, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টের মোট ব্যয় কুড়ি হাজার কোটি টাকা; আর দ্বিতীয়ত, গোটা ভারতবর্ষে কোভিড টিকাকরণের মোট খরচ কুড়ি হাজার কোটি টাকা। ভাবুন, যে টাকায় পুরো দেশের মানুষকে টিকা দেওয়া হয়ে যেতে পারে, সেই বিপুল অর্থের হেরোইন আমদানি হচ্ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়ারা শহরের আশি ট্রেডিং কোম্পানির নামে। কোম্পানির খাতা অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে তারা অভ্র দানা আমদানি করছিল এবং জাহাজটি মুন্দ্রা বন্দরে এসেছিল ইরানের আব্বাস বন্দর থেকে। ডিআরআই সন্দেহ করে যে আফগানিস্তান থেকে যেহেতু আমদানি হচ্ছে, তাই এর মধ্যে অন্য কিছু থাকতে পারে। কারণ, আফগানিস্তানের মূল রফতানি যোগ্য উপাদান এখন মাদক ও হেরোইন। ডিআরআই দল গান্ধীনগরে অবস্থিত একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরির বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওই বন্দরে হানা দেয় এবং আমদানি হওয়া বাক্সগুলি খুলে পরীক্ষা করে। বাক্সের পাউডার দ্রব্যের মধ্যে হেরোইনের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে এই বিপুল পরিমাণ হেরোইন আটকের খবর তারা প্রচার করে। তারা বিস্তারিত ভাবে জানায় যে মোট দুটি বাক্সের প্রথমটি থেকে আটক হয় প্রায় দু' হাজার কেজি হেরোইন এবং দ্বিতীয়টি থেকে এক হাজার কেজি। এর পাশাপাশি দিল্লি, চেন্নাই, আমেদাবাদ, গান্ধীধাম ও মান্ধাভি শহরেও তল্লাশি শুরু হয়। এখনও পর্যন্ত দু'জনকে এই হেরোইন কাণ্ডে আটক করা হয়েছে এবং দিল্লির দু'জন আফগানবাসীর উপর নজরদারি চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। 

হেরোইন আটক অবশ্য এই প্রথম নয়। গত জুলাই মাসে নভি মুম্বইয়ের নব সেবা বন্দরে, ওই সেই আফগানিস্তান থেকে ইরানের আব্বাস বন্দর হয়ে আসা তিনশো কেজি হেরোইন আটক হয়েছিল। সেবারও পাউডার গুঁড়োর মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল হেরোইন। ২০২০ সালের অগস্ট মাসে এই মুন্দ্রা বন্দরেই আটক হয়েছিল ১৯০ কেজি হেরোইন, যা বাঁশের গায়ে পাইপের রং করে সেই বাঁশের ভিতর লুকনো ছিল। সেবার অবশ্য পাকিস্তান থেকে ইরানের চাবাহার বন্দর হয়ে এসেছিল ওই হেরোইন। সেই সময়ে দু'জন কাস্টমস এজেন্ট সহ পাঁচজন ড্রাগ ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। তারপর যা হয়, প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে এক সময় ছাড়া পেয়ে যান তাঁরা। 

মুন্দ্রা বন্দরে ৩০০০ কেজি হেরোইন যেদিন আটক হয়, তার ঠিক দু' দিন পরে ভারতীয় জল সীমান্ত রক্ষীরা সাতজন ইরানি মৎসজীবীকে আটক করেন। তাঁদের  উপর তল্লাশি চালিয়ে তিরিশ কেজি হেরোইন পাওয়া যায়। মৎস্যজীবীরা জেরার মুখে জানান যে এই হেরোইন গুজরাতে তাঁদের লোকেদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। এবং গুজরাত হয়ে ওই হেরোইন চলে যেত পঞ্জাব মারফত দিল্লিতে। 


এতক্ষণ এই হেরোইন পাচার আর আটকের কাহিনিতে পাঠকেরা আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করলেন যে এখানে বারবার করে ফিরে আসছে গুজরাত আর নভি মুম্বইয়ের বন্দরগুলির নাম, তার সঙ্গে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের নাম। পাকিস্তান আফগানিস্তান আজ ভাই-ভাই। আফগানিস্তানের তালিবানদের অর্থের মূল উৎস হেরোইনের ব্যবসা। অনেকে বলছেন, সেই কোটি কোটি মার্কিন ডলারের হেরোইন ব্যবসার ভাগ না পেয়েই নাকি আমেরিকা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। আমাদের দেশের ড্রাগ ব্যবসার কেন্দ্র ছিল বরাবরই মুম্বই, তবে ইদানীং ব্যাটন বদল হয়েছে। এখন গুজরাত হয়ে পঞ্জাবে ঢোকে ড্রাগ। ড্রাগের স্বর্গ রাজ্য এখন পঞ্জাব। সারা দেশ জুড়ে ড্রাগ ব্যবসার যে জাল, তার কেন্দ্র অবশ্যই দিল্লি। আগে ড্রাগ আসত প্লেনে করে বিমানবন্দর হয়ে। সেখানে নিরাপত্তার কড়াকড়িতে ড্রাগ এখন আসছে জলপথে- আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে ইরান হয়ে পশ্চিম ভারতের বন্দরে। এই বন্দরগুলির মালিকানা এখন আর সরকারি হাতে নেই। সরকার এগুলিকে তুলে দিয়েছে বেসরকারি পুঁজিপতিদের হাতে। গুজরাত ও নভি মুম্বইয়ের যে কটি বন্দরের নাম এই হেরোইন চক্রে উঠে আসছে তার সবগুলির মালিকানা এখন আদানিদের হাতে। 

এখানে দুটি সম্ভাবনা আছে। এক, আদানিরা সবটা জানেন। জেনে এই মাদক পাচারে তাঁরা তাঁদের বন্দর দিয়ে বেনামে একটা সেফ প্যাসেজ দিচ্ছেন, অবশ্যই মোটা অর্থের বিনিময়ে। আর দুই, তাঁরা কিছুই জানেন না। যদি দ্বিতীয়টা হয় তবে কি ডিআরআই বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ম্যারাথন জেরায় বসবে? এক' দু টাকা নয়, একুশ হাজার কোটি টাকার মাদক আটক হয়েছে। গুজরাত ও কেন্দ্রের সরকারের সঙ্গে আদানিরা কীভাবে যুক্ত তা আমরা সবাই জানি। তবে কি এবার নির্বাচন কমিশন, সিবিআই-এর মতো ডিআরআই'কেও খাঁচার তোতা করে রেখে দেওয়া হবে? ডানা ছেঁটে দেওয়া হবে? অন্য দেশে এত বিশাল পরিমাণ মাদক আটক হলে, যাঁরা ওই মাদক আটক করলেন তাঁরা বিশেষ পুরস্কার পেতেন। এখানে ঠিক তার উল্টো, চারিদিকে শ্মশানের নীরবতা। কোন মিডিয়া হাউসের ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে আদানিদের মাদক পাচারে নাম জড়াবে? যাদের টাকায় মাইনে হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ? তাও আবার একুশ হাজার কোটি টাকার? ছিঃ ছিঃ, কানে শোনাও পাপ! 

ইতিমধ্যে হাওয়ায় খবর ভাসছে যে বুঁদির কেল্লার মতো দাঁড়িয়ে থাকা এনডিটিভি'কে কিনতে চলেছেন ওই আদানিরা। ফলে, একুশ হাজার কোটি টাকার মামলা এখন তামাদি। কথায় আছে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তবে প্রিন্ট মিডিয়া খবর করেছে, ছোট করে। শুনেছি, তাদেরও বাধ্যবাধকতা আছে। পুঁজিপতিরা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার তাগিদে মিডিয়াকে আগে হাত করেন, তারপর সেখানে শুধুই সরকার বন্দনা। আর সরকার বিনিময়ে দিয়ে থাকে অবাধ ছাড়। যেমন ধরুন, পুরো পশ্চিম ভারতের গুজরাত ও সংলগ্ন বন্দরগুলো জুড়ে যদি আজ মাদক পাচারের একটা নিরাপদ পথ গড়ে ওঠে, তবে সেখানে বিশ্বের বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা আসবেন। টাকার কোনও হিসেব-নিকেশ সেখানে থাকার কথা কী? ধরুন, এই যে ২১ হাজার কোটি টাকার মাদক আটকে গেল, এটা যদি বন্দর থেকে বেরিয়ে যেত তাহলে আদানিরা তার লভ্যাংশ পেতেন না, এ কথা শুনলে তো ঘোড়াও হাসবে! ওই টাকার ২ শতাংশ খরচে কেন্দ্রের সরকারকে চিরস্থায়ী করা কোনও ব্যাপার নাকি? ভারতে এখন বিরোধী দল, নির্বাচন, গণতন্ত্র সব কেমন যেন পরাবাস্তব হয়ে উঠেছে। একটি দল ও গুটিকয়েক পুঁজিপতি- এরই নাম এখন ভারতবর্ষ। যে কয়টি ব্যবসায় লাভের কোনও উর্ধ্বসীমা হয় না, তার একটি মাদক ব্যবসা। 

দেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের এবং পেয়ারের এক শিল্পপতির অধীনে থাকা বন্দর দিয়ে হেরোইন পাচার হচ্ছে এটা এখন আলোর মতো স্পষ্ট। এত বিপুল পরিমাণ হেরোইন আটকা পড়ে গেল কী করে তা নিয়ে বরং তদন্ত হোক! ডিআরআই সংস্থাটি দেখা যাচ্ছে রীতিমতো 'দেশদ্রোহী'- কোনও তালজ্ঞান নেই, মাদক আটকে দিলেই হল! এই সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠলে হয়তো আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাঘ্রচর্মাবৃত শেয়ালরা একসঙ্গে হুক্কা-হুয়া করে ডেকে উঠতে পারে।


1 comment:

  1. বিরোধী দলগুলোও মিডিয়াকে হাত করে যখন পারে। মিডিয়াকে ব্যবহার করে তিলকে তাল করা হয়। বিরোধী ও শাসক দল Hollywood সিনেমায় যেমন দেখা যায় good cop bad cop নীতি নিয়ে চলছে। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ greater evil কে ঠেকাতে lesser evil choice করছেন বাধ্য হয়ে। Neo liberal economic policy নিয়ে কোন কথা ওঠার অবকাশই নেই, সেখানে শাসক বিরোধী সব এক। ড্রাগ যারা কিনছে তারা পয়সা পাচ্ছে কোথা থেকে সেই নিয়ে আগে তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ খেটে রোজগার করা লোক ড্রাগ খেয়ে টাকা ওড়াচ্ছে এরকম সম্ভাবনা কম।

    ReplyDelete