Saturday 11 September 2021

স্কুল-কলেজ খুলবে কবে?

তবে উত্তর বানিয়ে প্রশ্ন ক'রো না!

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


সব খুলছে- পার্ক থেকে পুজোর বাজার; প্রাইভেট টিউটরের কোচিং চান তো তাও পাবেন। কোচিং সেন্টারও খুলেছে। সর্বত্র কিছু শর্ত আছে, কিন্তু কোনও শর্তেই খুলছে না স্কুল-কলেজ, চলছে না লোকাল ট্রেন। খুব অশান্তি এসব নিয়ে, খুব হৈচৈ। গরিব মানুষের কথা তবে কি রাজ্য সরকারও ভাববে না, শিক্ষা নিয়েও ভাববে না! এসব নিয়ে কথা বলছেন যাঁরা, তাঁরা কারা? কী তাঁদের পরিচয়? এমন প্রশ্ন করলে মুশকিল। তবু প্রশ্ন উঠেছে, জবাব তো পেতেই হবে।

জবাব খুঁজতে বেরিয়ে দেখা গেল, প্রশ্নকর্তারা প্রধানত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের, তাঁদের অনেকে বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী। এ তথ্য পেতে গবেষণা করতে হয় না, শুকনো রাশিতত্ত্বের সারণি ঘাটতে হয় না। তবে, প্রশ্ন করা তো অপরাধ নয়- এর জন্য বলতে পারি না, অন্তত এই গণতান্ত্রিক দেশে, প্রশ্ন ক'রো না। কিন্তু এ কথা নিশ্চয় বলতে পারি যে, উত্তর বানিয়ে প্রশ্ন ক'রো না।

দুঃখের হলেও এ কথা সত্য, দু' পক্ষই- যারা স্কুল খোলার পক্ষে এবং বিপক্ষে- যেন উত্তর বানিয়ে একে অন্যের দিকে ধেয়ে আসছে। এতে বিরক্ত হতেও পারি না। এই রাজ্যের হালই এমন যেখানে দু' চারজন লোক জুটিয়ে ট্রেন অবরোধ করা যায়। বিচার চাইতে কেবল বিচারালয় নয়, মন্ত্রীর বাসভবনেও মিছিল নিয়ে যাওয়া যায়। আর মন্ত্রীমহোদয়ও রাজ্য মন্ত্রকের কাজকর্ম ফেলে ভিন রাজ্যে রাজনীতি করতে, দল বাড়াতে ছুটতে পারেন। আজ বলে নয়, এমন কাণ্ড আগেও ঘটেছে। 

যারা চান স্কুল-কলেজ খুলুক তাদের কথা তো শুনেছি, শুনছি। যারা বিরুদ্ধ মতে বিশ্বাসী এবার তাদের কথাও না হয় কিছু শুনি।

এ তো ঠিকই যে, অনলাইন পড়াশোনার নামে কার্যত পড়াশোনা হচ্ছে না। কিন্তু, অতিমারি পর্বের আগেও তা হত কী? তাহলে দুনিয়া জুড়ে কেন শুনেছি যে, শিক্ষার মান নেমেছে ও নামছে? এ কথা অবশ্যই সত্য, বিশ্ব জুড়ে শিক্ষার মান নেমেছে ও নামছে। এর জন্য তো অনলাইন বা অফলাইন ব্যবস্থা দায়ী নয়, শিক্ষাব্যবস্থা বা তার আয়োজনই এর জন্য দায়ী। এখানে তবে সে প্রশ্নটাও করতে পারি- বিশ্বের কোনও রাষ্ট্র কি চায় যে ভালো মানের শিক্ষা পেয়ে দেশের শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক হয়ে উঠুক!

অনেকে মান নেমে যাবার জন্য দায়ী করেছে শিক্ষা অধিকার আইনকে, যেখানে বয়স-ভিত্তিক শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতে বলা হয়েছে, বলা হয়েছে 'no detention'-এর কথা (পাশ-ফেল তুলে দেবার কথা বলা হয়নি)। শিক্ষকদের বলা হল, ষান্মাসিক/বার্ষিক পরীক্ষার বদলে পরীক্ষার্থীদের নিয়মিত ও বুদ্ধিবৃত্তির পরীক্ষা নিতে। দুটোর বদলে অন্তত তিনটে পরীক্ষার কথা বলা হলেও আমরা সে সব শুনলাম না, সব শিক্ষককে সে কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারলাম না। 

স্কুল খোলা না থাকলেও বাচ্চাগুলো খাবার পাক (যদিও সেটাই সব নয়), সরকার চায়। তবু কোনও কোনও রাজ্যে বাচ্চারা খাবার পায় না। কেন পায় না? পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব শিশু পাচ্ছে তো নিয়মিত? যেখানে পাচ্ছে না সেখানে খুঁজেছি নাকি দায়ী কে? তার জন্য শাস্তি কী? ভেবেছি কোন পথে মেরামত করা সম্ভব ত্রুটিগুলি? সে সব না ভেবে আমরা স্কুল-কলেজ খোলার দাবি জানিয়ে চলেছি। এখন তো দাবি করতে পারতাম- হে রাষ্ট্র, শিক্ষাখাতে তুমি ব্যয় বাড়াও যুদ্ধচিন্তা ছেড়ে। শিশুদের (০-১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু) জন্য আরও পুষ্টির আয়োজন ক'রো। আরও চিকিৎসার ব্যবস্থা ক'রো। উচ্চশিক্ষা তো বহু আগেই কার্যত 'বিনি পয়সার ভোজ' বলে চিহ্নিত এবং যার কোথাও যাবার নেই সেই যেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় নাম তোলে আর নানাভাবে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত করে। এইসব অভিযোগ  যারা আনতেন তারাই এখন বলছেন স্কুল-কলেজ খোল! 

শিক্ষকরা নাকি নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান না, তাঁরা নাকি ম্যাটিনি স্কুল চালান- এসব অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে এমন শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রাঙ্গণে টেনে এনে লাভ কী হবে? ঘুরে ঘুরে এবং ঘরে ঘরে খোঁজ নিলেই জানা যাবে প্রাইভেট টিউশনি অনেক কমেছে। স্কুল খুললেই এই ব্যবসা হু হু করে বাড়বে, বাড়বে শিক্ষকদের হাত ধরেই। অভিভাবকরা সন্তানদের ভালোর জন্য নিয়োগ করেন স্কুল শিক্ষকদেরই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষকদের একাংশের নীতিবোধের অভাব মাত্রাছাড়া হয়ে পড়েছে। উপায় নেই তাঁদের শাস্তি দেবার, সমাজ মানবে না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই নিরাপদ পানীয় জল, নেই স্বাস্থ্যকর ব্যবহারযোগ্য টয়লেট, না তাদের আছে খেলার মাঠ। এমতাবস্থায় নাই বা খুলল শিক্ষায়তন। অন্তত প্রাণে বাঁচার নিশ্চয়তা পাক শিশুরা। করোনা থেকে বাঁচাতে, আমরা সবাই জানি, দেশের যা হাল তাতে তাদের লুকিয়ে রাখাটাই নিরাপদ। 

আমরা এই দাবি তুলতে পারি কিনা ভেবে দেখুন সব পক্ষ: স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণ যদি হয় শিশুদের নিরাপত্তা, তবে থাক বন্ধ, কিন্তু খুললে যেন শিশুরা পায় খাদ্য, স্বাস্থ্যের অধিকার ও আদর্শ পরিবেশ। আরও যা বলার, দীর্ঘকাল বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া খুলে দিলে ভালো হবে? এতদিন যাঁরা অনলাইন পড়ানোতে ব্যস্ত, তাঁরা আচমকা ক্লাসে ঢুকে পারবেন তো পড়াতে? ওদের কথাও ভাবুন। ভাবুন শিশুদের কথাও। হঠাৎ তারা অফলাইনে লেখাপড়া করতে পারবে? নাকি তাদের সবার জন্য (শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ইত্যাদি) প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, প্রয়োজন মানসিক প্রশিক্ষণও।

মানছি, ধ্রুপদী ব্যবস্থার বিকল্প নেই। তাই কর্তারা যেন না ভাবেন যে এভাবে চলবে চিরদিন- শিক্ষক ছাড়া, শিক্ষায়তন ছাড়া। চাইলেই ভালো শিক্ষক পাওয়া যায় না, কিন্তু রাষ্ট্র চাইলেই ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে পারে। রাষ্ট্র সেদিকে নজর দিক। এই দাবি সমর্থিত হোক দেশের ঘরে ঘরে।

ওদিকে, চলছে না লোকাল ট্রেনও। এ বিষয়ে কথা হবে আর একদিন।


1 comment:

  1. অশোকেন্দু বাবুর লেখাটা পড়লাম । খুব ভালো লাগল, কিন্তু এই লেখার ব্যাপারে আমার অনেক কিছু বলার আছে । সময় পেলে দেখি বলার চেষ্টা করব । যাইহোক, লেখাটা অবশ্যই শেয়ার করব । 🌹🤝🏼

    ReplyDelete