Monday, 27 September 2021

ভারত বনধ

'প্রয়োজন হলে আন্দোলন দশ বছর চলবে'

সোমনাথ গুহ


'এই কৃষক আন্দোলন রাজনীতির এক নতুন আখ্যান তৈরি করেছে যেখানে ব্যক্তি নয়, মানুষের দাবিদাওয়াই হচ্ছে গণ-রাজনীতির মূল ভরকেন্দ্র'- গাজিপুর সীমান্তে এক কৃষক নেতা ইউটিউবার অজিত অঞ্জুমকে আজ ভারত বনধের দিন বললেন। তিনটি কৃষি আইন সংসদে অনুমোদিত হওয়ার এক বছর পূর্তিতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এই বনধ ডেকেছিল। ভারত কিষাণ ইউনিয়নের এক নেতা বললেন, উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপি যদি জেতেও, তাতে আন্দোলন কমজোরি হয়ে যাবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আখের ন্যূনতম মূল্য পঁচিশ টাকা কুইন্টাল প্রতি বাড়িয়ে (৩২৫ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা) কেউ যদি ভাবে কৃষকদের সংহতিতে চিড় ধরাবে, তাঁদের আনুগত্য কিনে নেবে, তাহলে তারা ভুল করছে। বাস্তবে পাঁচ বছরে মাত্র পঁচিশ টাকা বৃদ্ধি ভিক্ষা দেওয়ার সামিল। এটা কৃষকদের প্রতি কোনও সহমর্মিতা নয়, বরং তাঁদেরকে অপমান করা। আদতে আখের ন্যূনতম মূল্য কুইন্টাল প্রতি অন্তত ৫০০ টাকা হওয়া উচিত।

একটি গোদি মিডিয়ার ইংরেজি চ্যানেল দুপুর আড়াইটায় বলছে, বনধের কারণে ভারত স্তব্ধ (Bandh Collapses Bharat)। এরপর তারা জবরদস্তি রাস্তা অবরোধের অভিযোগ জানাচ্ছে, সপ্তাহের প্রথম দিনে মানুষের হয়রানির কথা বলছে, বলছে বেঙ্গালুরু এবং নয়ডায় কৃষকরা নাকি হিংসা ছড়িয়েছে; কিন্তু অস্বীকার করতে পারছে না যে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বনধ সফল। দিল্লি থেকে নয়ডা, গুরুগ্রাম, অমৃতসর, দেহরাদুন, পঞ্জাব-হরিয়ানা সড়ক সব স্তব্ধ। দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশের মধ্যে যান চলাচল সম্পুর্ণ বন্ধ। দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বনধ পুরোপুরি সফল। রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্রের সরকারি অফিস বাদে প্রায় সব কিছু বন্ধ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ, যেখানে বিজেপি'র মিত্র ওয়াইএসআর রেড্ডির সরকার, তাঁরা বনধকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছে। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে এবং কেরালায় বাম সরকার বনধকে সমর্থন জানানোয় ঐ তিনটি রাজ্যেই জনজীবন স্তব্ধ। 

গুরুগাও-দিল্লি সীমান্তে স্তব্ধ জনজীবন
 

সমস্ত বিরোধী দল বনধকে সমর্থন তো করেইছে, বহু জায়গায় তারা রাস্তায় বিক্ষোভ সমাবেশে সামিল হয়েছে। বিহারে তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে মহাগঠবন্ধন বনধ সফল করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। মধ্যপ্রদেশে দিগ্বিজয় সিং'এর নেতৃত্বে কংগ্রেস বহু জায়গায় ধর্ণায় বসেছে। রাকেশ টিকায়েত রবিবারই বলে দিয়েছিলেন যে এই তিনটি কালা আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রয়োজন হলে দশ বছর চলবে, কিন্তু কৃষকরা পিছু হঠবে না। 'সরকার যদি কৃষকদের আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হত তাহলে তারা কোনওদিন এই সব আইন প্রণয়ন করত না। আমরা এই মাটির সন্তান এবং প্রয়োজন হলে সরকারের মুখ ঘষে দিয়ে এই আইনগুলি বাতিল করতে তাদের বাধ্য করতে পারি।'

পশ্চিমবাংলায় ছবিটা আলাদা। এখানে তৃণমুল সরকার বনধকে সমর্থন করছে না, যদিও তারা বলছে যে কৃষকদের দাবি তারা সমর্থন করে। এ এক অদ্ভুত দ্বিচারিতা। স্মরণ করা যেতে পারে যে কৃষক আন্দোলনের নেতারা বাংলায় নির্বাচনের আগে বারবার রাজ্যে এসেছেন এবং বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য মানুষের কাছে আবেদন করেছেন। তবুও এখানে জনজীবন সচল রাখতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গে বনধ দক্ষিণের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি সফল। কোচবিহারে বাস চলেনি, জলপাইগুড়িতে জনজীবন ব্যাহত। রায়গঞ্জে দোকানপাট খোলেনি। শিলিগুড়িতে দিনভর মিছিল সমাবেশ হয়েছে। ব্যারাকপুরের শিল্পাঞ্চলে বনধ মিশ্র সাড়া ফেলেছে। নৈহাটি এক্সপ্রেসওয়েতে অবরোধ হয়েছে, শ্যামনগর স্টেশনে ট্রেন অবরোধ করা হয়েছে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে, বিটি রোড ইত্যাদি জায়গায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। একটি জায়গায় বনধের সমর্থনকারীদের আবেদনে সাড়া দিয়ে কর্মচারীরা অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। মালদহ শহরে কংগ্রেস পিকেটিং করেছে, ধুবুলিয়া ব্লক ও নদীয়ার নাকাশিপাড়ায় সিপিআই(এমএল)-লিবারেশন অবরোধ করেছে। দুর্গাপুর রেল স্টেশনে সিপিএম রেল লাইন অবরোধ করেছে, মেদিনীপুর শহরে বাস আটকে দিয়েছে। বারাসতে বনধ আংশিক সফল হয়েছে। 

কলকাতায় মৌলালি মোড় থেকে বিভিন্ন বাম সংগঠনের যৌথ মিছিল হয়েছে। যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ড ও যাদবপুর রেল স্টেশনে বাম কর্মীরা দীর্ঘ সময় অবরোধ করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে রাস্তায় ছাত্রছাত্রীরা দিনভর অবরোধ করেছেন। শ্যামবাজার ও গড়িয়াহাট মোড়ে অবরোধ হয়েছে। 

এই তিনটি আইন উদ্ভুত সমস্যাগুলো শুধু যে কৃষকদের নয় ব্যাপক মানুষের, সেটা এই বনধের মধ্যে দিয়ে মানুষ অনেকটা উপলব্ধি করেছেন; না হলে বনধ এত সাড়া ফেলত না। বিপদটা মাথার একদম ওপরে এটা বোধগম্য হওয়া প্রয়োজন। কারণ আজকে ঠিক এই দিনটাতেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘আয়ুষ্মান ভারত ডিজিটাল ভারত মিশন’ ঘোষণা করলেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার প্রতিটি নাগরিকের শরীর স্বাস্থ্যের সুলুকসন্ধান পেয়ে যাবে। আমার হার্টের ব্যামো আছে না ডায়েবেটিস, তা থাকবে সরকারের নখদর্পণে। মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে এত বড় আগ্রাসন ইতিপূর্বে আর কখনও হয়েছে কী? 


2 comments:

  1. কৃষক আন্দোলন এক সফল দীর্ঘ মেয়াদী আন্দোলন।
    কিন্তু বাম নেতারা এই সফলতা থেকে শিক্ষা নিতে অপারগ।
    বামপন্থী বিভেদবাদ এদের গ্রাস করেছে। ছোট বড় সব দলকেই।
    ভারত যে রাজনৈতিক সন্ধক্ষণ দাঁড়িয়ে তাতে সব সাম্যবাদী দলকে এক হতে হবেই।
    বাস্তবে বাংলায় চলছে কংগ্রেসের রাজত্ব। কংগ্রেস থেকেও ভয়ংকর।

    ReplyDelete