বাংলার কৃষকের আয় এত কম কেন?
সোমনাথ গুহ
কেন্দ্রীয় সংস্থা এনএসএসও (ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন)'র সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় ৬৭৬২ টাকা; যেখানে দেশের কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় ১০,২১৮ টাকা। এই সমীক্ষা ২০১৮ ও ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। কৃষক পরিবার বলতে বোঝায়, যাঁরা বছরে অন্তত ৪০০০ টাকা মূল্যের ফসল উৎপাদন করেন এবং যে পরিবারের অন্তত একজন কৃষিকাজে যুক্ত। আরও তাৎপর্যপূর্ণ, এই মাসিক আয়ের মাত্র ২২.৮ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫৪৭ টাকা আসে চাষ থেকে; দিনমজুরি, এনরেগায় কাজ, বেসরকারি চাকরি, লোকের বাড়ি বিবিধ কাজ ইত্যাদি থেকে আসে ৫৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩৭২১ টাকা। অন্যান্য পেশা থেকে আয় আরও প্রায় ১৪ শতাংশ। এর অর্থ, পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ কৃষক আংশিক চাষি। এটা অস্বাভাবিক নয়, যখন আমরা দেখি রাজ্যের ৯৬ শতাংশ কৃষক ছোট ও ক্ষুদ্র।
২০১৩ সালে এনএসএসও'র সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের চাষির গড় মাসিক আয় ছিল ৬৪২৬ টাকা। ছয়টি রাজ্যের গড় মাসিক আয় ছিল ৫০০০ টাকার নীচে- বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবাংলা, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা ও উত্তরপ্রদেশ। বিহারের আয় ছিল নিম্নতম: ৩৫৫৮ টাকা, পশ্চিমবাংলার আয় ঠিক তার ওপরে: ৩৯৮০ টাকা। হরিয়ানার আয় ছিল সবচেয়ে অধিক: ১৪,৪৩৪ টাকা।
নাবার্ড'এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের চাষির গড় আয় বেড়ে হয় ৮৯৩১ টাকা, অর্থাৎ, পাঁচ বছরে বৃদ্ধি মাত্র ২৫০৫ টাকা। যদি মুদ্রাস্ফীতিকে ধরা হয় তাহলে আয়বৃদ্ধি যৎসামান্য, বরং বলা যায় অধোগামী। বিভিন্ন রাজ্য অনুযায়ী পাঁচ বছরে বৃদ্ধির খতিয়ান দেখা যেতে পারে: বিহারের ৩৫৫৮ থেকে বেড়ে হয় ৭১৭৫, পশ্চিমবাংলায় ৩৯৮০ থেকে ৭৭৫৬, উত্তরপ্রদেশে ৪৯২৩ থেকে ৬৬৬৮, অসমে ৬৬৯৫ থেকে ৯৮৭৮, মহারাষ্ট্রে ৭৩৮৬ থেকে ১০,২৮৬, তামিলনাড়ু'তে ৬৯৮০ থেকে ৯৭৭৫ টাকা। সবুজ বিপ্লবের গড় পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় বৃদ্ধি যথাক্রমে ১৮,০৫৯ থেকে ২৩,১৩৩ টাকা এবং ১৪,৪৪৩ থেকে ১৮,৪৯৬ টাকা।
এই দুটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬'র পরে পশ্চিমবাংলার চাষির আয় পরবর্তী দু' বছরে কমে গেছে ৭৭৫৬ টাকা থেকে ৬৭৬২ টাকায়। ২০১৯'এর বাজেটের পর 'পিএম কিষাণ' এবং 'কৃষকবন্ধু' প্রকল্পের কারণে কৃষকের আয় তাঁর জমির পরিমাণ অনুযায়ী বর্তমানে কিছু বেড়ে থাকতে পারে।
এই রাজ্যের কৃষকের আয় এত কম কেন? ২০১১'এর সেন্সাস অনুযায়ী, পশ্চিমবাংলার জনঘনত্ব প্রতি স্কোয়ার কিমিতে ১০২৮, শুধুমাত্র বিহারের আরও বেশি- ১১০৬; সারা ভারতে এটা হচ্ছে ৩৮২। পশ্চিমবঙ্গে জমির ওপর প্রবল চাপ, যার ফলে কৃষক প্রতি জমির পরিমাণ অতি অল্প: ০.৭৭ হেক্টর, অর্থাৎ ৫.৭০ বিঘা। পাঞ্জাবে এটা ৩.৬২ হেক্টর, অর্থাৎ ২৬.৮২ বিঘা। বোঝাই যাচ্ছে, আয় এবং জমির পরিমাণ- এই দুটি মূল ক্ষেত্রে সারা দেশের চিত্রটা প্রবল ভাবে অসমান। এর ফলে কৃষি সমস্যার সর্বভারতীয় যে সমাধান সেটা বাংলার ক্ষেত্রে কার্যকরী নাও হতে পারে।
পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের জোত বড় এবং তাঁরা দেশের বাকি চাষিদের থেকে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন। সবুজ বিপ্লবের অঞ্চল হিসাবে এই কারণে ঐ দুটি রাজ্যকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কৃষকদের এই নতুন চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারি আধিকারিকরা ষাটের দশকে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার করেছিলেন। এই অভিনব চাষে দীক্ষিত করার জন্য পাঞ্জাবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, পোকামাকড় কীটপতঙ্গের ওষুধের লাগামছাড়া ব্যবহারের ফলে সাবেক চাষ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন ব্যাংক কম সুদে, সহজ কিস্তিতে ট্র্যাক্টর কেনার ঋণ দেয়। পুরো পাঞ্জাব ট্র্যাক্টরে ভরে যায়। এই নতুন পদ্ধতিতে চাষ শুরু করার পর এত আনাজ উৎপন্ন হত যে সরকার পুরো কিনে উঠতে পারত না। প্রায় তিন দশক পর, তথাকথিত আধুনিক উপকরণ ব্যবহারের কারণে কৃষিতে যে অভাবনীয় প্রাচুর্য এসেছিল, ঠিক সেই সব কারণের জন্যই সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হল- যার বহিঃপ্রকাশ আজ আমরা দিল্লির উপকন্ঠে সমাবেশিত ঐতিহাসিক আন্দোলনের মধ্যে প্রত্যক্ষ করছি।
খাতায় কলমে বাংলায় সবুজ বিপ্লব হয়নি, কিন্তু ঐ বিপ্লবের যাবতীয় কুফল আজ বাংলার কৃষককে ভোগ করতে হচ্ছে। যে বিষাক্ত উপকরণগুলো পাঞ্জাব হরিয়ানায় ব্যবহৃত হয়েছিল, তা এই রাজ্যেও ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হয়েছে। উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, ইন্সেক্টিসাইড, পেস্টিসাইডের দাপটে সাবেক চাষ হারিয়ে যায়। পাঞ্জাবের কৃষক সম্পন্ন হওয়ার কারণে এই নতুন চাষের অত্যধিক খরচ তাঁরা বহন করতে পেরেছিলেন। অল্প জমিতে এত খরচের চাষ করতে গিয়ে বাংলার চাষি মুখ থুবড়ে পড়েন। সবুজ বিপ্লবের ফলে ঐ দুই রাজ্যে প্রায় তিন দশক ধরে কৃষকের উপার্জন উল্লেখজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলায় আয় বৃদ্ধির তো প্রশ্নই নেই, উল্টে ছোট জমিতে সবুজ বিপ্লব ধরনের চাষ করতে গিয়ে এখানে সংকট পাঞ্জাব হরিয়ানার চেয়েও আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বাংলায় জনপ্রতি জমি ৫.৭০ বিঘা হলেও এক বিপুল সংখ্যক কৃষকের জমি তিন বিঘার আশেপাশে। আগে একবারই চাষ হত কিন্তু বিঘা প্রতি প্রায় ৩০০-৩৬০ কেজি ধান হত। খরচ তেমন ছিল না, কারণ গরু-ছাগলের গোবর নাদি স্বাভাবিক সার হিসাবে কাজে দিত। প্রতি গ্রামের পরম্পরাগত বীজের ভাণ্ডার ছিল তাই উচ্চফলনশীল, বীজের কোনও প্রয়োজন ছিল না। এখন একটার বদলে দুটো চাষ হয়, কিন্তু বিঘা প্রতি ফলন কম, চাষের খরচ অনেক বেশি, এর ফলে চাষির নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা।
অনেকের অভিযোগ, সরকার অপদার্থ, বাংলায় মান্ডিগুলো অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু ছোট, ক্ষুদ্র চাষি তাঁদের ঐ অল্প উৎপাদন নিয়ে আদৌ মান্ডিতে যেতে কি উৎসাহী? তাঁরা পরিষ্কার বলেন, গ্রামে মান্ডি থাকলেও সেখানে ফসল বেচার অনেক হ্যাপা। লাইন দাও, স্লিপ কাটো, দালাল ও নেতাদের দাদাগিরি, এর পরেও টাকা জমা পড়বে প্রায় এক সপ্তাহ বাদে। মুনিষ তো ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, তাঁকে তো নগদ টাকা দিতে হবে। সুতরাং, কুইন্টাল প্রতি সরকারি রেট হয়তো ১৮৬০ টাকা, কিন্তু ঘরে এসে যিনি নগদ টাকা দেন চাষি তাঁকেই ১৫০০ টাকায় ধান দিয়ে দেন। যৎসামান্য লাভ হয়, লোকসানও হয়। ছোট চাষির তো সামান্য পুঁজি, সেটা তো তিনি পুরোটাই চাষে নিয়োগ করেছেন। ফসল বেচে সঙ্গে সঙ্গে টাকা না পেলে তিনি খাবেন কী? মান্ডিতে চাষির ব্যাংকের খাতায় ফসলের টাকা জমা না দিয়ে নগদ দেওয়াতেও বিরাট বিপদ, প্রবল দুর্নীতির আশঙ্কা।
পাঞ্জাব ও বাংলার কৃষকের সমস্যা অনেকটাই ভিন্ন। শুধু মান্ডি বাড়ালে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিলেই কি বাংলার চাষির সমস্যার সমাধান হবে? এই কারণে ব্যাংকে এক ধরনের রিভল্ভিং কৃষি ঋণ আছে। ধরা যাক, একটা চাষের জন্য তাঁকে ২০,০০০ টাকা ঋণ দেওয়া হল, ফসল বিক্রি করে তিনি ঐ ঋণ শোধ করে দেবেন এবং পুনরায় তাঁকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দ্বিতীয় চাষের জন্য ঋণ দেওয়া হবে। দেখা যায়, কৃষি এত অলাভজনক হয়ে পড়ছে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম ঋণটাই কৃষক শোধ করে উঠতে পারেন না, একটা অংশ পড়ে থাকে। তাতে হয় পরের চাষের ঋণ আটকে যায়, নয়তো অনাদায়ী অংশ জমতে জমতে একটা বৃহৎ অঙ্কে দাঁড়িয়ে যায়। চাষি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
অন্য সমস্যার মধ্যে আছে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলিতে সেচের অপ্রতুলতা। আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়- উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায়, বিশেষ করে সুন্দরবনে। প্রতি বছর সেখানে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়া এখন একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। একটা তুফান থেকে সামলে ওঠবার আগেই পরেরটা এসে পড়ে, এর ফলে সুন্দরবনের জনজীবন পুরো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেই দেখা যায় স্কুলছুট বেড়ে গেছে, নারী পাচার বেড়েছে, বহু মানুষ ভিটে ছেড়ে কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া মানুষের সংখ্যায় পশ্চিমবাংলা চতুর্থ, প্রথম তিনটি হল উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও রাজস্থান। ফলে, যত দিন যাচ্ছে, বাংলার চাষির মোট উপার্জনের মধ্যে কৃষিকাজ থেকে আয়ের পরিমাণ কমছে। ব্যক্তি হিসাবে তিনি ২০ শতাংশ চাষি, বাকিটা অন্য পেশার। এটা অবশ্যম্ভাবী, যত দিন যাবে এই ২০ শতাংশ কমবে- চাষি আর চাষি থাকবেন না।
বাংলার কৃষককে বাঁচাতে গেলে কৃষিভিত্তিক শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও অন্যান্য পেশাকে লাভজনক করে তুলতে হবে। সমস্যা গভীর ও জটিল, জেলা বিশেষে, অঞ্চল বিশেষে ভিন্ন। শুধুমাত্র মান্ডি আর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আওড়ালে এই সমস্যা আমরা ছুঁতেও পারব না।
No comments:
Post a Comment