Wednesday, 1 September 2021

সবুজ মানুষ

জঙ্গলে তিনি হাঁটবেন আমার সঙ্গে...

নয়ন বসু


একেক সময় আমার একেকটা ফেজ চলে। মানে যে লেখকের বই পড়ি, শুধু তাঁরই পড়ে চলি পরপর। ইলেভেন-টুয়েল্‌ভে আমার বুদ্ধদেব গুহ ফেজ চলছিল। 'প্রথম কোয়েলের কাছে'। বইটা এখন যতদূর মনে পড়ছে, আকাশদীপের থেকে নিয়ে এসেছিলাম। পুরনো সংস্করণ, কভারটা হলগলে হয়ে গেছে। তারপর কিনলাম 'একটু উষ্ণতার জন্য'। কভারে খুব সুন্দর একজন মহিলার মুখের ছবি। একদম সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের সিগনেচার ছবি। এই বই কেনাটা মনে আছে। তখন কফি হাউসের দোতলায় চক্রবর্তী অ্যান্ড চক্রবর্তী থেকে বই কিনতাম। মাত্র ১০ শতাংশ ছাড় জেনেও ওখানেই যেতাম। কারণ, চারদিকে বই আর বই, এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগত। বইয়ের মল গোছের ব্যাপার। 'একটু উষ্ণতার জন্য' দেখে এসেছি পঞ্চাশ টাকা দাম, দশ শতাংশ বাদ দিয়ে পঁয়তাল্লিশ হয়। পকেটে কুড়ি-বাইশ মতো হবে। তখন হাতিবাগান থেকে কলেজ স্ট্রিট মোড় আড়াই টাকা বাস ভাড়া। কয়েকদিন হেঁটে যাতায়াত করে পঁয়তাল্লিশে পৌঁছনো গেল। এবং ব‌ইটা কেনার পর আমি ক্লিন বোল্ড হলাম।

তারপর থেকে পরপর পড়ে গেছি। সবিনয় নিবেদন, জগমগি, স্নানঘরে গান, বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে, কোজাগর, চাপরাশ, মাধুকরী ইত্যাদি। মোটামুটি যখন ওঁর 'ধুলোবালি' বেরল, তখন আমার এই ফেজটা কাটে। 'অখণ্ড ঋভু' কিনেছিলাম সেই কুড়ি বছর আগে বইমেলা থেকে। ওটা এখন‌ও পড়া হয়নি। একটা জিনিস অসম্ভব ভালো লাগত- ওঁর সৃষ্ট মহিলা চরিত্রের নাম। কী সুন্দর সুন্দর সব নাম দিতেন! 'তোড়া' নামটা কোন‌ও কারণে মনে আছে। কোনও উপন্যাস মনে নেই আর।

কোজাগর, চাপরাশ আর মাধুকরী'র মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় 'চাপরাশ', তারপর 'কোজাগর' আর একদম শেষে 'মাধুকরী'। তবে সে সময় সবচেয়ে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম 'বাবলি' পড়ে। 'বাবলি'র মতো খাজা উপন্যাস 'কোজাগর'এর লেখক লিখবেন এটা মানা যায় না। আর‌ও অবাক লেগেছিল 'বাবলি'র জনপ্রিয়তা দেখে। এখন‌ও লাগে। 'বাজা তোরা রাজা যায়' তুলনায় কম পঠিত উপন্যাস। কোন‌ও একটা 'আনন্দমেলা' পূজাবার্ষিকীতে বেরিয়েছিল। আমার ধারণা, উনি জীবনে আর কিছু না লিখলেও শুধু এটার জন্যই বাংলা সাহিত্যে ওনার নাম অমর হয়ে থাকতে পারে।

খুব সম্ভবত 'বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে' ব‌ইটাতেই পড়েছিলাম উনি ওঁর নবীন বয়সে একবার সম্পাদকীয় দফতরে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠির বিষয় ছিল- পূর্ণিমা রাতে শহরের আলো নিভিয়ে রাখা হোক। খুব স্বাভাবিকভাবে, বাস্তব সঙ্গত কারণেই সেই চিঠি কোন‌ওদিন ছাপা হয়নি। ব্যাপারটা হল, এইরকম রোম্যান্টিক চিন্তাভাবনা গোঁফ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মধ্যেই আসে। লুনার থেকে লুনাটিক, পাগলামি। নবীন বয়স পাগলামিরই বয়স। কিন্তু জীবনের রোদে এই পাগলামি উবে যায়। তবু কয়লা শত ধুলেও যেমন ময়লা যায় না, পাগলামির গন্ধ বয়স হলেও শরীরে লেগে থাকে। সেই নবীন যুবকের পাগলামিকে আমি শ্রদ্ধা করি, যিনি পাগলামির সম্মান রক্ষার্থে সম্পাদকীয়তে চিঠি লিখতেও পিছপা হন না। এঁরা কবি, সাধক অথবা পাগল হন।

কবিতার কথায় মনে পড়ল, 'লালামিঞার শায়েরি' নামে একটা বই বেরিয়েছিল ওঁর, দে'জ পাবলিশিং থেকে। সেটা আমার স্কুল জীবনের শেষ দুটো বছর, মানে ২০০১-২০০২'এ। সেই সময় দে'জ-এর ক্যাটালগে বইটার দাম ছিল বারো টাকা। সেই বই আমি চোখে দেখিনি, এখন‌ও পাওয়া যায় কিনা জানি না।

বাবলি আর ঋজুদা ছাড়া ওঁর প্রতি পাঠক হিসেবে আমার খুব একটা অভিযোগ নেই। ঋজুদা আমার ভালো লাগে না। হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাপার, ঋতু গুহকে জোর করে আর‌ও কয়েকটা গান গাওয়াতে পারলে খুশি হতাম। আসলে ওঁর নাম মনে এলে ঋতু গুহর 'দিন ফুরালো হে সংসারী' আপনা থেকেই মনে পড়ে যায়। বড্ড কম গাইলেন প্রিয় গায়িকা।

নিজের চোখে কোনওদিন দেখিনি বুদ্ধদেব গুহকে। কোন‌ও শখও ছিল না, এখন‌ও নেই। সত্যি বলতে, কোন‌ও শিল্পী বা সাহিত‍্যিককেই সামনে থেকে দেখার কোন‌ও ইচ্ছে আমার নেই। বাইরে থেকে যেটুকু দেখা যায় না সেটুকুই তো শিল্পী। শিল্পীকে শিল্প দিয়ে দেখতে হয়। বইমেলার ধুলোয় সাড়ে তিন হাতের একজন নশ্বর মানুষ বসে আছেন ভক্ত পরিবৃত হয়ে, তিনি আমার পরিচিত শিল্পী নন। জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে গেলে বুদ্ধদেব গুহ আমার সঙ্গে হাঁটবেন। সে সঙ্গলাভ অনেক সহজ এবং সত্য।

শাস্ত্রে বলে, মানুষ মারা যাওয়ার সময় যা ভাবে পরের জন্মে তাই হয়ে যায়। ভরত রাজা হরিণ চিন্তা করতে করতে মারা গেলেন, পরের জন্মে হরিণ হয়ে জন্মালেন। বুদ্ধদেব গুহ মারা যাওয়ার সময় কার কথা ভাবছিলেন কেউই কোন‌ওদিন জানতে পারবেন না। দরকারই বা কী! তবে অসভ্য মানবপ্রজাতির দ্বারা উপড়ে দেওয়া, পুড়ে যাওয়া জঙ্গলের মাটি থেকে যখন একটা নতুন চারা মাথাচাড়া দেবে, তার দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে ভাবব, পুনর্জন্ম হয়তো মিথ্যে নয়।

 

3 comments:

  1. 'দিন ফুরালো হে সংসারী' এরকম কোন গান ঋতু গুহ এর record এ শুনিনি | শুনতে আগ্রহী |

    ReplyDelete