একটি বিজ্ঞাপন ও কয়েকটি কথা
শোভনলাল চক্রবর্তী
একটি চকোলেট নির্মাতা সংস্থার বিজ্ঞাপন এখন মুখে মুখে। কেউ বলছেন 'রোল রিভার্সাল', কারও মতে মুক্ত চিন্তার প্রতীক, কারও কাছে আবার শুধুই স্মৃতিমেদুরতা, কেউ বলছেন রিমেক। অনুষঙ্গ যাই হোক না কেন, বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে, একজন মহিলা ক্রিকেটার সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। গ্যালারিতে টেনশনে তাঁর বয়ফ্রেন্ড চোখ বুজে ফেলেছেন। মেয়েটি ৬ মেরে সেঞ্চুরি করেন। তা দেখে তিনি নাচতে নাচতে মাঠে ঢুকে ক্রিজের সামনে চলে যান।
আর এই বিজ্ঞাপন বাজারে আসতেই নয়ের দশকের আরেকটি বিজ্ঞাপন দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তাতে দেখানো হয়েছিল পুরুষ ক্রিকেটারটি একই ভাবে সেঞ্চুরি করেছিলেন, সেখানে মেয়েটি নাচতে নাচতে মাঠে ঢুকেছিলেন। ১৯৯৪ সালের সেই বিজ্ঞাপন আর আজ ২০২১-এর এই নতুন বিজ্ঞাপন- প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে এই দুটি বিজ্ঞাপন কী বার্তা দিচ্ছে? ১৯৯৪ সালে কী বলতে চেয়েছিল, আর এখনই বা কী বলছে?
আমজনতা এই বিজ্ঞাপনকে মূলত 'রোল রিভার্সাল ও রিমেক' হিসেবে দেখলেও, বিজ্ঞাপন প্রস্তুতকারকরা দাবি করছেন এই বিজ্ঞাপন দু'টো কিন্তু মোটেই শুধু নারী-পুরুষ চরিত্র বদলে দেওয়া নয়। খুব নির্দিষ্ট বার্তা আছে এর মধ্যে। ১৯৯৪ সালে ভারত তখন সদ্য সদ্য মুক্ত অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। সেই সময়ে একজন মহিলার স্বতঃস্ফূর্ত নাচ ছিল তাঁর ক্ষমতায়নের প্রতীক। নতুন বিজ্ঞাপনে রয়েছে আজকের নারীর সাফল্যের উদযাপন। মহিলারা সেই উচ্চতায় পৌঁছেছেন, যেখানে পুরুষরা গ্যালারিতে বসে তাঁদের জন্য গলা ফাটাচ্ছেন। এটা বর্তমান ভারতের সমাজ বদলের একটা লক্ষণ।
বিজ্ঞাপন প্রস্তুতকারক যে কথাই বলুন না কেন, সমাজে কতটা পরিবর্তন সত্যিই এসেছে, তা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। আজ বিজ্ঞাপনগুলি তৈরি হয়েছে যখন মেয়েরা সফলতা অর্জন করেছে। যদি ক্রিকেটের কথাই ধরি, তবে মহিলা ক্রিকেটারদের ছবি দেখলে কতজন তাঁদের চিনতে পারবেন? তাঁদের রেকর্ড মুখস্ত বলা তো অনেক দূরের কথা! খেলাকে কেরিয়ার হিসেবে ভারতের কতজন নারী আজকের দিনে ভাবতে পারবেন? আজ একজন সাধারণ ভারতীয় নারীর প্রেক্ষিতে সামাজিক পরিবর্তন কি হয়েছে বলে বলা চলে? যদি তাই হত, তবে নুসরত জাহানের সন্তানের পিতার পরিচয় নিয়ে যা হল, তা কেন? কাজেই মহিলাদের সম্পর্কে ভাবনা কিন্তু বিশেষ বদলায়নি।
এই বিজ্ঞাপন হোক বা একটি গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থার বিজ্ঞাপনে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মহিলার দ্বিতীয় বিবাহ বা বৃহন্নলার প্রতি সমাজের মনোভাব বদলানো, বয়স্কা বিধবা মহিলার পুরুষ-সঙ্গী খুঁজে পাওয়া- সবই বিশেষ বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু কোনওটাই সমাজে খুব প্রচলিত নয়। বা সমাজ তা সহজে স্বীকারও করবে না। সন্তানকে নিয়ে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে- এটা কিন্তু এখনও সমাজের একটা বড় অংশের কাছে অস্বাভাবিক। তেমনই বিধবা মহিলা নিজের জীবনসঙ্গী নিজেই খুঁজে নিচ্ছেন, এটাও সমাজে আজও খুব ভালো চোখে দেখা হয় না। আসলে এই বিজ্ঞাপনগুলো একটা বিশেষ সচ্ছল শ্রেণিকে তুলে ধরছে, হতে পারে সেখানে সেই শ্রেণিতে এই পরিবর্তনগুলো আসছে। আমাদের দেশের একটা বিরাট অংশে তার কোনও প্রতিফলন নেই। যে কারণে এই শেষ দু'টো বিজ্ঞাপন নিয়ে সমাজে তেমন কোনও হাইপ হয়নি।
ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মিতালি রাজ পেরিয়ে চলেছেন একের পর এক মাইলফলক। সম্প্রতি তিনি কুড়ি হাজার রান সম্পূর্ণ করেছেন। তাঁকে নিয়ে সিনেমা হচ্ছে। সেই সাফল্যের ছায়াই এই চকোলেটের বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞাপনী ছবি সত্যিই সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের প্রতিফলন নাকি বিজ্ঞাপন এই পরিবর্তনের সূত্রটা ধরিয়ে দিচ্ছে- তা নিয়ে বিতর্ক চলবেই। তবে একটা কথা ঠিক, এই ধরনের বিজ্ঞাপন ইতিবাচক। সেই ইতিবাচক দিকটা যতটা ছড়িয়ে পড়ে ততই ভালো। তাই এ ধরনের 'প্রতীকী ব্যঞ্জনা' স্বাগত।
সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ কবিতায় লিখেছিলেন, 'মুখ বদলে যায় বিজ্ঞাপনে'। ২৭ বছরের ফারাকে বিজ্ঞাপনে সত্যিই মুখ বদলেছে। কিন্তু বাস্তবের অবস্থা? সেই প্রশ্নের উত্তর আপাতত হাওয়ায় উড়ছে।
শঙ্খ ঘোষের কবিতাটি ছিল মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। বক্তব্য একটু আলাদা
ReplyDelete