কিউবা: নরক এবং স্বর্গ!
ফ্রেই বেট্টো
অনুবাদ: সমর বাগচী
(ফ্রেই বেট্টো ব্রাজিলের এক সুবিখ্যাত লেখক ও দার্শনিক)
কিউবার বিপ্লবের প্রতি আমার যে সংহতি তা কারওরই অজানা নয়। গত ৪০ বছর ধরে আমি মাঝে মাঝেই কাজের জন্য অথবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে কিউবায় গিয়েছি। বহুদিন ধরে ক্যাথলিক বিশপদের সঙ্গে কিউবার সরকারের আলোচনায় মধ্যস্থতা করার কাজে নিযুক্ত ছিলাম, যা আমার লেখা ‘Fidel and Religion’ (Fontanar/Companhia das Letras) এবং ‘Paradise Lost, Journeys to the Socialist World’ নামে দুটি গ্রন্থে বর্ণনা করেছি।
সম্প্রতি, FAO-এর সঙ্গে এক চুক্তিতে আমি কিউবার সরকারকে খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টি শিক্ষা পরিকল্পনার কাজে উপদেশ দেওয়ার কাজে নিযুক্ত আছি। আমি কিউবার অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং তারা যে অসুবিধা ভোগ করছে, বিপ্লবের যে চ্যালেঞ্জ, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের যে সমালোচনা, তার সঙ্গে পরিচিত। আমি জেল পরিদর্শনে গিয়েছি, কিউবার যাজক এবং সাধারণ মানুষ যারা সমাজবাদের বিরোধী, তাদের সঙ্গে বসবাস করেছি। তারা যখন আমাকে, অর্থাৎ, একজন ব্রাজিলের অধিবাসীকে বলে যে কিউবায় কোনও গণতন্ত্র নেই, তখন আমি শব্দের বিমূর্ততা থেকে বাস্তব অনুধাবন করার চেষ্টা করি। প্রশ্ন করি- কতগুলো ছবি বা খবর দেখা গেছে যে কিউবানরা কষ্টে আছে, রাস্তার ধারে ভিখারিরা সার দিয়ে বসে আছে, শিশুরা রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে বা পরিবারগুলি দীর্ঘ সেতুর নিচে অবস্থান করছে? যেমন দেখা যায় স্পেনের বড় শহরে দীর্ঘ লাইনে বছরের পর বছর চিকিৎসার জন্যে অপেক্ষারত দুঃস্থ মানুষদের!
আমি বন্ধুদের সাবধান করছি:
- তুমি যদি ব্রাজিলের ধনী মানুষ হও এবং কিউবায় বসবাস করতে যাও তোমার মনে হবে তুমি নরকে এসেছ। তুমি প্রতি বছর তোমার গাড়ি বদলাতে পারবে না, দামী দামী কাপড়জামা কিনতে পারবে না, ছুটিতে বারে বারে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবে না এবং অন্যের কাজকে শোষণ করতে পারবে না, কর্মীদের লেখাপড়ায় বঞ্চিত রাখতে পারবে না। মেরিয়া নামে যে মেয়েটি তোমার বাড়িতে প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করছে তার জন্যে ‘গর্ব’ অনুভব করবে, কিন্তু তাকে তুমি তোমার বাড়ির অন্দরে প্রবেশের, শিক্ষার এবং স্বাস্থ্যের অধিকার দেবে না।
- যদি তুমি মধ্যবিত্ত হও তাহলে প্রেতলোকের অভিজ্ঞতার জন্য তৈরি হও, যদিও কিউবা এখন আর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নয়। আমলাতন্ত্র বজায় আছে, তোমাকে বাজারের লাইনে ধৈর্য বজায় রাখতে হবে; যে জিনিস আজ পাওয়া যাচ্ছে, আমদানির অনিশ্চয়তার জন্য এক মাস পরে তা হয়তো পাওয়া যাবে না।
- কিন্তু, তুমি যদি মাইনে পাওয়া লোক হও, গরিব হও, গৃহহীন বা জমিহীন হও, তাহলে স্বর্গের অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্যে তৈরি হও: খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসগৃহ এবং কাজের ব্যাপারে বিপ্লব তোমাকে গ্যারান্টি দেবে। তুমি যা খেতে পছন্দ কর সেই সব খেতে না পাওয়ার জন্য অভ্যেস কর। কিন্তু, তুমি ক্ষুধার্ত থাকবে না। তোমার পরিবার শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং এমনকি নিখরচায় জটিল সার্জারির সুযোগ পাবে। তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং নাগরিকের অধিকার।
গ্রিসের যে গণতন্ত্রের কথা আমরা জানি তার গুণ আছে। কিন্তু, আমাদের মনে রাখা ভাল যে সেই সময়ে এথেন্সে ২০০০ মানুষকে সেবা করার জন্য ৪,০০,০০০ দাসকে কাজ করতে হত। যদি ঐসব দাসের কাউকে গণতন্ত্রের মহত্ব সম্বন্ধে জিগ্যেস করা হয় তাহলে সে কী উত্তর দেবে?
আমি কিউবার ভবিষ্যৎ’কে ব্রাজিল, গুয়াতেমালা এবং এমনকি পিউয়েরতোরিকো (যা এখন আমেরিকার উপনিবেশ, যাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি)’র মতো হতে দিতে চাই না। আমি এও চাই না যে কিউবা আমেরিকাকে আক্রমণ করুক এবং ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূল ভাগ দখল করুক, যেমন করেছে আমেরিকা গুয়ান্তানামাতে- যাকে একটা নিপীড়নের কেন্দ্র বানানো হয়েছে তথাকথিত আতঙ্কবাদীদের জন্য।
আমার অনুভবে গণতন্ত্র হচ্ছে ‘আমার মা বাপ’– যাকে জনসাধারণ স্বীকৃতি দিয়েছে- এবং ‘আমাদের রুটি’– প্রকৃতির দান ও মানুষের শ্রমকে ভাগাভাগি করে বাঁচা। জনগণের দ্বারা নির্বাচনই গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করে না। ব্রাজিল এবং ভারত যাদের আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলি, সেখানে দেখতে পাই গরিব মানুষের প্রকট দুর্দশা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন এবং দুঃখকষ্ট। যারা কিউবার ১৯৫৯ সালের আগের অবস্থা জানে তারা বলতে পারবে কাস্ত্রো কেন বিপ্লবের জয়ের জন্য এত সমর্থন পেয়েছিল। বিপ্লবের আগে কিউবার পরিচিতি ছিল ক্যারিবিয়া’র গণিকাগার হিসেবে। ব্যাঙ্ক এবং পর্যটন শিল্পকে মাফিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করত যেগুলি নিয়ে বেশ কয়েকটা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হাভানার যে প্রধান সন্নিহিত অঞ্চল তাকে এখনও ভেলাডো বলা হয়। কারণ, সেখানে কালোদের ঢুকতে দেওয়া হয় না।
তাঁবে থাকা কিউবাকে হারিয়ে আমেরিকা কখনও খুশি হয়নি। তাই, সিয়ারা মায়েস্ত্রা গেরিলাদের হাতে আসার পরে আমেরিকা ভাড়াটে সৈন্যদের সাহায্যে কিউবা আক্রমণ করার চেষ্টা করে। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে তারা পরাজিত হয়। পরের বছর প্রেসিডেন্ট কেনেডি কিউবায় অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে যা আজও বজায় আছে।
কিউবা একটা ছোট্ট দ্বীপ যার প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই সীমিত। তার আবশ্যিক প্রয়োজনীয় পদার্থের প্রায় ৬০ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। ট্রাম্প এই অবরোধ আরও জোরদার করে (২৪৩টা নতুন কার্যকারী অবরোধ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যা এখনও প্রেসিডেন্ট বাইডেন তুলে নেয়নি)। বর্তমান কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী মহামারির জন্য কিউবার প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন শিল্প একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই, আভ্যন্তরীণ অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। কিউবানদের মিতব্যয়ী হতে হয়েছে। যারা কিউবার বিপ্লবে অখুশি ও আমেরিকান স্বপ্নে বিভোর, তারা গত ২১ জুলাই CIA'এর সংহতিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। CIA'এর প্রধান এই মহাদেশ ঘুরে গেছে। কিউবার প্রেসিডেন্ট দিয়াজ-ক্যানেল ছাড়া অন্য কে আজ কিউবার বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারবে? আর্থিক, বাণিজ্যিক এবং শক্তি উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু হয়ে গেছে। হোয়াইট হাউস কিউবাতে একটা আভ্যন্তরীণ সামাজিক বিস্ফোরণ ঘটাতে চায় যার ফলে কিউবার মানুষ ‘মানবিক মিশন’ চাইবে। এই ছুতোয় আক্রমণ এবং সামরিক হস্তক্ষেপ করা হবে।
আমার মনে পড়ছে, ২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে আমি বলেছিলাম যে আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমেরিকা অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা বাধার সৃষ্টি করে কিউবার অর্থনীতি ও শক্তি উদ্যোগকে পিষে মারার চেষ্টা করেছে। এর পরে আসে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ২৪৩টা কার্যকরী ব্যবস্থা। ট্রাম্প কিউবাকে 'সন্ত্রাসবাদ প্রসার করছে' বলে চিহ্নিত করে। এইসব বাধানিষেধের ফলে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করার যে সব উৎস ছিল- যেমন পর্যটন, কিউবান-আমেরিকানদের কিউবাতে ভ্রমণ বা বিদেশি মুদ্রা পাঠানো- বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি মুদ্রার একটা বড় উৎস কিউবান মেডিক্যাল ব্রিগেড এবং অন্য দেশের দিক থেকে কিউবার প্রতি সংহতি- তাকে বদনাম করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এইসব অবরোধের ফলে দেশে খাদ্য, ওষুধপত্র এবং কাঁচামালের অভাব দেখা দেয় যার ফলে অর্থনীতি ও উৎপাদনে খারাপ প্রভাব পড়ে। দেশের রফতানি ও সম্পদের বিনিয়োগ কমে যায়। দেশে জ্বালানি এবং স্পেয়ার পার্টস'এর অভাব দেখা দেয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে শুরু করে। এটা হচ্ছে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০-১৯৯৫ সালের মধ্যে কিউবার অর্থনীতিতে যে বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছিল তাকে সমাধান করা গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হল মিডিয়ার নিয়মিত অপপ্রচার যা এক রীতি বর্জিত যুদ্ধ, যা পার্টি, রাষ্ট্র এবং দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে মানুষকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করল যে কিউবা’র সরকার মানুষের কল্যাণ সাধনে অপারগ।
এই অবস্থার মধ্যেই করোনা মহামারি সারা পৃথিবীতে দেখা দিল। এটা বলা উচিত যে আমেরিকার মতো ধনী দেশেরও এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার সঠিক ব্যবস্থা ছিল না। প্রতি লক্ষ মানুষের হিসেবে আমেরিকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু কিউবার চেয়ে অনেক বেশি ছিল; যেখানে আমেরিকায় প্রতি দশ লাখে ১৭২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে কিউবায় তা মাত্র ৪৭ জন। যখন আমেরিকা ভ্যাকসিনের জাতীয়তাবাদে নিমজ্জিত তখন কিউবার ডাক্তারদের ‘হেনরি রিভ ব্রিগেড’ সবচেয়ে গরিব দেশগুলোতে কাজ করেছে। এই কাজের জন্য কিউবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত।
সরাসরি কিউবা আক্রমণ করার সাফল্য লাভ না করলেও আমেরিকা তার কঠিন অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা চেষ্টা করেছে সেই অবরোধকে মোকাবিলা করার। কিন্তু, আমেরিকা সব সময় ক্যারিবিয়ান ওই দেশটিকে অধিকার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। ১৯৯২ সালের শুরুতে রাষ্ট্রসংঘ সর্বস্বীকৃত ভাবে কিউবার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ বন্ধ করার জন্য ভোট দেয়। কিউবার সরকার রিপোর্ট করে যে এপ্রিল ২০১৯ থেকে মার্চ ২০২০ সালের মধ্যে অবরোধের জন্য কিউবা ৫০ লক্ষ ডলারের সম্ভাব্য বাণিজ্য হারিয়েছে। গত ছয় দশকে কিউবা হারিয়েছে ১৪.৪ কোটি ডলার। বর্তমানে কিউবাতে যাতে বিদেশ থেকে তেল ঢুকতে না পারে তার জন্য আমেরিকা জাহাজ কোম্পানিগুলির ওপর অবরোধ জারি করেছে।
এই ভঙ্গুর অবস্থার জন্য রাস্তায় মিছিল হচ্ছে। কিন্তু, কিউবার সরকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও মিলিটারি নামাচ্ছে না। মারতি, চে গুয়েভারা এবং ফিদেলের আদর্শে অনুপ্রাণিত কিউবার জনগণ প্রমাণ করেছে তারা অজেয়। আমরা যারা একটা ন্যায়পূর্ণ পৃথিবী চাই, তাদের কিউবার সঙ্গে সংহতিতে তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।
(১ অগস্ট ২০২১ ইংরেজি সমাজবাদী সাপ্তাহিক Janata Weekly-তে প্রকাশিত)।
ভালো লেখা।
ReplyDeleteতথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণাত্মক সুখপাঠ্য
ReplyDeletehttps://pariprashna.website/article/nature-and-environment/organopnicos-or-urban-parks-alternative-agriculture-in-cuba/
ReplyDeleteExcellent humanity in cuba... They are trying to achieve very difficult goal..
ReplyDeleteThis is our dream society...