Saturday, 2 October 2021

গান্ধীমানস

চির বিতর্কিত অথচ অমর

শোভনলাল চক্রবর্তী

বিংশ শতাব্দীর এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী। দুটো বিশ্বযুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান, হিংসা, রক্তপাত, বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে- সব দেখেছে এই শতাব্দী। রাজনৈতিক নেতা থেকে বিপ্লবী, সবাই ক্ষমতাকেই মোক্ষ মনে করেছেন। একেবারে বিপরীত মেরুতে মাত্র একজন, অহিংস নীতিতে অবিচল মহাত্মা গান্ধী। চির বিতর্কিত, চির অমর। 

তিনি আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। যা দিয়েছেন তার সবটা হয়তো আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। তাঁর মহত্ব সেই কারণে সার্বিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। তাঁর লেখালেখি, গ্রন্থরাজি, বক্তৃতা উল্টেপাল্টে দেখা হয় বটে, কিন্তু গান্ধীর আত্মাকে স্পর্শ করতে সে অনুধ্যান অপারগ। এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। একুশ শতকে পৌঁছে এই তপস্বীর চিন্তা চেতনা ভাবনা এবং আদর্শকে ঠাহর করতে আমরা বারবার অসমর্থ হয়েছি। 

বছর খানেক আগে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার্স' আন্দোলনের সূত্রে ঠিক এমনিই একটি বহু বিতর্কিত প্রসঙ্গ ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়ে। এই মর্মে সুকৌশলে একটি মত ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে মহাত্মা আদতে ছিলেন এক বর্ণ বিদ্বেষী মানুষ। তাঁর মননেও নাকি ছিল জাতি বিদ্বেষের প্রবল প্রকাশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাস জীবনে সেখানকার আদিবাসীদের থেকে তিনি সর্বদা ভারতীয়দের পৃথক রাখতে তৎপর ছিলেন। কারণ, তাঁর মনে এক আশঙ্কা ছিল, নেটিভ আফ্রিকানদের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসক যেন ভারতীয়দের কোনওভাবে বঞ্চিত করতে না পারে। কেউ কেউ গান্ধীর লেখা খুলে দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি প্রথাগত ভাবে নেটিভ আফ্রিকানদের 'কাফির' অভিধায় অভিহিত করেছেন। 

এসব কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, কারণ, এ সবের তথ্য ও ইতিহাসগত প্রমাণ আছে। তবে অস্বীকার না করেও গান্ধীর হয়ে কলম ধরেছেন অনেকে, যেমন রাম গুহ, রাজমোহন গান্ধী, ফায়জল দেবজি। তাঁরা গান্ধীজীর মানুষ হিসেবে বিবর্তনের কথা বলেছেন। অনেক কালো মানুষের সঙ্গে গান্ধীজীর নিবিড় বন্ধুত্বের কথাও বলেছেন। তাঁরা গান্ধীজীর লেখা উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে ১৯১৩ সালের পর গান্ধীজী এসব ব্যাপারে আর কোনও মন্তব্য করেননি। ভুলে গেলে চলবে না, মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে নেলসন ম্যান্ডেলা পর্যন্ত যে সব বিশ্ববরেণ্য কালো মানুষ গান্ধীকে তাঁদের অনুপ্রেরণা বলে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা সবাই গান্ধীর আফ্রিকান অতীত সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাঁরা গান্ধীর চিন্তার বিবর্তনকে মেনে নিয়েছিলেন। যাঁরা আজও গান্ধী মূর্তি ভাঙার কথা বলেন, তাঁদের সম্পর্কে তাই নতুন করে কিছু বলার নেই। যাঁরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের রাজনীতি করেন, সেই রাজনীতিতে ধীর স্থির ভাবনার কোনও পরিসর থাকে না। কলকাতায় যাঁরা সত্তরের দশকে মূর্তি ভাঙার রাজনীতি করেছিলেন, তাঁদের ক'জনকে আমরা মনে রেখেছি? বরং যাঁদের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল তাঁরা আজও আমাদের হৃদয়ে স্বমহিমায় অবস্থান করছেন। 

নির্মোহ ভাবনা এবং সময়ের প্রেক্ষিত- ইতিহাস চর্চার এই দুটি অতি আবশ্যিক শর্তের মাপকাঠিতে বিচার করা দরকার গান্ধীর জীবনদর্শনকে। ব্রহ্মচর্য সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণা থেকে শুরু করে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ- তাঁর ধারণার ব্যাপ্তি অপরিমেয় এবং সে সব ধারণা নিয়ে তিনি কোনও রাখঢাক রাখেননি, সমস্ত কিছু সাবলীল ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাই তাঁকে ভুল ব্যাখ্যা করার খুব একটা অবকাশ নেই, কিন্তু সেখানেও অনেক প্রশ্ন আর কেন'র ভিড়। ইতিহাসবিদ লেনার্ড গর্ডন লিখেছেন যে, তিরিশ-চল্লিশের দশকে হিন্দু বাঙালিরা গান্ধীকে বলতেন 'গেঁধো শালা', গান্ধী নাকি ছিলেন হিন্দু বিরোধী। গর্ডন আরও লিখছেন, যে সত্তরের দশকে বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হল 'চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান'- সেই চেয়ারম্যান মাও আজ নিজের দেশেই বিস্মৃতপ্রায়, কিন্তু গান্ধী আজও স্বমহিমায় বিরাজ করছেন বিশ্ববাসীর মনে। 

গর্ডন'এর এই লেখার প্রেক্ষিতে মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন এমন হল? কারণ, গান্ধীর সম্পূর্ণ জীবন চিত্র ও ভাষ্যে দীপ্যমান। গান্ধীজীর গ্রামীণ ভারত এবং তার অর্থনৈতিক বিকাশ কিংবা বর্ণাশ্রম সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন এবং ভাবনা, কোনওটাই বিক্ষিপ্ত চিন্তা বা এলোমেলো নয়, বরং এক সুসংহত সমাজ পরিকল্পনার অঙ্গ। আধুনিকতার সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল না কিন্তু নির্বিচারে সনাতনী ভারত আত্মাকে বিসর্জন দিয়ে, মানবতাবাদকে উপেক্ষা করে কোনও মতবাদ বা পরিকল্পনায় তিনি সায় দেননি। তিনি বুঝেছিলেন, বিরামহীন নগরকেন্দ্রিকতা সভ্যতার একমাত্র সূচক হতে পারে না, ভারত আত্মা নিহিত আছে তার গ্রামে। গান্ধীর জন্মজয়ন্তীতে এই উপলব্ধি আরও একবার আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে তুলুক যে, প্রেক্ষিতহীন ভাবে অতীত এবং অনতি অতীতের ইতিহাসের বিকৃতি এক অর্থে মানসিক ক্লীবত্বকে প্রতিষ্ঠা করে। যে ক্লীবত্ব থেকে গান্ধীর ব্রহ্মচর্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে আক্রমণ করা হয়। 'মি টু'র যুগে গান্ধী যা করেছিলেন তাকে যৌন হেনস্থা বলে অনেকে দাগিয়ে থাকেন। অন্যদিকে যাঁরা গান্ধীর এই পরীক্ষার সঙ্গী ছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন, গান্ধী ছিলেন তাঁদের মা। একজন পুরুষের মধ্যে মা'কে খুঁজে পাওয়া বড় সহজ নয়, বলেন মনস্তাত্ত্বিকরা। 

গান্ধীজী কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি, সত্যের সঙ্গে সব পরীক্ষা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাই তাঁর জীবন যেন একটা খোলা বই। তাঁর জীবনই তাঁর বাণী- কথাটার অর্থই এই যে পাঠক নিজেই বিচার করবেন কোথায় গান্ধীজী ভুল আর কোথায় ঠিক। সত্যের পরীক্ষায় পাশ-ফেলের নম্বর দেবেন পাঠক- এই ছিল গান্ধীর অভিমত। দেশের মুক্তি, মানুষের মুক্তি ও নিজের আত্মার মুক্তির জন্য যে সাধনাত্রয়, সেই ত্রিমুখি সাধনাকে তিনি কখনও পরস্পর বিযুক্ত বলে ভাবেননি। গান্ধীজীর জীবন ছিল ভয়ঙ্কর ও অসাধারণত্বের এক অনন্য সংমিশ্রণ। সুভাষ চন্দ্র বসু'র প্রতি তাঁর আচরণ এবং সুভাষ সম্পর্কে তাঁর মত একেবারে বিপরীত মেরুর। এই বৈপরীত্য আসলে একজন সাধারণ মানুষের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মহাত্মার বিজ্ঞান নিয়ে যে তরজা, সেখানেও আমরা এক দেবতা নয়, সাধারণ মানুষকে দেখি যিনি পাপ-পুণ্য বিশ্বাস করেন, টোটকায় বিশ্বাস রাখেন। এসবের ফলে গান্ধী ছোট হয়ে যাননি, শুধু রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। 

বিবিসি'কে দেওয়া একটি রেডিও সাক্ষাৎকারে আম্বেদকর একবার বলেছিলেন, গান্ধীজী স্মরণীয় কেউ নন, ভারত সরকার তাঁর স্মৃতি জিইয়ে রাখার জন্য প্রতি বছর অনেক পয়সা খরচ না করলে পৃথিবীর মানুষ গান্ধীকে মনে রাখত না। সত্যিই কি তাই? আমাদের দেশের এবং পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, শুধু নাম জানা নয়, প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অবশ্যপাঠ্য তাঁর রচনা। সবাই তাঁর রচনার সঙ্গে একমত বলে তা নয়, এই আধুনিক, দূষণদুষ্ট, সংঘাতক্লিষ্ট শিল্প সভ্যতার আলোচনা তাঁকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়, তাই তিনি পাঠ্য। কেউ ভাবেন, তাঁর ভাবনা চিন্তা অবাস্তব, কেউ ভাবেন তিনি প্রতিক্রিয়াশীল, কেউ ভাবেন সাধুত্বের আড়ালে তিনি এক ধূর্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁকে বিস্মৃত হওয়া যায় না। ধনী বা নিঃস্বের মধ্যে গান্ধী মহারাজের শিষ্য আজ আর পাওয়া যাবে না হয়তো। আসলে আমরা জেনেশুনেই তাঁর পথে হাঁটি না, কিন্তু তিনি তবু আমাদের মনের মধ্যে বসে থেকে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করেন: কোথায় চলেছ? 

গান্ধীর মৃত্যুর পর আইনস্টাইন বলেছিলেন, আগামী বিশ্ব বিশ্বাসই করবে না যে এইরকম একজন মানুষ পৃথিবীর মাটিতে হেঁটেছিলেন। কথাটা ভীষণ সত্যি, নইলে আজও কেন স্লোগান ওঠে 'গান্ধী নিপাত যাক'। আসলে গান্ধীমানস এক অতলান্তিক সমুদ্র যাত্রা যার গভীরতায় আমরা ভয় পাই, সেই ভয় থেকেই ওই স্লোগান। সেই অতলান্তিক সমুদ্রযাত্রার পরতে পরতে মিশে আছে ভারতের উন্নতির স্বপ্ন। এই স্বপ্নের অভিযাত্রা আমাদের পৌঁছে দিতে পারে কোন শীর্ষে- সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা বড় সীমিত। আর এর ব্যাপকতা অনুভব করতে চাই সামগ্রিক ইতিহাস চেতনা। সেই চেতনার এত অভাব দেখে মন অশান্ত হয়ে ওঠে।


4 comments:

  1. বড় অন্ধভক্ত।
    অক্ষমতা,নীরবে অন্যায়ের পক্ষে থাকা গান্ধীর বিশ্লেষণ জরুরি ছিল।
    গান্ধীর মতো নেতা পেয়েও ভারত কোথায়, আর মাওকে পেয়ে চিন কোথায়?
    শোভন বাবু এক চোখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Liked the reader's reaction much more than the article.

      Delete
  2. অক্ষমতা, নীরবে অন্যায়ের পাশে থাকা গান্ধী চর্চাই তো বাঙালির গান্ধী চর্চা। সে তো বহুকাল ধরেই চলছে। সে সম্পর্কে বই বাজারে অগুনতি, গান্ধীকে বাছাই বাছাই গালাগালি দিয়েও লেখকদের সাধ মেটেননা। আর আজকের চিন আর মাও - বলবেন না। ঘোড়ায় হাসবে। সাধারণ মানুষের উপর যে পৈচাশিক স্টিম রোলার চালিয়ে আজকের চিনের উত্থান, সে জিনিষ যে ভারতে হয় নি, তাঁর কারণ ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি অনেক মজবুত। সেই জিনিষ ভারতে হলে কমেন্ট বক্স ভরাবার অবকাশ পেতেন না।

    ReplyDelete
  3. সত্যিই গান্ধীজী একজন অত্যন্ত বিতর্কিত চরিত্র । তাঁর অনেক নীতি, আদর্শের উপর আমি সহমত নই; কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মধ্যে এমন কিছু গুণ, এমন কিছু ব্যাপার ছিল যার জন্য তাঁকে অস্বীকার করাও যায় না । গান্ধীজী সত্যিই একজন দোষে গুণে সমৃদ্ধ রক্ত মাংসে গড়া এক মহামানব । 👍🏻👌🏼🙏🏼

    ReplyDelete