'তবু মনে রেখো'
প্রবুদ্ধ বাগচী
বিশ শতকের গোড়ার দিকে এই দেশে রেকর্ডিং প্রযুক্তি বাণিজ্যিক ভাবে প্রচলন হয়। কলকাতায় তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রনাথ বসু যাকে সবাই এইচ বোস বলেই চিনত। আদপে তিনি ছিলেন সুগন্ধি-ব্যবসায়ী, নিজের ল্যাবরেটারিতে নানা সুগন্ধি তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে বিপণন করতেন। তাঁর উৎপাদিত ‘কুন্তলীন’ ছিল অতি পরিচিত একটি সুগন্ধি। সাহিত্যমনস্ক এইচ বোস সাময়িকপত্রে প্রকাশিত গল্প বাছাই করে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার চালু করেছিলেন এটাও আমরা জানি। পরে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পের একটা সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এইচ বোস ছিলেন উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর ভগ্নীপতি।
সিলিন্ডার রেকর্ডিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পরে এইচ বোস রেকর্ড ও তা বাজানোর যন্ত্র তৈরি করে সাফল্যের সঙ্গে বিপণন করতে আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ রেকর্ডিং করার প্রথম কৃতিত্ব তাঁরই। এইচ বোসের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান রেকর্ডিং করতে আসতেন, এই তথ্য অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। তখন কলকাতা শহরে গায়ক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ভীষণ নামডাক। কিন্তু এগুলো সবই ছিল সিলিন্ডার রেকর্ড যা একাধিক কপি করা ছিল খুবই কঠিন আর তার সংরক্ষণ ছিল আরও সমস্যার। ফলে, ওই সময়ে করা রবীন্দ্রনাথের নিজের রেকর্ডিং প্রায় সবই নষ্ট হয়ে গেছে। কোনও কোনও সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ নাকি এইচ বোসের স্টুডিওতে ‘বন্দেমাতরম’ গান নিজের সুরে রেকর্ডিং করেছিলেন। পরে পুলিশ এসে সেই রেকর্ড বাজেয়াপ্ত ও নষ্ট করে দেয়।
রেকর্ডিং প্রযুক্তির নতুন রকম উন্নতি হল ১৯২৪-২৫ নাগাদ। যখন সিলিন্ডার রেকর্ডের বদলে এল চ্যাপ্টা গ্রামোফোন রেকর্ড। বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে এই রেকর্ডিং হত। বাঙালি উদ্যোগপতি চণ্ডী চরণ সাহা ১৯২৫ সালে জার্মানি গিয়েছিলেন এই বৈদ্যুতিক রেকর্ডিং প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথও ছিলেন জার্মানিতে। সেখানে তাঁদের দেখা হয় এবং চন্ডীবাবু রবীন্দ্রনাথকে জানান, তিনি জার্মানি থেকে সমস্ত যন্ত্রপাতি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে খুব শিগগিরি রেকর্ডিং কোম্পানি চালু করবেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুরোধ রাখা হয়, তিনি যেন এই বাঙালি কোম্পানি থেকে নিজের রেকর্ড করেন। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী বাসন্তী দেবীকে লিখছেন, '…এক ভদ্রলোক গ্রামোফোনে সুর ধরিয়া রাখার বিদ্যা য়ুরোপে গিয়া আয়ত্ত করিয়াছেন। তাঁর ইচ্ছা আমি তাহার কোম্পানিতে রেকর্ড করি।' (১৩৩৮, ৭ চৈত্র)।
১৯২৬ সালে এই চণ্ডী চরণ সাহা (সি সি সাহা) কলকাতায় তাঁর রেকর্ড কোম্পানি ‘হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রোডাক্টস’ তৈরি করলেন। মধ্য কলকাতার অক্রূর দত্ত লেনে তৈরি হল তাঁদের স্টুডিও যা পরবর্তীকালের বহু যশস্বী শিল্পীর পায়ের ধুলোয় ধন্য হয়ে উঠবে। স্টুডিওর আনুষ্ঠানিক সূচনা হল ওই বছর রাখি পূর্ণিমায় যেদিন স্বয়ং কবি সেখানে উপস্থিত ছিলেন ও ভিজিটর্স খাতায় লিখলেন তাঁর আশীর্বাণী। পরাধীন দেশের প্রথম দেশিয় কোম্পানি ছিল এই হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রোডাক্টস। ১৯৩২-এ কোম্পানি থেকে রেকর্ডিং'এর আমন্ত্রণ এল কবির কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তখন যে এই বিষয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন তা নয়। রথীন্দ্রনাথও কিছুটা আপত্তি করেছিলেন; কারণ ওই সময়কালে কবির বয়স একাত্তর, গলার সতেজভাব অনেকটাই স্তিমিত। এই অশক্ত গলার রেকর্ডিং কতটা ভাল হবে বা মানুষ তা কীভাবে নেবেন, এই নিয়ে তাঁদের একটা চিন্তা ছিল।
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার
পাওয়ার আগে অবধি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে অনেক গানের রেকর্ড প্রকাশ পেয়েছিল যার কথা
ও সুর রবীন্দ্রনাথের হলেও তাঁর নামের কোনও উল্লেখ অনেক সময়ই থাকত না, আর সেগুলি যারা
গাইতেন তাঁরাও মূল স্বরলিপির তোয়াক্কা না করে একেবারে নিজেদের মতো করে গাইতেন। এই ঘটনার
পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের সলিসিটর খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় গ্রামোফোন কোম্পানির
দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও প্রকাশিত গানের রয়্যালটি দাবি করেন। গ্রামোফোন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ
সেই দাবি মেনে নেন ও পরে প্রকাশিত গানের জন্য কবিকে নিয়মিত রয়্যালটি দিতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথই
প্রথম ব্যক্তি যিনি সংগীত রচয়িতা হিসেবে রেকর্ড কোম্পানি থেকে নিজের লেখার জন্য সম্মানভাতা
পেয়েছেন। এই সূত্রেই গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে কবির একটি চুক্তি হয় যাতে বলা হয় কবির
গান গাওয়া ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবির অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে। আর কবি নিজে রেকর্ড
করলেও তিনি নিয়মমাফিক তাঁর রয়্যালটি পাবেন। এর পরে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকেও কবির অনেকগুলি
রেকর্ড প্রকাশিত হয়, সেগুলিতে কবির কন্ঠ তুলনায় অনেক জোরালো, সেই সময়ের রেকর্ডিং প্রযুক্তির
সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও।
এখন সেই কারণেই কবি ও তাঁর পরিবার হিন্দুস্থান কোম্পানির এই প্রস্তাব নিয়ে একটু কুন্ঠিত ছিলেন। তখন এগিয়ে এলেন দুই মহলানবীশ ভাই- প্রফুল্লচন্দ্র ও প্রশান্তচন্দ্র এবং চণ্ডীবাবু নিজেও। তাঁরা কবিকে বোঝালেন, দেশবাসীর স্বার্থেই তাঁর কণ্ঠ রেকর্ডে ধরে রাখা উচিত। অনেক অনুরোধ উপরোধ রবীন্দ্রনাথ আর ফেলতে পারলেন না। এইভাবেই হল তাঁর রেকর্ডিং। 'তবু মনে রেখো'- কবির একাত্তর বছর বয়সের রেকর্ডিং:
এই রেকর্ডিং যারা শুনলেন তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন গানটির রেকর্ডিং'এর একটা বৈশিষ্ট্য। গানের একদম শেষ দিকে কবি একবারে ‘তবু মনে রেখো’ কথাটা উচ্চারণ করেননি- গেয়েছেন ‘ত……….বু মনে রেখো’; কেন এমন হল? এটা কি রেকর্ডিং'এর ত্রুটি? যদি ত্রুটিই হয় তাহলে এই রেকর্ড বাজারে এল কেন? উত্তরকালে ঠিক এই প্রশ্নটিই গায়িকা চিত্রলেখা চৌধুরীকে করেছিলেন এই রেকর্ডিং'এর রেকর্ডিস্ট নীরদবরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্রলেখা বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে বলেছিলেন, এটা প্রযুক্তিগত ত্রুটি। আসলে কী? সেই কথা জানিয়েছেন স্বয়ং রেকর্ডিস্ট নীরদবাবু। এই গান কবির একদম প্রথম জীবনে লেখা এবং বহু অনুষ্ঠানে এই গান তিনি গেয়েছেন। ফলে, গানটির প্রতি কবির ছিল একরকমের গভীর একাত্মতাবোধ। পরিণত বয়সে এই গান রেকর্ড করতে এসে সত্যি সত্যি তিনি একাকার হয়ে গিয়েছিলেন এই গানের বাণীর ব্যঞ্জনার সঙ্গে। তাই গানের মধ্যে বারবার ধুয়ো হিসেবে উঠে আসা ‘তবু মনে রেখো’র উচ্চারণ আসলে ছেয়ে ফেলেছিল তাঁর ব্যক্তি আবেগের আকাশ। রেকর্ডিং করতে করতে ওই জায়গাটায় এসে সত্যি সত্যি কবির চোখে জল, কন্ঠ অশ্রুবাষ্পে অবরুদ্ধ- এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন রেকর্ডিস্ট। সেই অবকাশে ক্ষণিকের জন্য হলেও থেমে গিয়েছিল কবির কণ্ঠ। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে এসেছেন গানে- কিন্তু ওই ‘ত………বু’র উচ্চারণ বিক্ষেপ রেকর্ড করতে যন্ত্র তো আর ভুল করেনি!
কিন্তু ওই রেকর্ডিং বাতিল করা হল না কেন? এই বিষয়ে জানা যায়, রেকর্ডিং শোনার পরে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন এই ‘ভুল’টার এক মানবিক আবেদন আছে, তাই কবির আবেগ সমেত এই রেকর্ডিং'টিই বাজারে প্রকাশিত হয়। তাঁরা যথার্থ কাজই করেছেন। কিন্তু আক্ষেপের কথা, পরবর্তীকালে ডিজিটাল যুগে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই অংশ বাদ দিয়ে মেরামত করে রেকর্ডিং প্রকাশ করা হয় হিন্দুস্থান মিউজিকাল কোম্পানির তরফে যা খুব উচিত বলে আমাদের মনে হয় না। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যদিও এই রেকর্ডিং এখনও পাওয়া যায়।
প্রবুদ্ধবাবুকে ধন্যবাদ, একটি ভিন্নধর্মী রচনা উপহার দেওয়ার জন্য। প্রবুদ্ধবাবু কবির আবেগ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন তাঁর লেখনীতে। এ এক পরম পাওয়া।
ReplyDelete