রাম মহম্মদ সিং আজাদ
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
রাম মহম্মদ সিং আজাদ।
লন্ডনে বৃটিশ পুলিশ হেফাজতে যখন বিপ্লবী উধম সিং’কে বার বার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তাঁর নাম, তখন জামার হাতা সরিয়ে বাঁ-হাতে ট্যাটু করা তাঁর ওই নাম তিনি গোয়েন্দাদের দেখিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, বার বার তিনি বলেছেন, এমনকি আদালতেও, যে তাঁর নাম রাম মহম্মদ সিং আজাদ।
এই বিষময় সময়ে দাঁড়িয়ে সুজিত সরকার আমাদের এক অমূল্য রতন উপহার দিয়েছেন: সর্দার উধম। প্রায় আড়াই ঘন্টার একটি রুদ্ধশ্বাস ছবি। কীভাবে বৃটিশ শাসক আমাদের নির্দ্বিধায় ছিন্নভিন্ন করেছে আর মনের মধ্যে সাহস ও সঙ্কল্পকে মজুত করে উধম সিং, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখররা তার মোকাবিলা করেছেন। এই ছবি তাই শুধুমাত্র দেখার নয়, উপলব্ধি করা ও রুখে দাঁড়ানোর।
১৯১৯’এর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূল কাণ্ডারী মাইকেল ও’ ডায়ার শুধুমাত্র এক হত্যাকারী নয়, নৃশংসতম হত্যাকে কীভাবে যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে উপস্থাপন করতে হয়, তারও দক্ষ কারিগর ছিল। তাই হাজার হাজার মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা তার কাছে এক নিষ্ঠুর কর্তব্য মাত্র, যা ‘বর্বরতা থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার করতে শ্বেতবর্ণের মানুষের বোঝাস্বরূপ’; নয়তো তারা নাকি আবার ‘বর্বরতায় ফিরে যাবে’।
তাই, উধম সিং অপেক্ষা করেছেন। লন্ডনে এসেও অন্তত ছ’ বছর অপেক্ষা করেছেন। নির্জনে হাতের সামনে ডায়ারকে পেয়েও তাকে মারেননি সশস্ত্র উধম। কারণ, মাইকেল ডায়ার তাঁর কাছে নিছক এক নিষ্ঠুরতম ব্যক্তি মাত্র নয়, হিংস্র বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিভূ, যা গোটা ভারতবর্ষকে নিংড়ে, ছিবড়ে, রক্তাক্ত করেছে। অতএব, এ হেন ব্যক্তিকে যদি মারতে হয়, তা আসলে হতে হবে এমন এক উন্মুক্ত প্রতিবাদ, এমন এক যোগ্য জবাব, যা আপামর ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করবে আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা অর্জনে। উধম তেমনই করেছিলেন। তাঁর সেই প্রয়াস ও সফলতা তাই সারা বিশ্ব জুড়ে এক গণ আলোড়নের জন্ম দিয়েছিল।
সুজিত সরকার এই ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে নিজেকে গভীরভাবে উজাড় করে দিয়েছেন। শুধু তথ্য সংগ্রহ বা খুঁটিনাটি গবেষণা মাত্র নয়, তাঁর এই নির্মাণের পিছনে কাজ করেছে এক অন্তর্লীন ইতিহাস চেতনা ও তার প্রতি দায়বদ্ধতা। ‘সর্দার উধম’ তাই কোনও বায়োপিক নয়, বর্তমান সময়েরও এক সুকঠিন উচ্চারণ; যে উচ্চারণ শক্তিশালী আততায়ীকে আড়াল করে মানুষে মানুষে সংঘাত ও রক্তপাত নির্গমনের সুকৌশলী রাজনীতির বিরুদ্ধে আজকের সময়ের জেহাদ।
জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই নির্মমতম হত্যাকাণ্ডের দিন উধমের বয়স ছিল মাত্র ২০। সেদিনের সভায় তিনি যেতে পারেননি কিন্তু হত্যাকাণ্ড-স্থল থেকে সারা রাত ধরে আহত ব্যক্তিদের একে একে তুলে নিয়ে গিয়েছেন নিকটবর্তী চিকিৎসা কেন্দ্রে, যদি কোনওভাবে মৃতপ্রায় মানুষগুলি বেঁচে ওঠে। সেদিনই রক্তস্নাত হাজার লাশ পড়ে থাকা সেই ময়দানে উধম জড়িয়ে পড়েছিলেন এক মহাকালের সঙ্গে যেখানে সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তাঁর মনে পড়েছিল ১৮ বছর বয়সে তাঁরই এক শিক্ষকের বাচন, যিনি বলেছিলেন, জীবনকে অর্থপূর্ণ করে বাঁচতে শেখো। জীবনের সেই গূঢ় অর্থের সন্ধান তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তাক্ত ময়দানের সে রাতেই পেয়েছিলেন। তারপর ২১ বছর তিনি অপেক্ষা করেছেন তাঁর জীবনের গভীর লক্ষ্যকে সুগঠিত করে তাকে বাস্তব রূপ দিতে।
এমনই এক ব্যক্তির দীর্ঘায়ত নীরব সাধনাকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন সুজিত সরকার। এ ছবি না দেখলে শুধু এক সেরা চলচ্চিত্র-দর্শন থেকেই বঞ্চিত থাকা হবে না, ইতিহাসের প্রায়-অজানা এক আকর ও উপলব্ধিকেও হারানো হবে। তাই, ‘সর্দার উধম’ শুধুমাত্র এক চলচ্চিত্র নয়, ইতিহাসের এক মর্মস্পর্শী আলেখ্য, চৈতন্য ও জীবনবোধ।
👍🏼💟
ReplyDelete