যে আধার নারীর ব্যক্তিগত
অমৃতা ঘোষাল
গল্পটা ছিল এইরকম:
পার্লারে কাজ করা একটা মেয়ে একবার দেখে ফেলে একটা নতুন বস্তু। বস্তুটার খরচ খুবই কম। পরিবেশের ক্ষতিও বিশেষ করে না। শরীরের পক্ষেও ভালো। বস্তুটা মেনস্ট্রুয়াল কাপ। ব্যাস, পার্লারে আসা এক কাস্টমার দিদির থেকে সে কিনেই ফেলল। বাড়ি ফিরেই প্রেমিককে ফোনে জানায়। প্রেমিকের সাজেশন- 'ওই কাপেই সন্ধ্যের চা'টা ঢেলে খেয়ে নে।' যাই হোক, অনেকটা আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে মেয়েটা কাপ'টা দেহে ব্যবহার করে। ক্রমশ এটাই ব্যবহার করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। সে সন্তুষ্ট।
সন ১৮৬৭। মেনস্ট্রুয়াল কাপের একেবারে প্রাথমিক একটা রূপ দেখা গেল। শিকাগোর এসএল হকার্ট নামে এক ব্যক্তি 'ক্যাটেমেনিয়াল স্যাক'এর ডিজাইন পরিকল্পনা করলেন। কোমর ঘিরে একটা বেল্ট, তার সঙ্গে যুক্ত একটা সুতো বা সরু দড়ির মতো অংশ, সেই সঙ্গে যুক্ত একটা রিং আর স্যাক। স্যাক ও রিং সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক যোনিপথে প্রবেশ করিয়ে এটা ব্যবহার করা যাবে- এই ছিল সেই ডিজাইনের দাবি। তবে সামাজিকভাবে এই ডিজাইন কিংবা এই 'স্যাক'এর ব্যবহার কোনওটাই আদর পেল না। সম্ভবত এর ব্যবহার-প্রণালী খুব একটা আরামপ্রদ ছিল না।
এরপর ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান অভিনেত্রী লিওনা ডবলিউ চালমার্স আরেকটা ডিজাইনের পরিকল্পনা করেন। রবার দিয়ে তৈরি একটা মেনস্ট্রুয়াল কাপ, যেটা ব্যবহারের জন্যে দড়ি, সুতো, বেল্ট বা অন্যান্য কিছুর প্রয়োজন পড়ত না। সম্ভবত একটা প্যাড-ফ্রি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন লিওনা। লিওনা'র আবিষ্কৃত এই কাপটির যাত্রা হঠাৎই থেমে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রবারের বিশেষ অভাব দেখা দিলে এর নির্মাণকার্যও থেমে যায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে লিওনা আবার মেনস্ট্রুয়াল কাপ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নারী-অঙ্গ আর ঋতুচক্র নিয়ে এত মিথ আর কুসংস্কার মানুষের মধ্যে গেঁথে ছিল যে বস্তুটি এতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করল না। যোনির ভেতরে কোনও কিছু প্রবেশ করানো নিয়েও অনেক অদ্ভুত ভাবনা জেগে উঠেছিল। কেউ ভাবত এটা হয়তো কোনও নিষিদ্ধ সুখ-গ্রহণের কৌশল, কেউ বা ভাবত এর পরিণতি হয়তো অসুস্থতা।
চালমার্স'এর স্বপ্ন বাস্তবের মাটি না ছুঁলেও, মেনস্ট্রুয়াল কাপের যাত্রা কিন্তু থামল না। এরপর দায়িত্ব গ্রহণ করেন রবার্ট পি ওরেক। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেনস্ট্রুয়াল কাপের একটি নতুন কোম্পানি খোলেন। এবার সমস্যা হল, তিনি এই বস্তুটার প্রচার করবেন কীভাবে? সারা সমাজ জুড়েই তো 'ভ্যাজাইনা' আর 'মেনস্ট্রুয়েশন' নিষিদ্ধ শব্দ। বিজ্ঞাপনে তাই সে শব্দগুচ্ছের ব্যবহার করা যাবে না। তখন প্রচারের একটা উপায় বের করা হল। নার্সদের জিনিসটা ব্যবহার করার জন্যে পাঠানো হল ও তাদের ফিডব্যাক চেয়ে নেওয়া হল। নার্সদের অনুকূল প্রতিক্রিয়াকে সমাজের কাছে তুলে ধরা হল। তখন সেটা মেনস্ট্রুয়াল হেলথ প্রোডাক্ট হিসেবে সামান্য জায়গা পেল। খুব সামান্যই সে জায়গা, কারণ সমাজ চিরকালই শুচিবায়ুগ্রস্থ। 'মেনস্ট্রুয়াল কাপ'কে ব্যবহারের পর যোনি থেকে আঙুলের সাহায্যে বের করা, তারপর সেটাকে পরিষ্কার ও পুনরায় ব্যবহার করা- এই পদ্ধতি শুনে অনেকেই নাক কুঁচকে ফেলতেন।
আশির দশকের 'দ্য কিপার'-এর উদ্ভাবিত ল্যাটেক্স রবারের মেনস্ট্রুয়াল কাপ অবশ্য একটু বেশি সাড়া পায় আগেরগুলোর চেয়ে। ২০০১'এ শেষ অবধি তৈরি হয় প্রথম সিলিকন মেনস্ট্রুয়াল কাপ। এগুলোতে ব্যবহৃত সিলিকন রীতিমতো মেডিক্যাল গ্রেডের, যাতে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া প্রায় হয় না বললেই চলে। ক্রমশ এই প্রোডাক্টটার উৎপাদন শুরু করে বেশ কিছু কোম্পানি। বর্তমানে প্রায় সারা বিশ্বে বিভিন্ন আকার-আয়তনের মেনস্ট্রুয়াল কাপ বিক্রি ও ব্যবহার হতে দেখা যায়। ২০১০'এ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেমন কেনিয়া, সাউথ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে মেনস্ট্রুয়াল কাপ নিয়ে বেশ সদর্থক প্রচার দেখা গিয়েছে। ২০১৯-এ কেরালার আলাপ্পঝায় মিউনিসিপালিটি কর্তৃক একটা প্রজেক্ট গৃহীত হয়েছিল। পাঁচ হাজার মেনস্ট্রুয়াল কাপ নারীদের মধ্যে একেবারে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল। তারপর সেই এলাকার প্রচুর নারী স্থায়ীভাবে এই প্রোডাক্ট ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নিঃসন্দেহে এটা একটা যুগান্তকারী ব্যাপার।
স্যানিটারি ন্যাপকিন বেশিরভাগই প্লাস্টিক-বেসড। এগুলোর ব্যবহার-পরবর্তী নিক্ষেপ-প্রক্রিয়া মাটি, জল, বাতাস সমস্তটাকেই ভয়ানক ভাবে দূষিত করে চলেছে। একবার একটি গার্লস হোস্টেলের পেছনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখেছিলাম, একটা পথ নুড়িতে বা ঘাসে নয়, ব্যবহৃত প্যাডে বিছানো। একবার এক কলেজের টিচার্স টয়লেটে গিয়ে ন্যাপকিন চেঞ্জ করার পর কোনও ডাস্টবিন দেখতে না পেয়ে প্যাডটাকে কোনও ভাবে মুড়ে কাঁধের ব্যাগেই ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। আসলে উপায় কিন্তু আমাদের সকলের সামনেই রয়েছে, শুধু গ্রহণ আর প্রয়োগ করলেই হবে।
নটে গাছ মুড়িয়ে ফেলার আগে একটা গল্প বলি:
ফেসবুকে এক দারুণ কাপল'এর ব্রেক আপ স্টোরি। লিখেছে অবশ্য বীর প্রেমিকটি। দু' বছর প্রেমের পর পুরুষসিংহটি দেখে তার ড্রিমগার্ল মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করে। তখনই ড্রিমগার্লকে সে নানা জন্তুর স্ত্রীলিঙ্গ-বাচক নামের অভিধায় সাজিয়ে ফেসবুকে ব্রেক আপের স্টেটাস দেয়।
সে যাই হোক, তবে এটুকু বলে রাখা ভালো যে, আমার এই লেখা কিন্তু এই জাতের প্রেমিকদের জন্যে নয়। আর মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা বা না-করা যে নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত, সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত থাকতেই পারে না।
No comments:
Post a Comment