Monday, 4 October 2021

'জাগ উঠা ইনসান'

উত্তরপ্রদেশে মুষল পর্ব

সোমনাথ গুহ


গতকাল (৩ অক্টোবর) উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে যা ঘটে গেল তাতে সারা দেশ স্তম্ভিত। আদিত্যনাথের জমানায় নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের ওপর অভূতপূর্ব দমনপীড়ন থেকে শুরু করে হাথরস কাণ্ড পর্যন্ত এই রাজ্যে বহু মর্মান্তিক ঘটনা দেখা গেছে, কিন্তু পূর্ব উত্তরপ্রদেশের এই জেলায় রবিবার যা ঘটে গেল তা নির্মমতায় অতীতের সমস্ত নজির ছাপিয়ে গেছে। কৃষকরা কেন্দ্রীয় গৃহ প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র এবং রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব মৌর্য'র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য জড়ো হয়েছিলেন। দুটি এসইউভি উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো জনতার ওপর হামলে পড়ে, যার ফলে নয় জন নিহত হন। এঁদের মধ্যে চারজন কৃষক ও একজন সাংবাদিক আছেন। অভিযোগ, একটি গাড়ি কেন্দ্রীয় গৃহ প্রতিমন্ত্রীর পুত্র আশিস মিশ্র নিজেই চালাচ্ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।   

গত কয়েক মাস ধরেই দেখা যাচ্ছিল যে বিজেপি সারা উত্তর ভারতে ক্রমশ মারমুখি ও আগ্রাসী হয়ে উঠছে। কৃষক আন্দোলনের শুরু থেকেই বিজেপি সরকার এই আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য দ্বিমুখি রাস্তা অবলম্বন করেছে এবং কিষাণ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ হয়ে যাবার পর তারা তা আরও সক্রিয় ভাবে অনুশীলন করা শুরু করেছে। তারা একদিকে খালিস্তানি, পাকিস্তানি, সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি তকমা দিয়ে আন্দোলনকে কলঙ্কিত করা ও অন্যদিকে লাগাতার প্ররোচণামূলক প্রচার ও নানা ছলচাতুরি করে কৃষকদের হিংসাত্মক করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এর আগে আমরা দেখেছি, পুলিস কী নির্মম ভাবে হরিয়ানার কার্নালে আন্দোলনকারীদের ওপরে লাঠিচার্জ করে। একজন কৃষক সেই আক্রমণে মারা যান, বহু কৃষক রক্তাক্ত হন। ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ'এও বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদকারীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, রটনা হয়েছে যে তাঁরা বলপূর্বক বনধ সফল করার চেষ্টা করেছেন। বনধের দিন প্রধানমন্ত্রী ‘ডিজিটাল হেলথ মিশন’ উদ্বোধন করলেন কিন্তু কৃষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে একটি কথাও বললেন না। কয়েকদিন বাদেই বললেন, বিরোধীরা কৃষকদের বিপথগামী করছে; যেন কৃষক নেতৃত্ব এতই দুর্বল ও নাদান যে তাঁরা অন্যদের দ্বারা চালিত হবেন। এমনকি মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, যারা এতদিন এই আন্দোলন সম্পর্কে বিরূপ কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে, তারা হঠাৎ বলে বসল যে কৃষি আইনগুলির ওপর তো স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়ে গেছে, তবুও কেন আন্দোলন চলছে। রাস্তা আটকে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য তারা কৃষক নেতৃত্বের নিন্দাও করল। 

হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার স্বয়ং তাঁর দলের কর্মীদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানালেন। এটা অভূতপূর্ব এবং অকল্পনীয় যে, কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চেয়ার থেকে এই ধরনের সহিংস প্রত্যাঘাত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। আন্দোলন মোকাবিলা করার জন্য তিনি কর্মীদের পরামর্শ দিলেন নিজেদের মধ্যে দল তৈরি করতে এবং লাঠি সহ অন্যান্য হাতিয়ার তুলে নিতে। তিনি তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, এর জন্য তাঁদের মার খেতে হতে পারে, জেল যেতে হতে পারে, একই সাথে এই অভিজ্ঞতার ফলে তাঁরা বড় নেতাও হয়ে উঠতে পারেন। লক্ষ্যণীয়, মুখ্যমন্ত্রী খাট্টারের এই উস্কানিমূলক বক্তব্যই অজয় মিশ্রকে বলতে প্ররোচিত করে যে এই কৃষকরা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী নাকি তাঁদেরই দিকে। প্রধানমন্ত্রী চুপ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক চুপ। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি হিংসার একটা আদ্যোপান্ত আখ্যান। না হলে গান্ধীর জন্মদিবসে যখন নাথুরাম গডসে ট্যুইটারে ট্রেন্ডিং হচ্ছে তখনও অধুনা 'গান্ধী-ভক্ত' এই নেতারা সেটা বন্ধ করার জন্য কোনও উদ্যোগ নিলেন না! অসমে মরা লাশের ওপর যখন নৃত্য করা হল তখনও কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিবাদ করার কোনও প্রয়োজন বোধ করল না! 

ঘটনা ঘটে যাবার পর আদিত্যনাথ এখন সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। পুরো উত্তরপ্রদেশ অবরুদ্ধ, একটা জেলখানার মতো। রাজনৈতিক দলের কোনও নেতা-নেত্রীকে লখিমপুর খেরিতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। শাসক বলছে, বিরোধীদের এখানে রাজনৈতিক পর্যটন করতে আসতে দেওয়া হবে না। প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে সিতাপুর নামক জায়গায় আটকে দেওয়া হয়েছে এবং একটি গেস্ট হাউসে বন্দী করে রাখা হয়েছে। পঞ্জাবের উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবির সিং রণধাওয়াকে রাজ্যের সীমান্তে আটকে দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র বাঘেলকে লখনউ বিমানবন্দরে নামতেই দেওয়া হয়নি। সমাজবাদী দলের নেতা অখিলেশ যাদবকে তাঁর বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। 

কিন্তু বিজেপি জানে যে এই বিরোধী দলগুলি কোনও সমস্যা নয়। ফেব্রুয়ারির বিধানসভা নির্বাচনে এসপি, বিএসপি, কংগ্রেস কেউ তাদের প্রতিপক্ষ নয়, তাদের আসল প্রতিপক্ষ কৃষক আন্দোলন। এটা নিশ্চিত যে কৃষক নেতৃত্ব উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনেও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচার করবেন এবং সে ক্ষেত্রে মানুষ যদি বাংলার ভোটারদের মতো বিচক্ষণতা দেখান এবং বিজেপির সবচেয়ে শক্তিশালী যে প্রতিপক্ষ তাকেই ভোট দেন তাহলে লখনউয়ের মসনদে বিজেপির প্রত্যাবর্তন আটকে তো যাবেই, দু' বছর বাদে কেন্দ্রেও তারা সরকার গড়তে পারবে কিনা তা অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

লখিমপুর খেরি'তে কৃষক হত্যার বিরুদ্ধে কলকাতায় জনবিক্ষোভ
 

আট বছর আগে মুজফরনগরে দাঙ্গা বাঁধিয়ে, হিন্দু ভোট এককাট্টা করে তারা হেলায় ২০১৪ ও ২০১৭'র নির্বাচন জিতে গিয়েছিল। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের ফলে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে এখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অটুট। রাজ্যের পূর্ব প্রান্তেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিজেপি এখন রীতিমতো বিপাকে। তাই রাকেশ টিকায়েতকে পাশে বসিয়ে পুলিস প্রশাসন নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রথমত, একজন অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত হবে। দ্বিতীয়ত, নিহতদের পরিবারকে ৪৫ লক্ষ টাকা ও আহতদের দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং নিহতদের পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। আদিত্যনাথ নিজে ঘোষণা করেছেন যে যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি কি পার পেয়ে যাবে! সবাই জানে যে কৃষক আন্দোলন থামবে না, রাকেশ টিকায়েত বলেই দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে তা আরও দশ বছর চলবে। আর আন্দোলন যদি জারি থাকে তাহলে বিজেপি'র ক্ষমতার পথ কন্টকিত, দুর্গম। সুতরাং, সংঘাত অনিবার্য। বিজেপি'র পক্ষ থেকে আগামী দিনে হিংসা আরও বাড়বে, আরও রক্ত ঝরবে। উত্তরপ্রদেশের আমজনতা নিশ্চয়ই তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।


1 comment:

  1. উত্তরপ্রদেশে ভোট জাতপাতের ভিত্তিতেই হবে এবং বিজেপি অমিত শাহের social engineering এর উপর ভিত্তি করে আবারও জিতে আসবে। পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত ভিত্তিক বা আইডেন্টিটি ভিত্তিক রাজনীতি বহুকাল অতি দুর্বল ছিল। তাই বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি। অর্থনৈতিক ইস্যু ভোটে কোন প্রভাব ফেলবে না। নির্বাচনের আগে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী মিডিয়াকুলকে ব্যবহার করে তিলকে তাল করা হবে, অদ্ভুত অদ্ভুত ইলেকশন ইস্যু উঠে আসবে যেগুলো আসল ইস্যুগুলো থেকে মানুষের মন ঘুরিয়ে দেবে।

    ReplyDelete