Sunday 10 October 2021

নোবেল কমিটি পথ দেখাল

বিশ্ব উষ্ণায়ন সমস্যার স্বীকৃতি

শোভনলাল চক্রবর্তী


এ বছর পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে নোবেল কমিটির তরফে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাকে আগামী দিনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি যে নতুন এমন নয়। এর আগেও বহু বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পরিবেশ কর্মী এই বিষয়ে বিপদঘন্টি বাজিয়েছেন, কিন্তু দুনিয়া জুড়ে রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ নির্বিকার। খাতায় কলমে বেশ কিছু কাজ চলছে সারা বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু তার কোনও প্রত্যক্ষ ফলাফল আমরা প্রকাশ্যে দেখতে পাইনি। নোবেল কমিটি এবার এগিয়ে এল এবং পুরস্কৃত করল এমন তিনজনের কাজকে যাঁরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যায়। 

'বাটারফ্লাই এফেক্ট' কথাটা আজ অনেকেই শুনেছেন। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা বোঝাতে ব্যবহৃত হয় শব্দবন্ধটি। অর্থাৎ, প্রকৃতি এতটাই খামখেয়ালি যে, নিউ ইয়র্কে একটি প্রজাপতির ডানা নাড়ার ফলে হয়তো ঝড় উঠে গেল বেজিং শহরে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে সব ঘটনা কোনও নির্দিষ্ট ছক মেনে চলে, তাকে গণনার মধ্যে আনা তুলনামূলক ভাবে সহজ। কিন্তু যে সব ঘটনা ছকভাঙা, তাদের ক্ষেত্রে কী উপায়? এই ছক ভাঙা ব্যবস্থা বোঝাতেই বিজ্ঞানীরা 'বাটারফ্লাই এফেক্ট' উপমাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালে উপমাটি ব্যবহার করা হয় এটা বোঝাতে যে, শুরুতে যদি একটা ছোট্ট ভুল হয়ে যায় তবে পরে শেষ ফলাফলে বড় ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমরা যাকে বলি তিল থেকে তাল, অনেকটা তাই। 

বিজ্ঞানীরা একমত যে আপাত ভাবে যে জিনিসটা দেখে মনে হচ্ছে ছক ভাঙা, আসলে তার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে একটা ছক। এই পথ ধরেই বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ ঘটে 'ক্যাওস থিওরি' বা 'বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি তত্ত্বের'। এই তত্ত্ব যে দুটি ক্ষেত্রে সফল ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে সেগুলি হল- আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং স্টক মার্কেট'এর শেয়ারের দাম ওঠাপড়ার ব্যাখ্যায়। জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি তাকে গণিতের আওতায় আনতে সফল হয়েছেন সিউকুরো মানাবে ও ক্লাউস হাসেলমান। আবার পরমাণু পর্যায় থেকে গ্রহের বিশাল মাপের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে কীভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যুক্ত হয়ে থাকে- তার পুঙ্খানুপুঙ্খ গাণিতিক হিসেব-নিকেশ দিয়েছেন জিওর্জিও পারিসি। 

এই আবিষ্কারগুলির জন্যই এই তিন বিজ্ঞানীকে এবার পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। এবারের পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে নোবেল কমিটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে বিশ্ব উষ্ণায়ন এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে এ সব নিয়েই কাজ করেছেন এই তিন বিজ্ঞানী। এমন একটা সময়ে পুরস্কার দেওয়া হল, যখন অনেক রাষ্ট্রই এই সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। 

জাপানে জন্ম হলেও সিউকুরো মানাবে বর্তমানে আমেরিকার বাসিন্দা, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী। তাঁর বয়স নব্বই বছর। নব্বই পেরিয়ে নোবেল জয়ের নজির খুব বেশি নেই। এবারের তিন বিজয়ীর মধ্যে অর্ধেক পুরস্কার মূল্য পাবেন রোমের সাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকারী অধ্যাপক জিওর্জিও পারিসি। পারিসি'কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে, কারণ, তাঁর গবেষণার কাজ অতিক্রম করেছে পদার্থবিদ্যার চেনা গণ্ডি। পারিসি'র গবেষণা যে কোনও জটিল বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে, তা সে জীববিদ্যা হোক বা মেশিন লার্নিং কিংবা গণিত অথবা স্নায়ুবিদ্যা। 

সেই ছয়ের দশকে সিউকুরো মানাবে দেখিয়েছিলেন, বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন-ডাই-অক্সাইড'এর মাত্রা বাড়লে কীভাবে ভবিষ্যতে বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়বে। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি পৃথিবী থেকে তাপ বিকিরণের ভারসাম্য ও বায়ুর উল্লম্ভ তলে তাপ পরিবহনের মধ্যে সঠিক সম্পর্ক গাণিতিক ভাবে নির্ণয় করেন। মানাবে যখন এই কাজ করছেন তখন তিনি ছিলেন পরিবেশ বিজ্ঞানের একলা পথের পথিক। কারণ, তখন পদার্থবিদ্যার আসল মুগ্ধতা কণা তত্ত্ব ও জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ঘিরে। সেই সময় আপেক্ষিকতা বাদ দিয়ে কোনও বিজ্ঞানী কাজ করলে তাঁদের ঠিক জাতের বিজ্ঞানী বলে বিজ্ঞান মহল মেনে নিত না। বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নামের তালিকা এবং তাঁদের কর্মক্ষেত্র এর সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য বহন করছে। বিশ শতকের শেষের দিকে যখন পরিবেশ বিজ্ঞান জাতে উঠল, তখন মানাবে'র গণিতের ভিত্তিতে আধুনিক সব পরিবেশ মডেল তৈরি হতে থাকে বিশ্বের নানান প্রান্তে। 

এবারের পদার্থবিদ্যার নোবেলের তৃতীয় বিজয়ী ক্লাউস হাসেলমানের কর্মক্ষেত্র জার্মানির হামবুর্গ শহরের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর মেটিওরোলজি। আবহাওয়া দ্রুত বদলালেও কেন নির্ভর করা যায় পরিবেশ মডেলগুলোর উপর, তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন হাসেলমান। প্রাকৃতিক ঘটনা এবং মানুষের নানা কাজের ফল কীভাবে জলবায়ুর উপর প্রভাব ফেলে, আর তার থেকেও বড় কথা, কীভাবে তা চেনা যায়, সেই পথ বাতলেছিলেন এই জার্মান বিজ্ঞানী। তখন মানুষের সময় হয়নি সেই সব কথা মন দিয়ে শোনার। আজ যখন পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ বদলের প্রভাব শুরু হয়ে গেছে তখন এই সব প্রান্তিক বিজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর শুনতে মানুষ এবং অবশ্যই নোবেল কমিটি বাধ্য হয়েছে। নোবেল কমিটির প্রধান থর্স হান্স হানসন বলেছেন যে, এই তিনজনের আবিষ্কার থেকে জানা যায় পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে আমরা যা জানি, তা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। ভাগ্যিস বললেন, এত দিন মানুষের মনে আবহাওয়াবিদদের সম্পর্কে ধারণা ছিল যে এঁরা যা বলেন তার উলটোটাই ঘটে। সেটার কারণ এই যে, জলবায়ু এতটাই বিশৃঙ্খল একটা ব্যবস্থা যার সঠিক পূর্বাভাসের জন্য চাই- উপগ্রহ যে ছবি বা বার্তা দিচ্ছে তার দ্রুত বিচার করে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তা সাধারণ মানুষকে জানানো। এই কাজে সহায়ক দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজ করতে পারা সুপার কম্পিউটার, যার যোগ্য উত্তরাধিকারী বাইনারি কম্পিউটার। 

আমেরিকায় পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্য ব্যবহৃত হয় ১২২টি সুপার কম্পিউটার, চিন ব্যবহার করে ১৮৮টি, আর ভারত? আন্দাজ করতে গিয়ে ঠকতে হতে পারে- মাত্র তিনটি। এরপরের বার হাওয়া ভবনের পাঠানো ঝড় বৃষ্টির নির্দেশিকা নিয়ে হাসাহাসি করার আগে এই তথ্যটা মাথায় রাখবেন। মাত্র তিনটি সুপার কম্পিউটার নিয়ে আমাদের দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা যে কাজ করছেন তাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। বিশ্ব উষ্ণায়নের দিকে চোখ ফেরাতে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে যদি সাধারণ মানুষ সচেতন হন, তবে এবারের পদার্থবিদ্যার নোবেল প্রাপকদের নাম ইতিহাস হবে। এঁরা কিন্তু অনেকদিন ধরে বলে আসছেন যে শেষের সে দিন আর খুব দূরে নয়, তবুও কারও কোনও হেলদোল নেই। এবার যদি রাষ্ট্রনেতাদের কানে কিছু জল ঢোকে। দেখা যাক।


No comments:

Post a Comment