Wednesday 27 October 2021

স্থান ও বস্তুসমূহ

চার শিল্পীর আলোকচিত্র

তন্ময় সাঁতরা

কোনও নির্দিষ্ট একটি স্থানের সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিকের একটা যোগ থাকে। যোগ থাকে কত না কথা কাহিনির। তেমনি কোনও স্থানকে একটি বিশেষ মুহূর্তে কোন আলোকচিত্রী যখন ক‍্যামেরাবন্দি করেন, বা বলা চলে ছবি হিসেবে ধরে ফেলেন, তার গল্প বলার সম্ভাবনা বোধকরি আরও দু'-কদম এগিয়ে যায়। তখন সেই আলোকচিত্রটি কেবল সেই স্থানটির প্রতিলিপি মাত্র আর থাকে না। ভবিষ্যতে দর্শকদের চোখে তার অর্থ আর দ্যোতনাগুলি আরও নতুন পথে পা বাড়ানোর দিকে এগিয়ে যায়। সেই আলোকচিত্র বা ছবিটি হয়ে উঠতেই পারে 'পলিসেমিক', একাধিক অর্থের বাহক। কিংবা 'ইকুইভোকাল', একেবারে অনিশ্চিত অর্থদ্যোতক। যেখানে তার একটি মাত্র নিশ্চিত অর্থ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছবিটির মহিমা তাতে বাড়ে বই কমে না।

তেমনি কোনও বস্তুর আলোকচিত্র। স্থির বস্তু- সে সাজিয়ে রেখে তোলা হোক, কিংবা তার স্বাভাবিক অবস্থানেই তাকে ক‌্যামেরাবন্দি করে ফেলা হোক, তা কেবল বস্তুটির প্রতিলিপি মাত্র হতে পারে না। আলোছায়া, সংস্থাপনা ও পরিবেশনার গুণে সেই ছবি বহু-অর্থদ‍্যোতক, কাব‍্যিক, কিংবা পরোক্ষ উপমাব‍্যঞ্জক হয়ে উঠতে পারে। আলোকচিত্রে কাব্যসুষমা, রূপালঙ্কার ও অর্থব‍্যঞ্জনা প্রকাশের কথা মনে করলে অনেক বরেণ্য আলোকচিত্রীর কথা মাথায় আসে। ওয়াকার এভান্স, ম‍্যান রে, আনসেল আ্যডামস। হেনরি কার্তিয়ে ব্রেসঁ। 

এখানে চারজন শিল্পীর ফটোগ্রাফিক ওয়ার্ক বা আলোকচিত্রের চর্চা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনার পরিসর গড়ে তোলা হল। প্রথমজন প্রবন্ধকার নিজেই; এবং চারজনেই মূলত চিত্রশিল্পী। বলা বাহুল্য, চিত্রশিল্পীকৃত আলোকচিত্র মানে যে কথাটা প্রথমে মাথায় আসে তা হল, শিল্পীর কাছে এটি আরেকটি মাধ্যম মাত্র। ক্যামেরা যন্ত্রটির ব্যবহার করে ছবি আঁকার প্রয়াস করা। আঁকাজোকার একটা প্রসারণ ঘটে এতে সন্দেহ নেই। দেখা যায়, পেইন্টিং এবং ফটোগ্রাফি সে ক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক। এ কথাটি বলতেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।

 


আমার হাতে প্রথম এস এল আর ক‍্যামেরা আসে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আর্ট কলেজের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ক‍্যামেরা হাতে পেয়েই (কিনেই) এটা-সেটার ছবি তোলার ঝোঁক। ল‍্যান্ডস্কেপ, বইমেলার ভিড়, স্টুডিওর আনাচ-কানাচ। সমুদ্র, পাহাড়, বন। কত হাবিজাবি ও দরকারি জিনিসের ছবি উঠল তার ঠিক নেই। ফিল্ম-ক‍্যামেরার যুগে প্রিন্ট নিয়ে দেখবার উৎসাহের সীমা থাকত না। তারপর ভাল প্রিন্টগুলি বেছে রেখে দেওয়া। এখন ডিজিটাল ক‍্যামেরা ও তথ্য-প্রযুক্তির অগ্ৰগতির যুগে ক‍্যামেরায় এবং কম্পিউটারে ফটোগ্ৰাফের গুণাগুণ দেখে নেওয়ার অবাধ সুযোগ। এডিট করার পর সঠিক বা ভাল ইমেজটি নিয়ে বাকিগুলি মুছে ফেলা যায়। যত না রাখা হল, বাদ দেওয়া হল তার অনেক গুণ। এভাবেই শেখা, এভাবেই পথ চলা।


ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজনে বিভিন্ন ঘটনাবলী ও কার্যক্রমের ছবি তুললেও, মনের মতো বিষয় হিসেবে আসে বিস্তৃত ল্যান্ডস্কেপ বা প্রায় নির্জন গৃহকোণ। জানালা। বাইরের জগৎ এবং গৃহ পরিসরের মাঝখানটিতে থেকে যা হয়ে উঠতে পারে 'দেখার' মেটাফর। একটি ইমেজ। দ্রুত বদলে যাওয়া শহরাঞ্চল বা শহরতলির ছবি আঁকছি বেশ কিছুকাল ধরে। সে কাজে আমার ফটোগ্রাফি চর্চার একটা বিশেষ অবদান রয়েছে। আলোকচিত্রের রেফারেন্স আমার চিত্রকলার চর্চায় বিশেষ কাজে লাগে। এই কাজে লাগার বাইরেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পাই। যখন বুঝি ফটোগ্রাফ হিসেবেও এর অস্তিত্ব যথেষ্ট যুতসই। কন্সট্রাকশন সাইটের এরকম অনেক ফটোগ্রাফ তাই আমার ঝুলিতে জমতে থাকে। সেখানে মূল সুর 'নির্মাণ'। দ্রুত পরিবর্তমান জগৎ।



ঋতম নন্দীর শিক্ষা-দীক্ষা চিত্রকলায়। তারপর কর্মসূত্রে সে ডিজাইনার। ক্যামেরার প্রতি ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই। তবে বিগত ৪-৫ বছরে তার ফটোগ্রাফির চর্চা আরও প্রগাঢ় হয়েছে। চিত্রকলা ও ডিজাইনের পাশাপাশি আলোকচিত্র আরেকটি মাধ্যম হিসেবেই এসেছে; তার চর্চার প্রাঙ্গণকে প্রসারিত করেছে। বাস্তব তথ্যভিত্তিক আলোকচিত্র রচনাই মূল অভিপ্রায়। ছবি বা ফটোগ্রাফি হয়ে ওঠে একটা স্থান ও সময়ের দলিল। আবার কেবল প্রামাণ্য তথ্যের সাক্ষ্য দেওয়ার বাইরেও কখনও কখনও এর একটা বিস্তার ঘটে যায়। যখন তার আরও আরও অর্থব্যঞ্জনা তৈরি হয়। নতুন গল্পের আঙিনায় সঞ্চরণ ঘটে যায়।


ধানবাদ কয়লাখনি অঞ্চলে তোলা তার একটি সিরিজের কথায় আসা যাক। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি খনির পরিত্যক্ত অফিস। ভগ্ন একটি বাড়ির কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে। জনমানবহীন এই পোড়ো বাড়িটি মনে করিয়ে দিচ্ছে তার অতীতের কোলাহল-মুখর ও গৌরবপূর্ণ ইতিহাসের কথা। সেখানে এখন কেবলই ধূসর পাণ্ডুলিপির নীরব পাতাগুলি। বাকি দু-একটি ছবিতে সেই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও তাৎপর্যপূর্ণ নৈঃশব্দ।


 


এস বি অভিরাগের আলোকচিত্রেও এক তাৎপর্যপূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। ওর পেইন্টিং-এর মতো। বিষয় হিসেবে উঠে আসে বিল্ডিং, করিডোর, নির্জন গৃহ পরিসর। আর তার বেশিরভাগটাই সাদা-কালো। সাদা-কালো বা মনোক্রোমে বক্তব্য যেন আরও বেশি জোরদার হয়েছে।


এমনি একটি আলোকচিত্রে ধরা হয়েছে পরিত্যক্ত একটি পার্কের শিশুদের খেলার জায়গাটি। অতীতের অনেক স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকা খেলার জায়গা। স্থির, বিচ্ছিন্ন, নস্ট্যালজিক। কোলাহলের নাম মাত্র নেই।

 


অনির্বাণ মিশ্র'র ছবি তোলার অভ্যাস ছাত্রজীবন থেকেই। বিভিন্ন বিষয়ে ছবি তোলায় তার আগ্রহ ও অনুরাগ। বিল্ডিং, ল্যান্ডস্কেপ থেকে শুরু করে ফুল পাতার অনুপুঙ্খের প্রতিও তার নজর। এমনই একটি আলোকচিত্রে দেখা যায় একটি ফুলের গুচ্ছ মনোক্রমের আওতায় এসে আরও বেশি প্রকাশব্যঞ্জনা পেয়েছে। হয়ে উঠেছে ফুলের মনোময় প্রতিকৃতি।

 

 




 


No comments:

Post a Comment