একের পর এক কন্ঠরোধ করা হচ্ছে
সোমনাথ গুহ
সত্তরের দশকে মিলিটারি স্কুলগুলিতে ভারত-চিন যুদ্ধের ওপর একটি মোটা বই ছাত্রদের হাতে দেখা যেত। বইটির নাম ‘দ্য হিমালয়ান ব্লান্ডার’, লেখক ব্রিগেডিয়ার জন দালভি। ব্রিগেডিয়ার তৎকালীন নেফাতে সপ্তম ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন, যে ব্রিগেড চিনা আক্রমণে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং তিনি নিজে যুদ্ধবন্দী হন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ঐ যুদ্ধে ভারতীয় সেনার লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তুলোধোনা করেন। সেনাবাহিনী এতটাই অপ্রস্তুত ছিল যে তাঁদের যথেষ্ট শীতের পোশাক ছিল না, ব্রিগেডিয়ার লেখেন।
গত ৩১ মে কেন্দ্রীয় সরকার ‘সেন্ট্রাল সার্ভিসেস (পেনশনস) রুলস’এ যে সংশোধনী এনেছে তা এখন অবধি সরকারি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার অফিসারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেনাবাহিনীর অফিসাররা এখনও এতে অন্তর্ভুক্ত হননি। কার্গিল খ্যাত জেনারেল ভিপি মালিক আশা করেন যে অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের এই আইনের আওতায় আনা হবে না, কারণ, এই নতুন সংশোধনীতে কিছু বাড়াবাড়ি আছে এবং সেটির পুনর্বিবেচনা দরকার। যদি সেনা অফিসাররা এর অন্তর্ভুক্ত হন তাহলে ‘দ্য হিমালয়ান ব্লান্ডার’এর মতো অন্তর্তদন্তমূলক বই যাতে সেনাবাহিনীর কঙ্কালসার রূপ দেশবাসীর কাছে বেআব্রু হয়ে গিয়েছিল তা আমরা আর কখনও পাব না। সেগুলো চিরকাল সরকারি ফাইলেই বন্দী থাকবে। যেমন, নতুন সংশোধনী অনুযায়ী ভবিষ্যতে ‘রিসার্চ এন্ড অ্যান্যালাইসিস উইং’ (র)'এর প্রথম প্রধান আর এন কাওয়ের আত্মজীবনীর মতো গোয়েন্দা জগতের রোমহর্ষক কাহিনি আমরা আদৌ আর পাব কিনা সন্দেহ আছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের পেনশনের এই নিয়মাবলী ১৯৭২ সালে গঠিত এবং তারপর এর ৪৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। ২০০৮ সালের সংশোধনীতে বলা হয়, সঠিক আচরণ সাপেক্ষে পেনশন দেওয়া হবে। তাতেই দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা (কৌশলগত, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক) এবং বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বিঘ্নিত হয় এমন কিছু প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সাম্প্রতিক সংশোধনীতে কেন্দ্রীয় সরকার এই নিয়মের পরিসর আরও বৃদ্ধি করেছে- এখন চাকরিরত ব্যক্তি যে সংগঠনে ছিলেন সেটির কর্মপদ্ধতি, কোনও কর্মীর পদ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনও কিছু ব্যক্ত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে। যদি কোনও অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এইসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু লিখতে চান তাহলে তাঁকে সেই বিশেষ সরকারি বিভাগ থেকে আগাম অনুমতি নিতে হবে। তিনি উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে কোনও সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না, কোনও ধরনের সংবাদমাধ্যমে কোনও প্রতিবেদন বা প্রবন্ধ লিখতে পারবেন না, কোনও বই প্রকাশ করতে পারবেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখন প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে যদি তিনি তা করেন তাহলে তাঁর পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। এখন থেকে সরকারি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগ সহ আঠারোটি সংগঠনের অফিসারদের ফর্ম ২৬ পূরণ করা বাধ্যতামূলক যাতে তিনি অঙ্গীকার দেবেন যে সরকারের অনুমতি ছাড়া সংগঠন সংক্রান্ত কোনও তথ্য তিনি প্রকাশ করবেন না। আইবি, র ছাড়া অন্যান্য সংগঠনগুলির কয়েকটি হল সিবিআই, বিএসএফ, সিআরপিএফ, আইটিবিপি, সিআইএসএফ, ডিআরডিও ইত্যাদি। আপাতত আইএএস, আইএফএস, ক্যাগ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর অফিসার এবং অন্যান্যরা এই নতুন পেনশন নিয়মাবলীর বাইরে।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় তার জন্য তো ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ এবং ভারতীয় ফৌজদারি আইন ছিলই। নতুন করে পঞ্চাশ বছরের পুরনো আইন ইতিহাসের গর্ভ থেকে উদ্ধার করে সেটাতে একটি সংশোধনী জুড়ে দানবীয় করে তুলে চালু করার হঠাৎ এই প্রচেষ্টা কেন? ইতিপূর্বে ‘র’এর প্রধানরা তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লেখেননি এমনটা তো নয়। প্রাক্তন প্রধান বিক্রম সুদ'এর ‘দ্য আনএনন্ডিং গেম: আ ফরমার র চিফস ইনসাইটস ইন্টু এস্পায়নেজ’ বেশ সাড়া ফেলেছিল। আরেক প্রাক্তন প্রধান ও কাশ্মীর বিশেষজ্ঞ এ এস দুলাত তো আইএসআই'এর প্রধান আসাদ দুরানির সাথে যৌথ ভাবে একটি বই রচনা করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বইটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়- ‘দ্য স্পাই ক্রোনিকলস: র, আইএসআই অ্যান্ড দ্য ইল্যুশন অফ পিস’। বইটি এই দুই স্পাই মাস্টারের মধ্যে একটি কথোপকথন যাতে কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ২৬/১১'র মুম্বাই আক্রমণ, ওসামা বিন লাদেন, ভ্লাদিমির পুতিন, ডোনাল্ড ট্রাম্প, বালুচিস্তান, সার্জিকাল স্ট্রাইক সহ অনেক কিছুই আলোচনা হয়েছিল। ২০১৮'র ২৪ মে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি যৌথভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। ভারত সরকার এই অনুষ্ঠানে আসাদ দুরানিকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল। এছাড়া সরকারের দিক থেকে বইটি সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য করা হয়নি বা এ এস দুলাত'এর ওপর কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। অথচ পাকিস্তানে আসাদ দুরানি রাতারাতি খলনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন এবং ভারতের দালাল, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি তকমায় তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল। তাঁর পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অদ্ভুত ভাবে ভারত সরকার এখন পাকিস্তানের প্রদর্শিত পথেই এই আমলাদের কন্ঠরোধ করছে, বাকস্বাধীনতা হরণ করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তখনও তো বিজেপি সরকারই ক্ষমতায় ছিল! তাহলে এই দু' বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু বিপুল জনবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বা হবে যে কারণে সরকার এখন সমস্ত ধরনের সমালোচনা, ভিন্ন মতামতের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো প্রয়োজন মনে করছে। যার জন্য তারা ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে, তাদের যে কোনও পোস্টের উৎস প্রকাশ করতে বাধ্য করছে। কোনও সংবাদমাধ্যম সরকার বা প্রধানমন্ত্রী বিরোধী কোনও মন্তব্য করলেই সেটাকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। মুড়িমুড়কির মতো রাষ্ট্রদ্রোহী আইন ব্যবহার করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে ভর্ৎসনা করেছে। মহামান্য আদালত বলেছে, ভিন্ন মত পোষণ করা, সমালোচনা করা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। এর অর্থ কী? গোদি মিডিয়া সৃষ্টি করার পরও, তাদের কুখ্যাত আইটি সেলের দাপট সত্ত্বেও, সরকার তার দিকে প্লাবিত হয়ে আসা ব্যঙ্গবিদ্রুপ, উপহাস, মিম, কার্টুন ইত্যাদির জোয়ার বন্ধ করতে পারছে না, প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করতে পারছে না।
এখন তারা দেখছে, পোড় খাওয়া আমলা যাঁরা সরকারের ‘নিজস্ব’ ব্যক্তি ছিলেন, তাঁরাও ভিন্ন সুর গাইছেন। এ এস দুলাত'এর কাশ্মীর সংক্রান্ত বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ২০২০'র ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, শুধুমাত্র আল্লাই জানেন কাশ্মীরে কী হচ্ছে! এবং দিল্লিরও এই নিয়ে চিন্তাভাবনা কী তা কারও ধারণা নেই। তিনি বলছেন, কাশ্মীরের সাথে দিল্লির সব সময় সমস্যা ছিল, কিন্তু ভারতের মানুষের সাথে তাঁদের কোনও সমস্যা ছিল না। আমাদের ভাবতে হবে, কেন এখন কাশ্মীরের মানুষ বনাম ভারতের মানুষ হয়ে গেছে যখন বাস্তবে কাশ্মীরিরাও ভারতীয়? কাশ্মীর শুধুমাত্র একটা নিরাপত্তাজনিত বিষয় নয়, এটা একটা রাজনৈতিক, আবেগ জড়িত বিষয়, তিনি যোগ করেন। দুলাত বলেছেন, জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি কোনও লেখার জন্য কারও কাছে অনুমতি চাইতে যাবেন না। দরকার হলে তিনি ইতিহাস লিখবেন, ফিকশন লিখবেন, কবিতা লিখবেন, কে আটকাবে তাঁকে?
লাক্ষাদ্বীপের তথাকথিত উন্নয়নের বিরোধিতা করে যে নব্বই জন আমলা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন, তার মধ্যে তো ভূতপূর্ব জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের নাম আছে। তাহলে এই নতুন সংশোধনীর ফলে তিনি কি এই ধরনের আর কোনও প্রতিবাদ করতে পারবেন না? সরকারি মহলে শ্রদ্ধেয় এম কে নারায়ণন (প্রাক্তন আইবি প্রধান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব রাজ্যপাল)- তিনি তো 'হিন্দু' পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এবং সেগুলো যে সরকারের খুব সুখ্যাতি করে এমনটা নয়। যেমন ২০২০'র বছর শেষে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন যে এমন একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে যে ভারত ক্রমশ একটা ‘ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্র’ হয়ে যাচ্ছে, সরকার এই অবনতি সম্পর্কে অবহিত আছে? ২১ মে'র নিবন্ধে লিখছেন, এই অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণ এবং গণতন্ত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য শাসকবর্গের যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন। তো ইনি কি প্রতিটি লেখার জন্য সরকারের কাছে অনুমতির জন্য ছুটবেন?
সরকার কী এত লুকোতে চাইছে? এমন কী গুরুত্বপূর্ণ যার জন্য প্রাক্তন বাবুদের জীবিকা ধরে টান দিতে হচ্ছে? আলমারিতে কি প্রচুর কঙ্কাল চাপা দেওয়া আছে (Too many skeletons in the cupboard)? পুলওয়ামা কান্ডে কি কোনও ঘাপলা আছে, বা বালাকোট স্ট্রাইকে? ধারা ৩৭০ কাশ্মীর থেকে তুলে নেওয়ার পর সেখানে মানুষের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা অতি উচ্চপদস্থ হাতে গোনা দু' চারজন গোয়েন্দা ও সেনা অফিসাররা ছাড়া কেউ কিছু জানেন না। নাকি সরকার আগামী দিনে এমন কিছু ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনা করছে যেটা প্রকাশ্যে এলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যাবে? সরকার কি সিঁদুরে মেঘ দেখছে তাই সম্ভাব্য সমস্ত তথ্য নিষ্ক্রমণের জায়গাগুলো রুদ্ধ করে দিতে চাইছে? এরপর যদি আইএএস, আইপিএস, সেনা অফিসারদের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয় তাহলে তো হর্ষ মান্দার, জুলিও রিবেরিও, অ্যাডমিরাল এল রামদাস যাঁরা সরকারি নানা কুকীর্তির বিরুদ্ধে সরব এবং সক্রিয়, তাঁদের তো কণ্ঠরুদ্ধ করে দেওয়া হবে।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিরোধী দলগুলি এইসব স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে খালি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েই খালাস। কোভিড বিধি মেনেও তো রাজধানীতে কিছু প্রতিবাদ সংঘটিত করা যায়। সরকার ঘুঁটি সাজাচ্ছে, বিরোধীদের কিন্তু এখন ‘ক্যাচ আপ’ খেলা বন্ধ করতে হবে।
খুব প্রাসঙ্গিক লেখা। ভারতে কি তবে এবার ম্যাকার্থিবাদের উত্থান আসন্ন? সাধু সাবধান। মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
ReplyDeleteঅতি উপাদেয় নিবন্ধ। স্বল্পবচনে কত বাঙ্ময়।
ReplyDelete🕹️
ReplyDeleteখুব ভালো লেখা । সরকার তো অপরাধ করেই যাচ্ছে সেই কারণেই তো ভয় পাচ্ছে আর তাদের এই ভয় থেকেই এইসব সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে । ভয়ের আমি ভয়ের তুমি ভয় দিয়ে যায় চেনা !!!!!!!! 😲 সমাজের সর্বস্তর থেকে সম্মিলিত জোরদার প্রতিবাদ দরকার এর বিরুদ্ধে ।