Sunday, 6 June 2021

পরিবেশের কথা

জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ 

ও কোভিডের ত্র্যহস্পর্শ 

শোভনলাল চক্রবর্তী


২০১৫-র প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানোর ব্যাপারে গুটিকয়েক মাতব্বর দেশ ঠিকা নিয়েছিল। তারাই আগ বাড়িয়ে 'নেট জিরো এমিশন'-এ পৌঁছনোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। যেমন, আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০৫০ সালে, চিন ২০৬০ সালে। ইউরোপের ৫০০টি বিমানবন্দর 'নেট জিরো এমিশন'-এ পৌঁছতে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করেছিল। যে পরিমাণ যাত্রী সারা বছর ধরে ওই বিমানবন্দরে যাতায়াত করেন তাতে মাত্র ২ শতাংশ এমিশনে লাগাম পরানো যাবে বলে স্থির হয়েছিল। 

আসলে, পরিবেশ সংক্রান্ত পেল্লায় প্রতিশ্রুতির গোটাটাই ছিল অন্তঃসারশূন্য। কোভিডের মৃত্যু মিছিলে সেই সত্যই সোচ্চারে প্রতিষ্ঠিত। ভারতের দিকে তাকালে অবস্থা আরও ভয়াবহ। ২০১৯-এ এই দেশে ১৬ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন স্রেফ বায়ু দূষনের কারণে। ভারতের মোট মৃত্যুর ১৭.৮ শতাংশ মৃত্যুর কারণ বায়ু দূষণ। অধিকাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা পিএম ২.৫ এবং ওজোন দূষণ যার বৃদ্ধি বর্তমানে ১৩৯.২ শতাংশ! বায়ু দূষণ জনিত অকালমৃত্যু, অসুস্থতা বা বিকলাঙ্গতার কারণে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৬.৮ বিলিয়ন ডলার। বেলাগাম বায়ু দূষণের প্রাবল্যেই ২০২৪ সালে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দিবাস্বপ্ন পরিণত হতে পারে দুঃস্বপ্নে। দূষণ কমাতে পারলে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতেও বইত সুপবন। বায়ু দূষণ ঠেকাতে ১৯৭০ সাল থেকেই আমেরিকা কোমর বেঁধে নেমেছিল। আজ হিসেব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ উন্নয়নে প্রতি ১ ডলার  বিনিয়োগে আমেরিকা ৩০ ডলারের সুফল ঘরে তুলেছে। স্রেফ সিসা মুক্ত গ্যাসোলিন ব্যবহারেই শিশুদের রক্তে সিসা জনিত দূষণ কমায় লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে শিশুদের আই-কিউ, বেড়েছে উৎপাদনশীলতা। অর্থনীতির উজ্জীবন ঘটেছে। 

ভারত ১৯৮৪ সালে দূষণ নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসে এবং স্থাপন করে 'দ্য ন্যাশনাল এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং প্রোগ্রাম'। ২৯টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ৩৩৯টি শহরের ৭৭৯টি কেন্দ্রের মাধ্যমে আজ বাতাসের গুণমান নির্ণীত হয়। বাড়ির ভেতরের দূষণ কমাতে ২০১৪ সালে তৈরি হয় 'উন্নত চুলা অভিযান'। ২০১৫-এ শহরবাসীর ফুসফুসকে চাঙ্গা করতে চালু হল 'স্মার্ট সিটি মিশন'। ২০১৬-তে 'প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা'। ২০১৯-এ 'দ্য ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম'-এ ১০২টি শহরে ভাসমান ধূলিকণার মাত্রা ২০২৪ সালের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছিল। মোদিজির সব গজদন্তমিনারি প্রকল্পের মতোই অধিকাংশ পরিবেশ প্রকল্পই জন্মের প্রথম শুভক্ষণেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে হরিনাম সংকীর্তন শুরু করে। গোটা বিশ্বে আজও তাই ওজোন ও অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণাজাত দূষণে সবার ওপরে ভারত। 

'উজ্জ্বলা যোজনা'-র সিলিন্ডার পিছু এক ধাক্কায় ১২৫ টাকা দাম বাড়ায় ৮৬ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবার গ্যাসের সিলিন্ডার কিনতে না পেরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন কাঠ বা কয়লা-ঘুঁটের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ঘাতক চুলায়। অদূরদর্শিতা, পরিকল্পনাহীনতা, সস্তা হাততালি কুড়োনোর অভিলাষ আর পেশাদারিত্বের অভাবেই বিপর্যস্ত পরিবেশ সংক্রান্ত প্রায় সব প্রকল্প। বায়ু দূষণ শুধু মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি করে তাইই নয়, বায়ু দূষণে ফোঁপরা হতে থাকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও দক্ষতা। মানবসম্পদের অপূরণীয় অপচয়ে দেশের সামুদয়িক উন্নয়নে হয় কুঠারাঘাত। বায়ু দূষণে কোভিডের তুলনায় মৃত্যু হার ১৩ গুন বেশি। 

আসলে অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণা পিএম ২.৫-এর ঘাড়ে চেপেই সার্স কোভ-টু ড্রপলেটের মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বায়ু দূষণ বা আরও স্পষ্ট করে বললে, পিএম ২.৫-এর সৌজন্যেই ভারতবাসীর ফুসফুসের অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সারা বিশ্বের তুলনায় ভারতের কোভিড রোগীদের তাই সবচেয়ে বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে। ভারতে বায়ুতে মাত্র ১ শতাংশ পিএম ২.৫ -এর বৃদ্ধি কোভিডের মৃত্যুহারকে বাড়াচ্ছে ৫.৭ শতাংশ, ৪০ থেকে ৬৯ বছর বয়সের মানুষের অন্ধত্ব বাড়াচ্ছে ৮ শতাংশ এবং গ্লুকোমা রোগীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে ১২ শতাংশ। ২০২০ লকডাউনের সময় কলকাতার বাতাসের প্রতি ঘন মিটারে ভাসমান পিএম ২.৫ ছিল সর্বনিম্ন ১৬.৮৬ মাইক্রোগ্রাম এবং সর্বোচ্চ ৪২.৮২ মাইক্রোগ্রাম, যখন হু'র সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রাম। 

লকডাউনের সময় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে ওজোনের পরিমাণ। লকডাউনের সময়ে হয়তো কোভিড সংক্রমণ কমেছে কিন্তু বেকার হয়ে যাওয়া মানুষের কাঠ কয়লার আগুনের রান্নার কারণে প্রাণঘাতী বায়ু দূষণকে তালাবন্দি করা যায়নি। ভ্যাকসিনে কোভিডকে নিরস্ত্র করা গেলেও, বায়ু দূষণ কীভাবে কমবে তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। কলকাতার বায়ু দূষণ কমানোর জন্য অনেকেই বিভিন্ন রকম বৃক্ষরোপণের ওপর জোর দিতে বলেছেন। গাছ লাগানোর সময় যে সব গাছ লাগানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বট, পেয়ারা, আম, জবা, কদম, করবী, নিম, ভেরেন্ডা এবং ইউক্যালিপটাস। কলকাতার ফুটপাথে পাকা পেয়ারায় বা কদম ফুলে পা পিছলে পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে। কলকাতার ফাঁকা মাঠে বা পার্কে বট বা পিপুল গাছ লাগানো যেতে পারে অবশ্যই, তবে পার্ক বা বড় মাঠ দুটোই এখন কলকাতায় অতীত। নিম, ছাতিম, বকুল কলকাতার পরিবেশের ফলে উপযুক্ত। 

অরণ্য নিধন যেমন ক্ষতিকারক, তেমনই ক্ষতিকর অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক বৃক্ষরোপন, বনসৃজন। স্থানীয় দেশজ প্রজাতির পরিবর্তে লাগানো অন্য গাছ যেমন জীববৈচিত্রের বারোটা বাজাচ্ছে, তেমনই বাড়ছে জুনোটিক অসুখের (যেমন, সার্স, মার্স, নিফা, কোভিড প্রভৃতির ) সম্ভাবনা। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৮৮৪টি রোগের প্রাদুর্ভাবের ঘটনায় দায়ী ছিল ১১৬টি জুনোটিক সংক্রমণ।পতঙ্গ বাহিত সংক্রমণ যেমন ম্যালেরিয়া, জিকা, চিকনগুনিয়া'র মতো প্রায় ১৯৯৬টি রোগের জন্য ওই একই সময়পর্বে দায়ী ছিল বৃক্ষনিধন ও অপরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ। এই সব সমস্যা ডিঙ্গিয়ে বায়ু দূষণ কমানো এখন দূর অস্ত। 

আমেরিকা, চিন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে যে সময় চেয়েছে (২০৫০-৬০) তার আগেই স্রেফ উষ্ণায়নের কারণে ২০৩০-এর পরেই পরিস্থিতি চলে যাবে হাতের বাইরে। বিজ্ঞানীরাই এমন কথা জানাচ্ছেন। সুতরাং, হাতে সময় খুব কম। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের উচিত আজই জলবায়ু নিয়ে সোচ্চার হওয়া, কাল কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। 

পুনশ্চ: হাড় হিম করা সমস্ত তথ্যই 'দ্য ল্যানসেট', 'গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ স্টাডি-২০১৯'-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।


1 comment:

  1. 🍃
    তথ্যভিত্তিক ভালো লেখা, ওনার লেখা যেরকম ভালো হয় সেই রকম আর কি । পরিবেশ নিয়ে আমাদের সকলকেই আরো বেশি সচেতন থাকতে হবে, পরিবেশদূষণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে ( অন্তত যতোটা কম পরিবেশ ধ্বংস করা যায় ) । এসব না হলে ভবিষ্যতে অবস্থা আরও খারাপ হবে । 🌍🌱🪴🌳

    ReplyDelete