স্মরণে মননে ফিরে দেখা
শোভনলাল চক্রবর্তী
মোট ৭২ দিন। ১৮৭১ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২৮ মে- প্যারিসের শ্রমজীবী জনতা তৈরি করেছিলেন প্যারি কমিউন, যা দুনিয়া জুড়ে বৈপ্লবিক স্বপ্নের দুয়ার উন্মুক্ত করেছিল। ফ্রান্সকে একটা বিধ্বংসী যুদ্ধের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যে শাসক শ্রেণি, প্রুশিয়ার ক্রীতদাসত্বের অধীনে ঠেলে দিচ্ছিল যে শাসক শ্রেণি, তাদেরই মুখোমুখি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন প্যারিসের শ্রমজীবী জনতা।
১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের উত্তরাধিকারী হিসেবে ১৮৪৮ সালের বিদ্রোহের উত্তরাধিকার নিয়ে প্যারিসের শ্রমজীবী জনতা রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই দুই সময়পর্ব এমন ছিল যেন শ্রমজীবী মানুষ কোনও পুণ্যলোকে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে, দুনিয়ার শ্রমজীবী জনতার পরিকল্পিত শ্রমজীবী মানুষের শাসনে চলা একটা বিশ্ব তাঁরা গড়ে তুলতে পারবেন। ৭২ দিনের এই হাতেকলমে পরীক্ষা প্যারি কমিউন নামে সুপরিচিত ছিল। একে কমিউন বলা হয় কারণ বিপ্লবীরা নগরের অংশগুলোকে এক একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন যেখান থেকে শাসনের বিভিন্ন নীতিগুলি প্রস্তুত হতে থাকে। এই যৌথ ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছিল 'কমিউন'। কমিউন শুরু হয়েছিল দেশপ্রেমের তরঙ্গ শীর্ষে, প্রুশিয়ার সেনার হাত থেকে প্যারিসকে বাঁচানোর একটা উপায় হিসেবে। কিন্তু, সাধারণ মানুষের মেজাজ আর বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব- এই দু'য়ের সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে দ্রুততার সঙ্গে তার মোড় ঘুরে যায় একটা বৈপ্লবিক, গণতান্ত্রিক চরিত্রের অভিমুখে।
যারা কমিউনের উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন অপরিচিত সাধারণ শ্রমিক। ফলে, কমিউন হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন, নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠীর নয়। যেদিন কমিউন গড়ে তোলার বৈপ্লবিক কাজ শুরু হয়, ঠিক তার পরের দিন ১৯ মার্চ হোটেল ডি ভিলার মাথায় লাল পতাকা উড়ল। ভোরের কুয়াশার সাথে একই সঙ্গে উবে গেল সেনাবাহিনী, সরকার ও প্রশাসন। বাস্তিলের গহ্বর থেকে, বাসফ্রোইয়ের অজ্ঞাত ঠিকানা থেকে তুলে এনে কেন্দ্রীয় কমিটিকে বসানো হল প্যারিসের সর্বোচ্চ আসনে এবং সেটা করা হল সমগ্র বিশ্বের চোখের সামনে। প্যারি কমিউনের সনদ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় যে তার প্রশাসনের চরিত্র ছিল শ্রমিকশ্রেণির চরিত্র।
পরিত্যক্ত কারখানাগুলো শ্রমিকরা দখল করে কাজ শুরু করে দেন, শ্রমিকদের ওপর চাপানো জরিমানার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। বেকারিগুলিতে রাত্রিকালীন কাজ নিষিদ্ধ করা হয় এবং সামাজিক কাজে ব্যবহারের জন্য চার্চের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়। বন্ধকী কারবারের জায়গায় নিয়ে আসা হয় একটি সামাজিক সংগঠন, যারা কাজ থেকে ছাঁটাই শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারে। শ্রমিকশ্রেণি ভুক্ত প্রত্যেকটি মানুষ, প্রতিটি দরিদ্র কৃষক, এমন কি যাঁরা কমিউনের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, সবাইকে নতুন সমাজে জুড়ে নিতে হবে এই ছিল কমিউনের মনোভাব।
কমিউনের নেতৃত্বে ছিলেন যাঁরা, তাঁরা উঠে এসেছিলেন বহু ধরনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে। নানান দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কমিউনের সদস্যদের বেশ বড় মাপের একগুচ্ছ সংস্কারমূলক কাজ করতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যেটার অভাব তাঁদের ছিল তা হল কার্যকলাপ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সামগ্রিকভাবে পরিকল্পিত একটা সুস্পষ্ট কর্মসূচি। কমিউন ছিল ব্যাংক অফ ফ্রান্সের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ফরাসি রাষ্ট্রের কাঠামোগুলির প্রতি আস্থাশীল। মহত্বের এমন নজির ইতিহাসে আর নেই। শ্রমিকরা প্যারিসের দখল নিয়েছিলেন কিন্তু ব্যাংক দখল করেননি। এমন কি তাঁদের শক্তির উল্লেখযোগ্য সমাবেশ ঘটিয়ে দ্রুততার সাথে ভার্সাই পৌঁছে বুর্জোয়া শ্রেণির সরকারকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার কাজও করেননি। আইডলফ থায়ার্স-এর সরকারকে ক্ষমতায় বসে থাকার সুযোগ দিয়ে প্যারি কমিউন নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে এনেছিল।
এই ঘটনাক্রমে ক্ষিপ্ত মার্কস প্যারি কমিউন গঠনের কয়েক সপ্তাহ পর তাঁর বন্ধু, সহযোগী লুই কুগেলম্যানকে লিখেছিলেন, 'ওরা যদি পরাজিত হয়, তাহলে তার জন্য ওদের দয়ালু প্রবৃত্তিকেই একমাত্র দায়ী করতে হবে। প্যারিস ন্যাশনাল গার্ডের মধ্যে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল অংশ যে মুহূর্তে নিজেদের পিছু হটিয়ে নিতে বাধ্য হল, তখনই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের ভার্সাইয়ে যাওয়া উচিত ছিল। বিবেকের দ্বন্দ্বে ওরা সঠিক সময়টা নষ্ট করল। ওরা গৃহযুদ্ধ শুরু করতে চায়নি। ওরা কি ভেবেছিল যে অনিষ্টকারী, বিকৃত মানসিকতার জীব ওই থায়ার্স প্যারিসকে নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি না নিয়ে বসে আছে।'
মার্কস যা লিখেছিলেন বাস্তবে হলও তাই। ভার্সাইয়ের সেনাবাহিনী এক সপ্তাহের মধ্যে প্যারিসের ৪০ হাজার মানুষকে খুন করেছিল। ওই গণহত্যার ১৫০ বছর পরে আজও বুলেটের ক্ষতচিন্হ রয়ে গেছে। প্যারিসের রাস্তায় মৃতদেহগুলি স্তূপীকৃত করে পেট্রোল ঢেলে খোলা আকাশের নিচে পোড়ানো হয়। রক্তস্নাত প্যারিসের রাস্তা পরিদর্শন করে থায়ার্স ঘোষণা করেছিলেন, 'প্যারিসের মাটি ওদের মৃতদেহ দিয়ে ঢেকে গেছে। আশা করতে পারি, যাঁরা নিজেদের প্যারি কমিউনের অনুগামী বলে ঘোষণা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল, সন্ত্রাসের এই ভয়াবহ দৃশ্য সেই সমস্ত রাজদ্রোহীদের কাছে একটা শিক্ষা হতে পারে।' সেই দিনটা ছিল ২৫ মে। তার তিনদিন পরে ২৮ মে প্যারি কমিউনের পতন ঘটে। কমিউন টিকে ছিল দু' মাসের কিছু বেশি সময়। কমিউনের মৃত ব্যক্তিদের ওপরে ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণি বিপুল আকারের এক গির্জা বানিয়ে তার নাম দেয় 'সক্রে কোওর' (পবিত্র হৃদয়)। ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, 'প্যারি কমিউন যে পাপ করেছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এটা গড়ে তোলা হল।' গণতন্ত্রের পথে চলতে থাকা প্যারি কমিউনের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে তার স্মৃতিকে মুছে ফেলতে তাকে গির্জার তলায় চাপা দেওয়া হয়েছিল।
কখনও কখনও ইতিহাসে এক একটা সময় এসে হাজির হয় যখন কোনও ব্যর্থ কারণ হলেও জনতার একটা সংগ্রাম প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাঁদেরই ভবিষ্যতের শিক্ষার জন্যে, তাঁদেরই পরের লড়াইয়ের প্রয়োজনে, প্রশিক্ষণের জন্যে। কমিউনের শিক্ষা কেবলমাত্র প্যারিসের শ্রমিকদের জন্য নয় বা ফ্রান্সের জন্যও নয়, বরং তা ছিল আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণির জন্য একটা পাঠ। শ্রমিকশ্রেণির আত্মশিক্ষার জন্য একটা পাঠ। সেই শিক্ষা হল মানবতার দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ফেলার পক্ষে। সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নিজেদের লড়াই সংগ্রাম সুসংহত করার পক্ষে। সর্বোপরি, প্যারি কমিউন নিয়ে মার্কস'এর এই অমোঘ কথাটিকে উপলব্ধি করার মধ্যে: পুরনো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শুধু দখল করলেই চলবে না, তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন ব্যবস্থার পত্তন করতে হবে। (ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ, ১৮৭১)।
খুবই ভালো লেখা। আমাদের দেশের মার্কসবাদীরা কী প্যারিস কমিউনিস্ট থেকে কোন শিক্ষা নিয়েছেন বা নেবেন। আমি-তো দেখছি তাঁদের একটা অংশ প্রতি বিপ্লবকে সাহায্য করছে। সমর বাগচী
ReplyDeleteএকটানা পড়ে গেলাম। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো সকলের জানা উচিৎ। লেখক মনে করিয়ে দিলেন সেইসব দিনের কথা যা আজকেও সমান প্রাসঙ্গিক।
ReplyDelete