প্রধানমন্ত্রীর ট্যুইট
'এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে'
শোভনলাল চক্রবর্তী
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন মধ্যরাতের কয়েক মিনিট আগে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফাকুরুদ্দিন আলি আহমেদ সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারায় সারা ভারত জুড়ে জ্রুরি অবস্থা'র ঘোষণা করেন। এই ধারা প্রয়োগের মূল কারিগর ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর। শ্রীমতী গান্ধীর সরকার জানায় যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ (১৯৭১), খরা (১৯৭২) এবং বিশ্ব জুড়ে গড়ে ওঠা তেলের সংকটের (১৯৭৩) কারণে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, ফলে ভারতের অর্থনীতি মন্দার মুখে। এই অবস্থায় দেশ জুড়ে চলতে থাকা বিরোধীদের প্রতিবাদ, ধর্মঘট, হরতাল সরকারের কাজকে আরও বিলম্বিত করছে। দেশের ভিতরে চলতে থাকা এই অস্থিরতার কারণে শত্রুপক্ষ যে কোনও সময়ে আক্রমণ করে বসতে পারে।
ইন্দিরা গান্ধীর অনুচরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়। পেশায় তিনি ছিলে দুঁদে আইনজীবী। তিনি এবং ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী মিলে এই মর্মে একটি চিঠির বয়ান তৈরি করেন, যেখানে তাঁরা পূর্বে উল্লিখিত কারণগুলি দর্শিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানান যে এমতাবস্থায় একটি 'অভ্যন্তরীণ ইমারজেন্সি' ব্যতীত ভারত এক চরম বিপদের মুখে পড়তে পারে। সিদ্ধার্থশংকর আইন বাঁচিয়ে এমন একটি বয়ান তৈরি করেন, যা ছিল 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোত্রের। ফলে, রাষ্ট্রপতি তাতে অসম্মত হতে পারেননি।
আজ আমরা সবাই জানি যে এসবই ছিল সরকারের তরফে বিরোধীদের দমন করার অজুহাত। ইন্দিরা গান্ধীই ভারতের প্রথম স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী যিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সংবিধান দিয়েই সংবিধানের টুঁটি চেপে ধরা যায়। জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা, সংসদ পরিণত হয় তাঁর হাতের পুতুলে। সেখান থেকে নেওয়া হতে থাকে একের পর অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত। ইন্দিরা সমস্ত নির্বাচন বাতিল বলে ঘোষণা করেন, কেড়ে নেন নাগরিক সমাজের সমস্ত স্বাধীনতা, সমস্ত বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়, সংবাদপত্রের ওপর নেমে আসে সেন্সরশিপ, চলতে থাকে ব্যাপক হারে মানবাধিকার হরণের ঘটনা।
ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী হয়ে ওঠেন মূর্তিমান দানব। তিনি হিটলারের কায়দায় বস্তিতে বস্তিতে মহিলাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চালাতে থাকেন গণ বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি, পুরুষদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিজকরণ করা হয়। শুরু হয় দিল্লির আশপাশ থেকে বস্তি উচ্ছেদের কাজ। ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে ইমার্জেন্সি এক কলঙ্কিত অধ্যায়, যার অবশেষে অবসান ঘটে ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ তারিখে। এরপর, নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই পরাজিত হন ইন্দিরা গান্ধী। মানুষ বিপুল রায়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে ইমার্জেন্সি তাঁদের কতটা অপছন্দের ছিল। পরবর্তীকালে ইন্দিরা জনসমক্ষে স্বীকার করেন যে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ইমার্জেন্সি।
নাগরিক সমাজের সকল অধিকার হরণ করে নেওয়া সেই কুখ্যাত ইমার্জেন্সির ৪৬তম বর্ষপূর্তিতে একটি ট্যুইট করেছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই টুইটে তিনি লিখেছেন, 'ইমার্জেন্সির কালো দিনগুলির কথা কোনও দিনই ভোলা সম্ভব নয়।' ঠিক কথা। কিন্তু এ কথাও কি ঠিক নয় যে মোদিজী এবং তাঁর সরকার আমাদের প্রতিদিন ইমার্জেন্সির কথা নতুন করে স্মরণ করতে সাহায্য করছেন তাঁদের কাজের মাধ্যমে? প্রধানমন্ত্রী ওই টুইটে আরও লিখেছেন, '১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭-এর মধ্যে আমরা দেখেছি কীভাবে এক একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আঘাত নেমে এসেছে। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে ভারতের গণতান্ত্রিক উদ্দীপনা রক্ষা করার জন্য এবং ভারতের সংবিধানের আবশ্যকতা রক্ষা করার জন্য আমরা সব কিছু করব।' মোদিজীর এই ট্যুইটের প্রেক্ষিতে মনে পড়ছে, 'এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে।' 'আমরা সব কিছু করব' বলতে মোদিজী স্মরণাতীত অতীতে ঠিক কী কী করেছেন একবার দেখা যাক।
তিনি এবং তাঁর সরকার ধরে ধরে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা ধ্বংস করেছেন। বিচারালয়ের নিরপেক্ষতা তলানিতে এসে ঠেকে যখন আজ থেকে আড়াই বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের চারজন শীর্ষ বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সংবেদনশীল মামলাগুলিকে তাঁর পছন্দের বেঞ্চকে প্রদান করেছেন, যা গুরুতর বেনিয়ম। তাঁরা সেদিন যা বলেছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে রাম মন্দির রায়ে প্রমাণিত হয়। রাম মন্দির রায় ঘোষণার পর সেই বিচারপতিকে পুরস্কার স্বরূপ শাসক দলের এমপি করে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়। এতে বিচারালয়ের নিরপেক্ষতার যে অন্তর্জলী যাত্রা ঘটে তা বলাই বাহুল্য।
আজ থেকে দেড় বছর আগে দিল্লির বুকে কিছু গরিব মুসলমান মহিলা জোট বাঁধেন এবং তাঁরা সোচ্চার হন নয়া নাগরিক বিলের বিরুদ্ধে। বিলটিকে সংবিধান বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁরা বলেন যে এই বিল মানুষকে জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করছে যা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাঁদের সেই প্রতিবাদে কান দেয়নি সরকার, উল্টে তাঁদের কপালে জোটে দেশদ্রোহীর তকমা। বিভিন্ন সাজানো মামলায় সমাজ কর্মীদের গ্রেফতার করা বর্তমান সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি। বহু বয়স্ক, হেঁটে চলে ফিরে বেড়াতে অক্ষম সমাজ কর্মীদের জেলবন্দী করে তাঁদের সমস্ত নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করে এক অদ্ভুত আনন্দ উপভোগ করে বর্তমান সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর লাঠি চালাতে, তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ এনে, বিরোধীদের মুখ থেকে টুঁ শব্দ বেরলে তার গলা টিপে ধরায় যে সরকার সিদ্ধহস্ত, তারাই পারবে বটে গণতান্ত্রিক উদ্দীপনাকে রক্ষা করতে!
আজ প্রায় এক বছরের কাছাকাছি (৩২০ দিন) কৃষকরা বসে রয়েছেন দিল্লির উপকণ্ঠে। এত বড় কৃষি বিক্ষোভ ভারত আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু সেই কৃষকদের প্রতি সরকারের ভূমিকা লৌহ প্রশাসকের। কৃষকদের দাবি খুব স্পষ্ট- তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এই বিলে ভারতীয় কৃষকদের এক কথায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির হাতে। এই বিলগুলি যে ভাবে সংসদে প্রায় পেছনের দরজা দিয়ে পাস করা হয় তা আমাদের সকলের জানা। সংবিধানের সাংবিধানিকতা রক্ষা করা ও নাগরিক সমাজের কথা কানে তোলার অভ্যাস যাদের নেই, তাদের কি ইমার্জেন্সি নিয়ে ট্যুইট করা সাজে?
পরিবেশকর্মী দিশা রবিকে যখন টুলকিট কাণ্ডে আবার সেই দেশদ্রোহীতার কারণে গ্রেফতার করে তিহার জেলে নিক্ষেপ করা হয়, তখন দিশার জামিন দিতে গিয়ে বিচারপতি বলেছিলেন, 'দিশার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ২৬ জানুয়ারি (২০২১) তারিখে দিল্লি জুড়ে যে বিক্ষোভ হয়েছে তার সামান্যতম সংযোগ পুলিশ আমাকে দর্শাতে পারেনি। এই গ্রেফতার সম্পূর্ণ অবৈধ।' পুলিশ আসলে এই সব গ্রেফতারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হুকুমে, সেখানে বসে আছেন গণতন্ত্র ও সংবিধানের একনিষ্ঠ পূজারী অমিত শাহ, থুড়ি, শাহেনশাহ! আজ থেকে নয় মাস আগে বিচারপতি মদন লকুর সাবধান করে বলেছিলেন, কীভাবে সরকার বিভিন্ন অছিলায় সোশ্যাল মিডিয়ার পায়ে বেড়ি পরিয়ে আসলে চাইছে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করতে। তাঁর সেই কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলতে চলেছে। সেই কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টার এক জ্বলন্ত উদাহরণ সাংবাদিক সিদ্দিকী কাপ্পান। যাঁকে গত অক্টোবরে আটক করা হয় যখন তিনি দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশে এক দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার একটি খবর কভার করতে যাচ্ছিলেন। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ ওই সাংবাদিককে মথুরা জেলে খাটের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়। তাঁর পরিবার অনেক কষ্টে করোনায় আক্রান্ত, মল-মূত্রের মধ্যে পড়ে থাকা ওই সাংবাদিককে দিল্লির এআইআইএমএস-এ স্থানান্তরিত করার আদেশ পায় আদালত থেকে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কোর্ট কাপ্পানের বিরুদ্ধে আনা শান্তিভঙ্গের অপরাধ সম্পূর্ণ অমূলক বলে ঘোষণা করে।
এই কিছুদিন আগে মাত্র নাগরিক বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অজুহাতে যে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে আটক করে তিহার জেলে রেখে দেওয়া হয়েছিল, তাদের জামিনের বিরুদ্ধে চলতে থাকা মামলায় বিচারপতি দিল্লি পুলিশকে জানান যে, 'ওই তিনজনের জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করে, দিল্লি পুলিশ এবং তারা যে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করছে, উভয়ই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচারের সমস্ত সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে, যা অত্যন্ত লজ্জার ও চিন্তা উদ্রেককারী।'
কোনও সন্দেহ নেই, কেন সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট তাঁদের সমীক্ষায় জানিয়েছে যে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত আজ এক নির্বাচনী স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছে। ভারতবাসী হিসেবে আমরা আজও এক অঘোষিত ইমার্জেন্সির মধ্যে রয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর ট্যুইট আদতে সেই কথাই স্মরণ করালো।
খুব ভালো লেখা । অনেক তথ্য রয়েছে । আমাদের সকলকেই রাষ্ট্রশক্তির স্বৈরাচারী মনোভাব ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবাদ করতে হবে সম্মিলিতভাবে । 💪🏼🤝🏼
ReplyDeleteখুব সময়োপযোগী লেখা।
ReplyDelete