Thursday, 24 June 2021

বাংলা ভাগ?

আসলে ঠিক কী চাইছে ওরা?

প্রবুদ্ধ বাগচী


মণিভূষণ ভট্টাচার্য তাঁর এক কবিতায় বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, কেন্দ্রের সঙ্গে পরিধি, পরিধির সঙ্গে ব্যাস ও ব্যাসার্ধের সূক্ষ্ম যোগ থাকে আর এই যোগাযোগগুলি কখন কীভাবে একটার সঙ্গে একটা মিলেমিশে কঠিন এক ধাঁধা হয়ে যায় সে এক রহস্য। বহুদিন আগে পড়া এই কবিতা মনে এল গত কয়েকদিন ধরে বাংলা বাজারে ভেসে বেড়ানো কিছু কথাবার্তাকে সামনে রেখে। সম্প্রতি বিজেপির এক সাংসদ উত্তরবঙ্গকে পৃথক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার দাবি জানিয়ে শিরোনামে এসেছেন। অবশ্য এই বক্তব্যকে তাঁর দল সমর্থন করে না বলে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আপাতত জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথা জীবন্ত আলোচনার চর্চায় থাকতে থাকতেই বাঁকুড়া জেলার এক সাংসদ আবার দাবি করে বসেছেন জঙ্গলমহলকেও তিনি আলাদা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে দেখতে চান। 

সদ্য নির্বাচন হয়ে যাওয়া এই রাজ্যে আচমকা এমন দাবি কেন উঠে আসছে, তা এক গভীর কৌতূহলের বিষয়। কারণ, বিগত রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে এমন কোনও দাবি ওঠেনি। বরং তারা গোটা রাজ্যটাকেই তাদের মতো করে ‘সোনার বাংলা’ বানাতে চায়- এই ছিল তাদের সোচ্চার প্রতিশ্রুতি। 

কেউ কেউ এমন কথা বলতেই পারেন- ভোটে গো-হারা হেরে যাওয়ার পর রাজ্যের এবং কেন্দ্রীয় বিজেপি দলটার এক ধরনের পাগল-পাগল দশা হয়েছে। তারা কীভাবে এই মস্ত পরাজয়কে সামলাবে তার কূল কিনারা পাচ্ছে না। ফল বেরনোর পরের দিন থেকেই তার নানা রকম উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি। কখনও কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়ে নির্বাচন-উত্তর ‘সন্ত্রাস’ খুঁজে বেড়ানো, আদালতে মামলা ঠোকা, রাজ্যে তাদের বিশ্বস্ত সহচর রাজ্যপালকে দিয়ে নানা রকম বিবৃতি দেওয়ানো ও এলাকায় এলাকায় ঘুরতে পাঠানো থেকে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিবের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন ‘চার্জশিট’ তৈরি- সবই এসবের মধ্যে পড়ে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, সাম্প্রতিক কালে এমন তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরাজয় তারা হজম করতে পারছে না। তার ওপরে জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-শাহ জুটি যে অপ্রতিরোধ্য- এই মিথ ভেঙে যাওয়া তাদের দলীয় অস্তিত্বের পক্ষে সুবিশাল এক চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে রাজ্য বিজেপিতে ঘনিয়ে ওঠা বিদ্রোহে। অনেকেই দল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, অনেকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর প্রকাশ্যেই অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। এই অবস্থায় রাজ্যে দলের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও জিজ্ঞাসার মুখে। এইসবই সত্যি। কিন্তু উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল নিয়ে এই বিচিত্র দাবিকে এতটা সহজ ব্যাখায় মেনে নিতে কিছু খটকা থাকছে। 

সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কর্পোরেট-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জমি আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের নেতৃত্বে। পরে তৃণমূল নেতৃত্ব অনেকটাই সেই ক্ষোভ নিজেদের পক্ষে এনে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করে ও পরিণামে বাম সরকারকে আক্ষরিক অর্থেই উৎপাটিত করে। পরের দশ বছরে বিধানসভায় যথেষ্ট শক্তি থাকলেও সরকার এমন কিছু করেনি যা থেকে তাদের কর্পোরেট–বান্ধব চেহারা প্রকাশ্যে আসে। ভাঙড়ে যে জমি আন্দোলন তা মূলত সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির জমি নেওয়াকে কেন্দ্র করে, সেখানে কোনও কর্পোরেট-পুঁজির স্বার্থ ছিল না। কার্যত গত দশ বছরে সরকারি কর্মসূচি মূলত জনকল্যাণমুখি নানা প্রকল্পে সীমাবদ্ধ রয়েছে। রাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কর্পোরেটকে মাথায় তুলে নাচার মতো কোনও কাজ আমরা দেখিনি। বলা বাহুল্য, এর ফলে তৃণমূলের একটা জোরালো গণভিত্তি তৈরি হয়েছিল যা এই ভোটে তাদের ডিভিডেন্ড দিয়েছে। বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতিকে সে  কল্যাণকামী কাজ দিয়ে প্রতিহত করতে পেরেছে। 

কিন্তু ‘সোনার বাংলা’র আড়ালে ভিন্ন কর্মসূচি ছিল বিজেপির। বাংলার বন্দর, জমি, জঙ্গল নির্বিচারে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া ছিল তাদের গোপন এজেন্ডা। তারা ভেবেছিল দুশো আসন জিতে সরকারে এলে সরকারি ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এই অবাধ লুন্ঠনের ছাড়পত্র হাতে ধরিয়ে দিতে পারবে নিজেদের স্বজন-পুঁজিকে। ঠিক যেমন তারা করেছে গুজরাতে, মধ্যপ্রদেশে, উত্তরপ্রদেশে, উত্তরাখন্ডে, হরিয়ানায়। আর এই সূত্রেই যে একমুখি অসাম্যের উন্নয়ন, তাকেই আসলে বলা হবে ‘সোনার বাংলা’। তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে। কিন্তু যারা কর্পোরেটের নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি তাদের আশাবাদের অভাব নেই। তাদের হাল ছাড়লে চলে না, তাদের যে কোনও উপায়ে বেড়ে উঠতে হয়। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত বক্তৃতার কথা- ‘রবারিজ অফ সয়েল’- যেখানে তিনি বলছেন লোভের তাড়নায় কীভাবে সদ্য মাথা-তোলা তরুণ ঘাস মাড়িয়ে মাড়িয়ে এগিয়ে চলে ভূমি-দস্যুরা, নিষ্ঠুর, নির্লিপ্ত, একবগগা।

সদ্য ভেসে-বেড়ানো এই দুই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রস্তাবে আসলে তারই ইশারা। খেয়াল করা দরকার, উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল এমন দুটো অঞ্চল যেখানে বিজেপি প্রথমেই তাদের প্রভাব বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। যার ছাপ পড়েছিল লোকসভা নির্বাচনে (২০১৯)। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটেও উত্তরবঙ্গে তাদের তেমন ক্ষয় হয়নি, কিছুটা ফাটল ধরেছে জঙ্গলমহলে। যদিও দল বদল করে বিজেপিতে আসার পরেই আজকে রাজ্যের বিরোধী দল নেতা বিজেপিকে জঙ্গলমহলের সব আসন উপহার দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শুধু আসন জেতা নয়, তার সঙ্গে এলাকার দখল নেওয়ার বিষয়ও যে একেবারে ছিল না, তা কি এতটা নিশ্চিত হয়ে আমরা বলতে পারি? পাশাপাশি, আজ যদি কেউ ভাবেন রাজ্যের বিধানসভায় জয়ী দলকে দুর্বল করার রাজনৈতিক লক্ষ্যে এই প্রস্তাবনা, তাও ঠিক নয়। কারণ, তৃণমূল যে সব জেলা থেকে বিপুল আসনে জিতে এসেছে তার অনেকটাই উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলে নয়। ফলে, ওই অঞ্চল দুটি তর্কের খাতিরেও রাজ্য থেকে আলাদা হলে আসন সংখ্যায় বেশি ক্ষতি বিজেপির। তাহলে ঘটনাটা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?

এখানে স্পষ্ট দুটো বিষয় আছে। সেই মনমোহন সিংহের আমল থেকেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে দেশের কর্পোরেট লবির একটা নজর আছে। যাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লুক ইস্ট’ নীতি। ভৌগোলিকভাবে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বে শিল্পের পরিসর অনেক দিন ধরেই কম। অথচ ঠিক এই মুহূর্তে বড় মাপের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প বিপুল ভাবে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে, পরিস্থিতি মোটেও তেমন নয়। কিন্তু শিল্পের পরিবর্তে ট্রেডিং করার জন্য উত্তরবঙ্গ একটা বিরাট সম্ভাবনা। উত্তরবঙ্গের সব থেকে বড় শহর শিলিগুড়ি প্রায় একটা কসমোপলিটান চরিত্র নিয়েছে, যার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। একে কেন্দ্র করে বিরাট একটা ট্রেডিং হাব তৈরি করার সুযোগ আছে। সুদূর পূর্বের সিঙ্গাপুর বা হংকং'এর মডেল এখানে অনায়াসে অনুসরণ করা যায়। ওই দুই জায়গাতেই শিল্প নেই কিন্তু ট্রেডিং'এর মস্ত কেন্দ্র হওয়ায় তাদের একটা আন্তর্জাতিক চকচকে চেহারা আছে। আর এই কাজ করতে গেলে জমি লাগবে, লাগবে আরও নানা পরিকাঠামো- যা গড়ে দেওয়ার জন্য লাগবে তেমনই আগ্রাসী একটা প্রশাসন। তৃণমূল সরকার অবশ্যই এই বিতর্কে নিজেদের জড়াতে চাইবে না। তাই চাই কেন্দ্রীয় শাসন। সুবিধে হল, এতে নির্বাচিত বিধানসভা নেই, তাই রাজনৈতিক বিরোধ এড়িয়ে যাওয়া যায়। 

একই কথা প্রযোজ্য জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রেও। সেখানে এক বিপুল জঙ্গল তার খনিজ সম্পদ সহ এখনও অরক্ষিত আছে। সেই জমি জঙ্গল আর সম্পদের দখল নিতে গেলে সব থেকে আগে দরকার কর্পোরেট-বান্ধব প্রশাসন। কারণ, ওড়িশার পস্কো বা নিয়মগিরিতে বক্সাইট পাহাড় দখলের ক্ষেত্রে মস্ত সহায় ছিল স্থানীয় সরকার। গণআন্দোলনের চাপে ওইসব প্রকল্প বাধা পেয়েছে বা পরিত্যক্ত হয়েছে- সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু প্রাথমিকভাবে সরকারি সাহায্য চাই, চাই তার সামনে একটা উন্নয়নের রঙিন পতাকা। প্রস্তাবিত জঙ্গলমহল বা উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রেও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রভুরা খুব সহজে সেই উন্নয়নের ফুলঝুরি বিলোবেন। মনে রাখতে হবে, দুই এলাকাতেই অনেক প্রান্তীয় মানুষ থাকেন যাদের কাছে সরকারি প্রকল্প পৌঁছলেও তা হয়তো যথেষ্ট নয়। ফলে, আগামী উন্নয়নের জন্য তাঁদের সামনে নানা রঙের গাজর ঝোলানো তুলনায় সহজ। ফলে সম্ভাবনা অপার। 

অবশ্য কেউ বলতেই পারেন, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হয়ে যদি ‘উন্নয়ন’ হয় তাতে আপত্তি কী? আপত্তি নেই। কিন্তু এই ধরনের কর্পোরেট-নির্ভর উন্নয়ন আসলে যে বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়, গত তিরিশ বছরের নিও-লিবারালবাবুদের কাজেকর্মে এখনও কি আমরা বুঝে নিতে পারিনি? টাটার গাড়ি কারখানা হলে স্থানীয় মানুষ কী করবেন- এই প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছিল, তারা এলাকায় চায়ের দোকান, ক্যান্টিন করবেন, প্রকল্পের পাহারাদারের কাজ করবেন, মহিলারা কারখানার বাবুদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করবেন। তিন ফসলি জমির মালিক থেকে দারোয়ান যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে অবশ্য অন্য কথা। সিঙ্গাপুরে বা হংকং'এর ওপরটা খুব ঝলমলে- তার হোটেল, বার, ম্যাসাজ পার্লার, সেক্স শপ এইসব নিয়ে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের মানবিক উন্নয়ন কতটা হয়েছে? যেটুকু ক্ষীর তা চলে যায় কর্পোরেট দানবের পকেটে। 

আরেকটা কথা এখানে গভীরভাবে ভেবে দেখার আছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন জাতিসত্তা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য নিজেরা আলাদা রাজ্য দাবি করেছে। গোর্খাল্যান্ড থেকে কামতাপুরী এইসব তার মধ্যে পড়ে। এইসব দাবিকে বিজেপি নানা সময় তোল্লাই দিয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। দার্জিলিং'এর বিজেপি সাংসদ এক সময় গোর্খাল্যান্ড সমর্থন করে ভোটে জিতেছিলেন। এবারের দাবিগুলির সঙ্গে কিন্তু আলাদা রাজ্যের দাবি নেই। দাবিটা পৃথক কেন্দ্রীয় শাসনাধীন এলাকার। অর্থাৎ, আলাদা রাজ্য হলে সেখানকার রাজনীতি কী হবে, কতটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকবে, তার ঝুঁকি নেওয়ার আর সময় নেই। চাই কেন্দ্রীয় শাসন। 

রাজ্যে বিজেপির পরাজয় আসলে দেশের শক্তিশালী কর্পোরেট লবির বাংলা বিজয়ের রথকেও আটকে দিয়েছে। কিন্তু লোভ, মুনাফা এগুলো তো আসলে কোনও বাধা মানতে চায় না- সে কেবলই হাত বাড়াতে চায় নিত্যনতুন এলাকায়, তার প্রকাণ্ড জিহ্বা দিয়ে লেহন করতে চায় সম্পদের স্বাদ। তাই আজ জনপ্রতিনিধির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাদের সেই অবদমিত আকাঙ্ক্ষার লেলিহান শিখা। 

হয়তো খুব হাল্কাভাবে এগুলোকে না নেওয়াই ভাল।    


1 comment:

  1. খুব ভাল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। হয়ত প্রান্তিকভাবে নেতাদের দিয়ে আলাদা প্রশাসনের কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে জল মাপতে চাইছে। বুঝে নিতে চাইছে স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া। হাওয়া অনুকূল হলেই অস্থিরতা বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে জমির দখল নেবার জন্য। অপর দিকে বর্তমান শাসকদলের ওপর চাপ থাকবে স্থানীয় মানুষের আশা-আকাঙ্খার দিকে নজর দেবার।

    ReplyDelete