'নীরবে মৃত্যু' ও অপরাধ প্রবণতার মন্তাজ
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- বেশিদিন অবধি বেঁচে থাকার একটা অন্যতম শাস্তি হল, প্রতিদিন কোনও না কোনও স্বজনের মৃত্যু সংবাদ পেতে হয়। কথাটা বড় নির্মম সত্য। কিন্তু সে-দিন কি অনুমান করা গিয়েছিল যে এমন একদিন আসবে যে-দিন যৌবনের চন্দ্রমার্গী কাব্য রচনা করবে নিত্যনৈমিত্তিক এক মৃত্যুবলয়- কখনও নিকট আত্মীয়ের, কখনও বা ছেলেবেলার বন্ধুর। অস্ফুটে বলবে, আহা কতই বা বয়স ছিল, এমনভাবে চলে গেল।
ফেসবুকের পাতা কিংবা মোবাইল ফোনের রিংটোন এখন যেন মৃতস্তূপের হাহাকার বয়ে আনে। ভয়ে আতঙ্কে মানুষ জড়োসড়ো হয়ে যায় যখন মধ্যরাতের মুঠোফোনে চিরাচরিত অভ্যেসের জীবনানন্দ পাঠরত কণ্ঠের বদলে আসে একটি অন্যস্বর; জানান দেয় সেই সুললিত উচ্চারণ চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। মনে হয়, দোষারোপের পাহাড় এনে আছড়ে ফেলা যাক রাষ্ট্র কিংবা বিজ্ঞানের ওপর। কিন্তু সে সব আবেগ ক্ষণস্থায়ী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম, কেন না ততক্ষণে যে আরেকটি ফোন এসে যায়। মানুষ স্তব্ধবাক দৃষ্টিতে ভাবতে থাকে এই ফোন ধরবে কি না!
করোনাজনিত মৃত্যুই যে স্থবিরতার একমাত্র কারণ তা কিন্তু নয়। এর বাইরে আগামীর জন্য থেকে গেছে একটি বৃহৎ আশঙ্কা। আজ থেকে বহু বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পলাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে। দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে। অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না। বৃক্ষে পক্ষী দেখি না। গোচারণে গরু দেখি না। কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর।'
তিনি আরও লিখেছিলেন, 'লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল, তার পরে কে ভিক্ষা দেয়!—উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তার পরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজ ধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ী বেচিল। জোত জমা বেচিল। তার পর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কিনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। রোগ সময় পাইল, জ্বর, ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষতঃ বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া ভয়ে পলায়।'
অল্প বয়সে এই সব উপন্যাস পাঠের মুহূর্তে পাঠকের মন যেরকম গম্ভীর হয়ে যেত একদিকে, অন্যদিকে বর্ণনার সুলালিত্যে মুগ্ধ সাহিত্যরস-পিপাসু হৃদয় উদ্বেলিত হত। কিন্তু এখন শুধু শিহরণ জাগে, বুকের ভেতরে একটা হাঁসফাঁস আওয়াজ দরজায় ধাক্কা দেয়, বলে, কালকে কি তবে এমন দিন আবারও আসবে, নাকি সমাগত?
এইসব লেখার মর্মবস্তু ছিল তৎকালীন মড়ক ও দুর্ভিক্ষ। তবে এ কথা তো অস্বীকার করা যায় না যে মহামারি একলা আসে না। আসে দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক একটি তথ্যে জানিয়েছে, করোনার কারণে এখন দারিদ্র সর্বাধিক পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে। আর দারিদ্রের মূল কারণগুলি হল কর্মহীনতা ও দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়া। পক্ষান্তরে আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গত বছরের আমফানে কত যে-মানুষ গৃহহীন হয়েছে, কত ছাত্রছাত্রীর পাঠ্যপুস্তক ভেসে গেছে নোনাজলে, কেউ তার হিসাব রাখেনি। আর এই বছর দেশের একপ্রান্তে ‘তওতে’ ও অন্য প্রান্তে বাংলা-উড়িষ্যার বুকে ‘যশ’।
সরকার বাহাদুর জমির ফসল বিক্রির এমন আইন জারি করতে চলেছে যে কৃষকরা হন্যে হয়ে আন্দোলন করছে, কেউ তাতে মুখ ফিরিয়েও দেখছে না। বহু মানুষের মাথার ওপরে ঝুলছে ডিটেনশন ক্যাম্পের খাঁড়া। মানুষ অসহায়। বৃদ্ধি পাচ্ছে দৈনিক অপরাধ প্রবণতা। চুরি, ছিনতাই ও রাহাজানি থেকে শুরু করে গৃহস্থালি অপরাধের হার ক্রমবর্ধমান। তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে ভারতবর্ষে গত ১০ বছরে গৃহস্থালি অপরাধ বেড়েছে ১৪.৩ শতাংশ। এছাড়া ভুয়ো অনুদান প্রকল্পের নামে সক্রিয় হয়েছে সাইবার অপরাধচক্র। ইন্টারপোল জানাচ্ছে, কয়েক মাসের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়েবসাইট রেজিস্ট্রেশন ৭৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ও ৬০০ শতাংশ বেড়েছে ফিশিং মেইল। ভারতবর্ষে ২০২০ সালের প্রথম অর্ধে অপরাধের ২২,৯৯,৬৮২টি ঘটনা ঘটেছে যা ২০১৯ সালের শেষ অর্ধের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। এমনকি বেড়েছে অবৈধ ড্রাগ, অস্ত্র ও মানুষ পাচারের ঘটনাও। পক্ষান্তরে মেডিক্যাল সামগ্রীর কালোবাজারি তো আছেই। দেশ ও বিদেশের নানা জরিপ-তথ্য এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধ এসবের নানা প্রমাণ প্রতিদিন হাজির করছে জনসমক্ষে।
কিন্তু তারপরেও থেকে যায় একটি মৌলিক প্রশ্ন। অপরাধ তো দুই প্রকারের: এক) শাস্তিযোগ্য ও দুই) ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু অতিমারি জনিত অপরাধকে রাষ্ট্র কোন দৃষ্টিতে দেখবে? নাকি রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই এখানে জনসমাজ অপরাধী ঠাওরাবে! রেশনের চাল-ডাল তো আর মানুষের দৈনন্দিন সকল চাহিদা মেটাতে পারে না, পারে না জন্ম থেকে গড়ে ওঠা অভ্যেসের পাঠক্রমকে এক লহমায় বদলে দিতে। যেমন ধরা যাক, কোনও সন্তানের পিতা যদি আজ শিশুর দুধের পয়সাটুকু জোগাড় করতে না পারে কিংবা কোনও গৃহস্থ যদি তার মায়ের সুগারের ওষুধ, বাবার চশমা বদল বা স্কুল পড়ুয়া কচিকাঁচাদের আবদারের একটা জেল-পেন জোটাতে হিমসিম খায়, অথবা যে মা তার সন্তানকে এতকাল মাছ ছাড়া ভাত তুলে দেয়নি কোনওদিন, তাকেই আজ শাকান্ন কিংবা সেদ্ধপক্ক বেড়ে দিতে হয় রোজ, পারিবারিক ঋণগ্রস্ততার কারণে এতদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় আচমকা– এসবের কী পরিণতি আমরা কি জানি! কতদিন মানুষ নৈতিকতা ও শিক্ষার দোহাই দিয়ে অপরাধের প্রবণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করবে?
যদি কোনও একদিন কেউ স্ত্রীর দৈনন্দিন কান্নায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে গায়ে হাত তুলে দেয় কিংবা মুদিখানার দোকান থেকে একটা পাউরুটির প্যাকেট দোকানদারের অজান্তে ব্যাগে ভরে ফেলে এবং তারপর গুমরে গুমরে বালিশ ভেজায় বিবেক দংশনের জ্বালায় অথবা সংগঠিত অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়ে দৈবাৎক্রমে– কী হিসাবে গণ্য করা হবে এই অপরাধগুলিকে? নাকি রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘদিনের অব্যবস্থা জনিত দুর্দশার জন্য অন্তিমে মানুষকেই জীবন ও আত্মসম্মানের বিনিময়ে মূল্য চোকাতে হবে! আগামী নিশ্চয় এর সদুত্তর দেবে, আপাতত মনে পড়ে যায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতাখানির কয়েকটি পঙক্তি:
'কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।'
👍🏼
ReplyDeleteমানুষের মাংসের ভোজ ‼️!!!
• পরিচালনায় : রাষ্ট্র, যার টাইটেল সরকার । 👹
~শেষদিকটায় মনটা সত্যিই বিষণ্ণ হয়ে যায় । 😔
এই লেখাটি পড়ে আমি আপ্লুত হয়ে পরলাম। সাহিত্য কত দক্ষতার সাথে ভয়ঙ্করকে তুলে ধরতে পারে তার দৃষ্টান্ত এই প্রতিবেদন। এখন এই ভয়ঙ্কর অবস্থাকে মোকাবিলা করাটাই জরুরী। ন্যায়-অন্যায় বিচারের আগে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ণিমার চাঁদ বা অমাবস্যার অন্ধকার আমাদের জীবন সংগ্রামের উর্দ্ধে নয় , একই আবহে।
ReplyDelete