Wednesday, 28 April 2021

'অন্তরে উপলব্ধ সত্য'

আমার মায়ের শিল্পচর্চা

তন্ময় সাঁতরা


খুব কাছের মানুষ সম্পর্কে লেখা বোধ করি একদমই সহজ কাজ নয়। তবু যে কথা আজ আমার কিঞ্চিৎ বোধগম্য হচ্ছে, সে কথা আমি না বললে আর কে-ই বা বলবে! যাঁর শিল্পচর্চা নিয়ে দু' কথা এখানে লিখতে চলেছি, তিনি কোনও প্রথিতযশা শিল্পী নন। শাস্ত্র ও চিরাগত প্রথা-প্রকরণের সঙ্গে যোগসাজস রাখার বিশেষ প্রয়াস না-করে আপন মনে তিনি আঁকেন। কোনও প্রথাগত শিক্ষা নেই। ‘কাজের চশমা-পরানো দৃষ্টি’ ঝেড়ে ফেলে রেখে ‘অফুরন্ত আনন্দ আর খেলা-দিয়ে-ভরা শিশুকালের দিনরাতগুলো’য় ফিরে যাওয়ার জন্য তিনি আঁকেন। ছিয়াশি বছর বয়স্ক যে মানুষটির অবিচল এই পথচলার কথা এখানে বলার চেষ্টা করছি, তিনি আমার মা। বিদ্যুৎলতা সাঁতরা।

 

ছোটবেলায় দেখতাম, আমাদের লিখবার স্লেটখানা হাতে নিয়ে মা দ্রুত রেখার টানে এঁকে ফেলতেন চঞ্চল কাঠবেড়ালির গাছে ওঠার দৃশ্য। আমি দেখে তাজ্জব বনে যেতাম। মা আঁকবার পদ্ধতি শেখাতেন না। হাজার কাজের ফাঁকে আঁকার ইচ্ছে হল, তাই এঁকে ফেললেন।

 

আপন মনে আঁকার এই অভিরুচি মা কোথা থেকেই বা পেলেন? জানতে ইচ্ছে হয়, কোন শেকড় থেকে উদ্গম হল এই ঘরোয়া ইচ্ছে বা বাসনার। দ্বিধাহীনভাবে বলা যাবে, মা’র এই গুণটি তাঁর বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমার দাদু ছিলেন ভারী শৌখিন স্বভাবের এক মানুষ। ঘরদোর, উঠোন, বাগান, তুলসীমঞ্চ— সবখানেই তাঁর সুরুচির ছাপ দেখতে পাওয়া যেত। দাদু নিজে তাঁর মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলিকে ছবি এঁকে ভরিয়ে তুলতেন। কোনও এক অজানা রহস্য বা টান তাঁকে সে সব ছবি আঁকায় উদ্বুদ্ধ করত। স্থানীয় গ্রামীণ দোকান থেকে কেনা রং আর নিজের হাতে বানানো তুলি নিয়ে তিনি মেতে উঠতেন তাঁর আঁকাআঁকিতে। শিশুর ধুলোবালি নিয়ে খেলার মতো সেই মেতে ওঠা ছিল নির্মল আনন্দের। সে সব ছবির আঙ্গিক ও ভাষা ছিল সহজ ও অনাড়ম্বর। দাদুর বাড়ির খুব কাছাকাছি ছিল কয়েক-ঘর পটুয়ার বাস। দাদু তাদের শিল্পকর্মের খুব কদর করতেন।

 

এখন আসি আমার মায়ের আঁকাআঁকির কথায়। দেখে নিই কেমন করে মায়ের সেই ‘সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’ তাঁর প্রত্যহকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রেরণা হয়ে উঠল। তাঁর বাধা-সংঘাতময় পারিবারিক ও ব্যক্তি-জীবনের আবিলতা অবসাদ থেকে মুক্তির উপায় হয়ে উঠল। এই লেখায় তাঁর শিল্পচর্চা সম্পর্কে আমার কিছু দেখা বোঝা ও অনুভব ঘরোয়া কথার ছাঁদে পরিবেশন করার চেষ্টা করব। এখানে তাঁর শিল্পকর্মের মূল্যায়নের পরিবর্তে সামান্য বিশ্লেষণ ও বর্ণনার প্রয়াস থাকবে।

 

বিশ্বশিল্প তো দূরের কথা, এ দেশের তাবড় শিল্পীদের নাম-ধাম তাঁর তেমন জানা নেই। তবু ‘উতলা মনের দৃষ্টি ও সৃষ্টিকে’ বেঁধে রাখার অদম্য ইচ্ছে। কম বয়স থেকে আর পাঁচটি মেয়ের মতো আমার মায়েরও সেলাই উল বোনা আসন বোনা ও গয়না বড়ি দেওয়ায় উৎসাহ ছিল। সংসারের প্রয়োজনে তাঁকে সে সব করতেও হয়েছে প্রচুর। কিন্তু কেবলই পুরনোর পুনরাবৃত্তি না করে নতুন নকশা উদ্ভাবনে তাঁর প্রায়ই আগ্রহ দেখেছি। চটের উপর সুতোর স্টিচে করা আসন, গয়না বড়ি কিংবা নকশি কাঁথার সৃজনে সে ছাপ স্পষ্ট পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে সুতোর ক্রস-স্টিচে করা একটি চটের আসনে বেড়ালের আকার-আকৃতি ও রংয়ের কথা মনে আসে। বেড়ালটির অবয়বে সবল জ্যামিতিক বিভাজন ও পট জুড়ে অভিব্যক্তিময় উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। অনাড়ম্বর কিছু নকশি কাঁথার কথাও মনে আসে। যেমন রৈখিক চলন সমৃদ্ধ গণেশ। দূরত্বের অধ্যাস নেই, ছবিগুলি দ্বিমাত্রিক গুণবিশিষ্ট। 

 

১৯৯০-এ আমার বাবার হঠাৎ প্রয়াণ ঘটল। সংসার টালমাটাল হল। দু’-এক বছর বাদে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে মা চলে এলেন কলকাতায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে। আমরা যে-যার মতো বেরিয়ে যেতাম; কিংবা হয়তো ব্যস্ত থাকতাম কোনও কাজে। মা’র হাতে তখন অনেক সময়। অনেক অবসর। আমরা ভাই-বোনেরা মা’র জন্য কখনও কখনও খাতা পেন রং এনে দিতে শুরু করেছিলাম। খাতার সাদা পাতায় মা’র নিয়মিত আঁকিবুকি তখন থেকে শুরু হয়। মাঝে মাঝে কোনও কারণে ছেদ পড়লেও, আবার মা ফিরে যেতেন তাঁর প্রিয় কাজটিতে। কোনও উপর-চাপানো দায় নেই। দর্শকরা পছন্দ করবে কিনা, সেরকম কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। এই সহজ খেলায় মেতে ওঠার এক অনন্য আকর্ষণই হয়তো মায়ের এই শিল্পচর্চার চালিকাশক্তি। সুন্দরের নেশায় এই পথ চলায় জীবনের প্রসারণ ঘটে সন্দেহ নেই। তাছাড়া এতে বোধহয় রয়েছে এক ধরনের ‘হিলিং এফেক্ট’, নিরাময়ের শক্তি। প্রায় একঘেয়ে ‘শুকনো জীবন’ থেকে নিষ্কৃতি। আর ‘রূপের রাজত্বে প্রবেশ’-এর এক অদম্য হাতছানি।

 


বিষয়বস্তু ও অভিব্যক্তির দিক থেকে দেখলে মায়ের আঁকা এই ছবিগুলিতে কয়েকটি বিশেষ ধরন লক্ষ করা যাবে। বাস্তব ঘটনা অনুসারী, কল্পনা-আশ্রিত, কৌতুক বা হেঁয়ালি ও স্থির বস্তু। দেখা যায়, অন্যান্যগুলির তুলনায় স্থির বস্তুর ছবি বা ড্রয়িংগুলি বেশি বাস্তবানুগ। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বস্তুটিকে খুব কাছ থেকে দেখে আঁকা হয়েছে। যেমন, একটি ড্রয়িং-এ দেখি পাশাপাশি রাখা দুটি অবজেক্ট— একটি ফুলদানি, আরেকটি পাত্রে রাখা কিছু ফল। দুটি দু’ ধরনের বস্তুর অনবদ্য সম্মেলন! ওয়াশ বেসিনের ড্রয়িং-টিতে একসঙ্গে অনেকগুলি বস্তুর সমাহার। মানুষ, পশু-পাখির বেলায় কিন্তু ইম্প্রেশান ও ছন্দই প্রধান।

 

মনের স্ফূর্তি আর শুদ্ধসত্ত্ব নান্দনিকতার খোঁজে আমার মায়ের এই অভিযাত্রার প্রেক্ষাপটে কোনও অ্যাকাডেমিক শিক্ষার আঁচ নেই। তবে ছোটবেলায় দেখা পটের ছবির সহজ ভাষা বোধকরি তাঁর মনকে আকর্ষণ করত। সেই টান এবং মুগ্ধতা আজীবন তাঁর জীবনযাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে রইল। যেখানে অনুশীলনের চেয়ে অন্তরের বেগকে বাহ্যিক রূপের আশ্রয়ে মূর্তিমান করার নেশাই প্রধান। সেই রূপাঙ্কনের পথ-পরিক্রমায় স্বশিক্ষার ছাপ খুবই স্পষ্ট। সেই পথে ‘অন্তরে উপলব্ধ সত্য’ ছাড়া আর কোনও দায় নেই। কেবল যে প্রিয় কাজটির মাঝখানে তাঁর চিত্ত হারিয়ে যায় তাকে প্রাণপণে ভালবাসাই সারকথা।

 

10 comments:

  1. Simple yet elegant, 2D yet reflecting full reality, freedom of expression bringing joy to all who are blessed to be at her company. My dida.

    ReplyDelete
  2. আপনার লেখা পড়ে ভালো লাগলো। আমাদের ছোটবেলাটা এইরকম বহু গুণীজনদের আশেপাশে ই কেটেছে। পাড়ার ঠাকুমা,জেঠীমা রা অনায়াসে কাঁথা সেলাই করতেন,বালীশের ওয়ার্ডে ফুল তোলা হতো না এরকম বোঝায় ছিল না ঘরের কোণে হাতের কাজ করা টেবিল ক্লথ কুরুশের কাজ করা আয়না ঢাকা এবং জলের গ্লাসের উপরে কুরুশের কাজ করা ঢাকনি এগুলো অত্যন্ত সাধারণ এবং এলেবেলে বলেই ধরা হতো। এখন পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি যে মানুষের অনেকটা অবসর ছিল এবং সেই অবসর টিকে সুচারু এবং সৌখিনভাবে কাজে লাগানো এবং উপস্থাপনা করা এটাই সেই যুগের মানুষদের অবসর বিনোদন ছিল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো বলেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ।

      Delete
  3. সত্যি সুন্দর উপলব্ধি।
    জীবনের চলার পথে আমরা সহজেই যা কিছু পেয়ে যাই তার মূল্য বোঝার চেষ্টা করি না বেশির ভাগ সময়েই। ভুলে যাই কতকিছুই, যা সব পেয়ে থাকি জন্মসূত্রে, উত্তরাধিকার সূত্রে। যা আমাদের কষ্টার্জিত নয়, যা পাওয়ার যোগ্য কিনা তাও ভেবে দেখা হয় কই!
    কিন্তু যোগ্য সুসন্তান যখন মা বাবার যোগ্য সম্মান দেন, সঠিকভাবে উপলব্ধি করে মা বাবার থেকে পাওয়া মানবিক গুণাবলীর.. তখন আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে এবং গর্ব হয়।
    আজ তেমনই আনন্দে চোখে জল ..
    সুন্দর উপলব্ধি, সুন্দর মূল্যায়ন, সুন্দর লেখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ দিদি। ভালো লেগেছে জেনে আনন্দ পেলাম।

      Delete
  4. Tomar Mayer bhitare srijanshilatar je beej tini tanr Babar kachh theke peyechhilen,Tumi ta peyochho tomar Mayer kachh theke ....janmantare ei sristir nesha tomateo ankurito hoyechhe eti tomar soubhagya;sabar ei bhagya hoyna....Ami dekchhi tomar Mayer style tao Khan ajante tomakeachchhana korechhe Tumi janteo paroni....Gin theke Gin e pranito e jiban er jannya shudhushrddha tuku thak.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thank you very much, for your inspiring comments.

      Delete
  5. বাহ্! খুবই ভালো লাগলো...

    ReplyDelete
  6. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

    ReplyDelete