বাংলা প্রকাশনার জগৎ
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
সালটা ১৯৯৭। বইমেলা প্রাঙ্গণে বিশিষ্ট প্রকাশক পার্থ বসু (নয়া উদ্যোগ) আলাপ করিয়ে দিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে (অল্পদিন আগে তাঁর ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’ আলোচনা করেছি ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায়)। সেদিনের সেই সান্ধ্য আড্ডায় বহু বিষয়ে কথা হয়, তবে আলোচনার মূল বিষয় ছিল সমকালীন বাংলা সাহিত্য ও তার প্রকাশনা। এই আলোচনার অনেকটা লিখেছি ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায়। নতুন করে তেমন কিছু বলার ইচ্ছেই হয় না। তবে, এপার বাংলা প্রকাশনার জগৎটা নিয়ে আবারও কিছু না বললেই নয়। এমন তাগিদটা পেলাম অধীর বিশ্বাসের লেখা ‘লাস্ট বয়’* বইটি পড়া শেষ করে। কেন তা বলি।
এই রাজ্য তথা এপার বাংলার প্রকাশনার জগৎটা ভারি মজার বা বিস্ময়ের। ভুলি কেমনে যে একদা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ। এ কথাও ভুলতে পারি না, আজ কলেজপাড়া বা বইপাড়া নিয়ে বাঙালি যে গর্ব করে সে পাড়া তো বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে নির্মিত। সাহিত্যের ব্যাটন বিদ্যাসাগরের হাত থেকে বঙ্কিম হয়ে রবীন্দ্রনাথে পৌঁছলে স্পষ্ট হল বাংলা ভাষার বিপুল ঐশ্বর্য। সাহিত্যের সে বিপুল ভাণ্ড পূর্ণ করার কাজে যাদের পেলাম তাঁরা এ কালে জীবনানন্দ, শক্তি, বিভূতি, সতীনাথ, তারাশঙ্কর ও আরও অনেকে। এঁদের কাঁধে চেপে আজ আমরা বিশ্বের দরবারে এই ভাষার ন্যায্য সম্মান ও স্বীকৃতি চাই। ওপার বাংলার ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার সে দাবিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি এপার বাংলার প্রকাশনার জগৎ; সে পড়ে রইল যেন সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের তলাকার এক গাঢ় অন্ধকারে।
সেই অন্ধকার দূর করতে যারা এগিয়ে এলেন তাঁরা প্রতিশ্রুতি যেমনই দিন, তাঁরা এসেছিলেন মূলত ব্যবসা করতে, দু’ পয়সা কামাতে। তার প্রমাণ মেলে তাঁদের আচরণে। এঁরা ভাবেন, কোনও প্রকারে ছাপার অক্ষরে দুই মলাটের ফাঁকে কোনও ভালো কাজ গুঁজে দিতে পারলেই তাদের দায় ও দায়িত্ব শেষ। বাকি কাজ পুস্তক বিক্রেতা ও পাঠকের। পুস্তক বিক্রেতাদেরও এই ব্যবসায় আসার মূল কারণ পেট তথা নিজ নিজ সংসারের দায়। তবু তাঁরা কী করতে পারেন তার নমুনা রেখেছেন প্রয়াত ইন্দ্র মজুমদার শান্তিনিকেতনে তাঁর 'সুবর্ণরেখা' নামের বিপণিতে, আর অন্তত বাংলাদেশের ‘পাঠক সমাবেশ’।
আর পাঠক? চিরকাল সব দেশে পাঠককুল আয়েসি। তাঁরা নিজ উদ্যোগে খুঁজে নেবেন ভালো বই, এমনটা হয়নি, বুঝি তা হবার নয়। তাই বিপণন একটা বড় ভূমিকা নেয় এই ব্যবসায়। এই ব্যবসায় তার ভূমিকা সামান্য বেশিই। তাই কেবল উচ্চহারে কমিশন শুধু নয়, বইয়ের প্রচারে আরও কিছু করা দরকার, যা করা হয়ে থাকে বিদেশি পুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে। তাঁরা অনেক সময় গুণী মানুষকে লেখার জন্য টাকা আর কলম ধরিয়ে দেন। বিজ্ঞাপন, কাগজে কাগজে সেই পুস্তকটি নিয়ে আলোচনা ও পুরস্কারের আয়োজন ছাড়াও দেশে-বিদেশে লেখককে নিয়ে সাহিত্যসভার আয়োজন করা হয় প্রকাশকদের উদ্যোগে। এসব আমাদের দেশের প্রকাশকরা ভাবেনই না। হয়তো ভাবেন, এতে প্রকাশের ব্যয় বাড়বে এবং তখন আয় বাড়াতে বইয়ের দাম বাড়াতে হয়, দামের কথা ভেবে পাঠক নাকি আগ্রহ হারায়।
সেদিন একটি বই পড়ছিলাম: 84, Charing Cross Road। এক মার্কিন লেখিকা তাঁর ব্রিটিশ পুস্তক বিক্রেতাকে কিছু চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি ও তার জবাব নিয়েই তৈরি সে বই। এ দেশের প্রকাশকেরা তেমন বইয়ের কথা ভাবতে পারেন? তাঁরা তো লেখককে প্রাপ্য টাকাই দেন না, প্রুফ-রিডারকে টাকা ও সম্মান দেন না। যোগ্য সম্পাদক নিয়োগ করেন না। ভালো মানের বই পাই না, বঞ্চিত হই আমরা পাঠকরা।
এপার বাংলার প্রকাশকদেরও কিছু যুক্তি আছে নিশ্চয়। সব যুক্তি পুরো মিথ্যে না হলেও তা পুরো সত্য বলা যায় না, এমন কথা বলছিলেন হুমায়ুন। তিনি দেখাচ্ছিলেন ওপার বাংলার প্রকাশন সৌষ্ঠব। তুলনায় তাদের বইয়ের দামও বেশি। কিন্তু দাম দেখে পাঠক বিচলিত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন এমনটাও নাকি ঘটে না। একেবারে নতুন লেখকেরও বই প্রথম সংস্করণ ছাপা হয় ২০০০ কপি! এসব কথার সত্যতা নিরূপণের সাধ্য সেদিন আমার ছিল না, আজও নেই। তবে এ কথা নিশ্চয় সত্য যে দাম শুনে পাঠক পিছিয়ে যায় না। এবং এও সত্য যে, বই হাতে তুলে নেবার আয়োজন এখানে দুর্বল এবং কোনও বই হাতে নিয়ে তার মুদ্রণ (মুদ্রণ প্রমাদ সহ) দেখে আর তা নেবার ইচ্ছে তেমন জোরালো থাকে না।
এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল না বয়ে গেলেও মানতে দ্বিধা নেই যে এপার বাংলার প্রকাশনা জগতে বেশ চোখে পড়ার মতো কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তাই এখন অনেক প্রকাশকের অনেক বই চোখ টানে। এমন একজন প্রকাশক অধীর বিশ্বাস ও তাঁর প্রকাশন সংস্থা 'গাঙচিল'। 'গাঙচিল' আজ নিজ গুণে বাংলার প্রকাশনা জগতে সাড়া ফেলেছে। এর আগে বাংলা, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা কেউ কেউ প্রকাশনার দায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা কেউই পাঠক মনে প্রকাশক রূপে তেমন গভীর ছাপ ফেলতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথও না। সেই ট্রাডিশন ভাঙ্গার কাজটা অনেক এগিয়ে দিলেন অধীরবাবু। অন্তত সেজন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
বেড়াতে গিয়েছিলাম সিমলিপালের জঙ্গলে। সঙ্গে বই ছিল কিছু, যার একটি অধীর বিশ্বাসের ‘লাস্ট বয়’। এটা সেই বিরল জাতের বই যা একটানে পড়ে ফেলা যায়। এই বই পড়তে পড়তে পুরনো দিনের কথা, নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। সেই স্কুল যাওয়ার আকুতি, স্কুলের শাস্তি, মায়ের ব্যগ্রতা– কিছুই যে ভুলতে পারি না। মনে পড়ে কানে পুঁজ, খোস-প্যাঁচড়ার কথাও! অবশ্য এ কালের স্কুল ব্যবস্থায় তেমন ঘৃণা বা অনাচার আর নেই, যেমনটি অধীরবাবু লিখেছেন বা আমরাও দেখেছি। আজও কিছু সামাজিক সমস্যা অবশ্যই আছে তবে তাও তেমন জোরালো নয় নতুন কালের শিক্ষককুলের কল্যাণে। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চপদ পেলে ট্রোল্ড হতে দেখি আদিবাসী কন্যাকে। তবে, তা নিশ্চয় ব্যতিক্রম।
এই বই পড়ে আর অধীরবাবুর লেখা ও প্রকাশনার দিকে তাকিয়ে আরও একবার স্পষ্ট হয় নজরুলের কবিতার অর্থ: ‘হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান’। আমি তো কবি সুভাষ নই। তবু বলতে চাই, ‘বিশ্বাস তুমি লেখো’ এবং একজন সৎ প্রকাশক হও।
লাস্ট বয়: অচ্ছুৎ বালকের ক্লাসরুম। অধীর বিশ্বাস। গাঙচিল। প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৯। পৃ ৮১। মূল্য ১৭৫ টাকা।
No comments:
Post a Comment