Saturday, 24 April 2021

শকুনদের দু' কান থাকে না

ওরা আসছে ভাগাড় বানাতে

আশিস দত্ত


ছবিটার কথা মনে পড়ে? ছবিটার নাম ছিল: The Vulture and the Little Girl। বহু বছর পর ছবিটা দেখতে পেলাম সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রথমবার যেমন ধাক্কা খেয়েছিলাম এবারও তেমনই হল, তবে অন্য অনুষঙ্গে। 

ছবিটিতে একটি শকুন খিদেয় মরণাপন্ন একটি ছোট্ট হাড় জিরজিরে বাচ্চা মেয়ের মরণের অপেক্ষা করছে। প্রাণবায়ু নির্গত হলেই শকুনটা উড়ে এসে খুবলে খাবে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত বালিকাটির দেহ। আকাশ থেকে তার তীক্ষ্ণ চোখ পর্যবেক্ষণে রেখেছিল মেয়েটিকে। কাছেই মাত্র মাইল খানেক দূরে ইউনেস্কো বুভুক্ষু মানুষদের জন্য লঙ্গরখানা খুলেছিল। সেই লক্ষ্যেই অশক্ত শরীরে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিল বালিকা। কিন্তু শরীর আর দেয় না। বসে পড়ে সে। হয়তো আশা ছিল কেউ যদি আসে, একটু সাহায্য করে তাকে। এইটুকু পথ যদি পার করে দেয়! এই তো সুযোগ। শকুন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে। দূর থেকে লক্ষ রাখে। অপেক্ষা করে অন্তিম সময়ের। ক্রমশ এগিয়ে আসে পায়ে পায়ে। ক্লোজআপ ফটোফ্রেমের মধ্যে চলে আসে শকুন। ক্ষুধার জ্বালায় মরণাপন্ন বালিকা আর ঠিক তার পিছনেই ঘাপটি মেরে থাকা শকুন। বাঃ! দুর্ভিক্ষের চমৎকার বিজ্ঞাপন। লেন্স-বন্দী হয়ে যায় এই করুণ দৃশ্য।

সেও ছিল এক যুদ্ধের আবহ। সুদানের গৃহযুদ্ধ। সেও ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুদানের পিপলস্ লিবারেশন আর্মি'র লড়াই। কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম শরিয়তি আইন জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে অ-মুসলিম দক্ষিণ সুদানিজদের মধ্যে। এছাড়াও ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য ও সরকারি সুযোগের নানান ক্ষেত্রে বঞ্চনার অভিযোগ। সুদীর্ঘ বাইশ বছর (১৯৮৩-২০০৫) ধরে চলা এই যুদ্ধের ফলেই তৈরি হয় দুর্ভিক্ষের পরিমণ্ডল। বে-ঘর হাভাতে মানুষের মিছিল। এই নিঃসহায় মানুষগুলোর শুশ্রূষার জন্য ইউনেস্কো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। জায়গায় জায়গায় গড়ে তুলছিল খাদ্য ও চিকিৎসার শিবির। কিন্তু তহবিলে টান পড়ছিল। তখনই সিদ্ধান্ত হল, ত্রাণ সংগ্রহের জন্য দুর্ভিক্ষের প্রকৃত ছবি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছতে হবে। চিত্র-সাংবাদিকদের জন্য খুলে দেওয়া হল সুদানের সীমান্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্র-সাংবাদিক কেভিন কার্টার এই দায়িত্ব নিয়েই ১৯৯৩ সালে পৌঁছেছিলেন দক্ষিণ সুদানে। ওপরের ছবিটি তাঁরই তোলা। বাস্তবের সেই দৃশ্য কেভিনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। যেন এক অপার্থিব মুহূর্ত। ছবিটি ক্যামেরা-বন্দী করার পর কেভিন শকুনটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাড়া থাকায় তারপরই তাঁকে চলে আসতে হয়। বালিকাটির (পরে জানা গিয়েছিল সে ছিল বালক) কী পরিণতি হল তাঁর জানা ছিল না। দেশে ফিরে ছবিটি তিনি 'নিউ ইয়র্ক টাইমস্'কে বিক্রি করে দেন। ১৯৯৪ সালে ছবিটি 'ফোটো জার্নালিজম' বিভাগে পুলিৎজার পুরস্কার পায়। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে সেই ছবি- 'শকুন ও একটি ছোট্ট বালিকা' শিরোনামে।

আজ পশ্চিমবাংলায় এক অন্য গৃহযুদ্ধ। হিন্দু-মৌলবাদের আগ্রাসন থেকে বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার লড়াই। ভারতের সংবিধান, ভারত-রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা বাঁচবে কি না, এ তারও পরীক্ষা। ভারতে কোভিড-সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভ্রূকুটির মধ্যেই শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধও ইচ্ছাকৃতভাবেই দীর্ঘায়িত। দীর্ঘ এক মাস ধরে আট দফায় সাজানো এই রণকৌশল। শকুনের মতোই ডানা মেলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উড়ে আসছিলেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। কোভিড-সতর্কতা বিধি উপেক্ষা করেই চলছিল হাজার হাজার মানুষের বিশাল বিশাল সভা, রোড-শো। লাখো মানুষের সমাগমে মঞ্চে দণ্ডায়মান প্রধানমন্ত্রী আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলেই ফেলেন, 'ম্যাঁয় যাঁহা দেখ সকতা, মুঝে লোগ হি লোগ দেখতা, বাকি কুছ দেখতাই নেহি...।' এক বছর আগে তাঁরই করা করোনা-সংক্রমণ থেকে জনতাকে রক্ষা করার সতর্কবাণী তিনি বিস্মৃত হলেন। ছবির শকুনটির চোখ ছিল বালিকার মৃতদেহের দিকে। আর প্রধানমন্ত্রীর শকুনি-চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাংলার মসনদে নিবদ্ধ। সেই লক্ষ্যপূরণের জন্য যদি শত শত মৃতদেহ পায়ে দলে যেতে হয় তাতেও তিনি পিছপা নন। 


ভারতবর্ষ আজ অরক্ষিত অভিভাবকহীন। কোভিড-সংক্রমণ থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের ওপর আরোপিত হয়েছিল তারা আজ শকুন হয়ে বাংলার আকাশে ওড়াওড়ি করছে। কেভিন তবু শকুনটিকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। বুভুক্ষু মানুষদের রক্ষা করার জন্য ত্রাণ-তহবিল সংগ্রহে ছবির মাধ্যমে সাহায্য করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোভিড-ত্রাণকে উপলক্ষ করে গত বছর গঠিত ‘পিএম কেয়ার্স’ ফান্ডের সংগৃহীত অর্থ কী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা জানার অধিকার ভারতের জনগণের নেই। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মুম্বাই, গুজরাত সর্বত্র আজ মৃত্যুর মিছিল। মরণাপন্ন রোগী নিয়ে আত্মীয়-পরিজনেরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে অসহায় হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। বালিকাটির মতো তাঁদেরও আশা যদি কেউ কিছু করেন। ছবির বালিকাটি ক্ষুধার তাড়নায় চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ছিল। আর আজ বিভিন্ন রাজ্যের হাজার হাজার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত অক্সিজেনের অভাবে। ভারতবর্ষ আজ সত্যিই এক ভাগাড়ে পরিণত। শ্মশানে শ্মশানে জ্বলছে সারি সারি চিতা। আর শকুনেরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তাদের লক্ষ্য শুধু বাংলা বিজয়। মানুষের মৃত্যু-মিছিলের বিনিময়ে তাদের লালসা শুধু বাংলার মসনদ। তবেই বরাত পাওয়া যাবে ভারত শাসনের। তবেই ছবির শকুনের মতো খুবলে খাওয়া যাবে মৃত ভারতবর্ষের লাশ। অথচ সময় ছিল প্রস্তুতির। কিন্তু কথায় বলে, শকুনের চোখ থাকে ভাগাড়ের দিকে। তাই গত কয়েক মাসে ৬০ লক্ষ ভ্যাকসিনের ডোজ আর ৯৩০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন বিদেশে রফতানি হয়ে যায়। ফলে, আজ ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সবাইকে টীকা দেবার কথা ঘোষণা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় জোগান খুবই সামান্য। মজুত অক্সিজেনের পরিমাণও নিতান্তই অপ্রতুল। রাজ্যে রাজ্যে অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে। 

কেভিন কার্টার যখন সে সময় এত বড় পাওয়া সম্মান উদযাপনে ব্যস্ত ছিলেন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির খবর দেখানো হচ্ছিল, সে সময় ফোন-ইন্টারভিউয়ে একজন জিজ্ঞেস করেন, 'শেষ পর্যন্ত মেয়েটির কী হয়েছিল?' কার্টার বলতে পারেননি, কারণ তাঁর ফ্লাইট ধরার তাড়া ছিল। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করেন, 'সেখানে কটা শকুন ছিল?' কার্টার বলেন, 'মনে হয় একটাই ছিল।' ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি তখন বলেন, 'আমি বলছি, সেদিন ওখানে দুটো শকুন ছিল, তার মধ্যে একজনের হাতে ছিল ক্যামেরা।' এই কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করে কার্টার বিচলিত হয়ে পড়েন। শেষে অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর সুইসাইড নোটে তিনি সেই বীভৎস স্মৃতির কথা লিখে গিয়েছিলেন। যে কোনও পরিস্থিতিতে কোনও কিছু পাওয়ার জন্য মানবিক হতে হয়। কার্টারের মনে হয়েছিল, ক্ষুধা-কাতর মৃতপ্রায় অসুস্থ বাচ্চাটিকে তিনি ইউনাইটেড মিশনের ত্রাণ-শিবিরে পৌঁছে দিতে পারতেন। শিবিরটি ছিল মাত্র মাইল খানেক দূরেই।

আজ প্রায় তিন দশক পর পশ্চিমবাংলার আকাশে মাটিতে শত শত শকুন 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি তুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে বিষ-বাষ্প। নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা ছিল এই আগুনে-শকুনদের হাত থেকে পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসা অসহায় জনতাকে রক্ষা করার। করোনা-আবহে নির্বাচন হতে পারত এক, দুই বা বড় জোর তিন দফায়। বন্ধ হতে পারত বিধি অমান্য করে বিরাট বিরাট জনসমাগম। পুরো প্রচার পদ্ধতিই হতে পারত ভার্চুয়াল। কিন্তু কমিশন সেই মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শকুনের উচ্ছিষ্ট খেয়ে উড়ে গিয়ে গোয়ার রাজ্যপাল হয়ে বসেছেন। বাকিরাও উচ্ছিষ্টের প্রত্যাশী। তাই অমানবিক হয়ে অযথা দীর্ঘায়িত করে চলেছেন এই অনৈতিক যুদ্ধ। কেভিন কার্টারের বিবেক ছিল, তাই তাঁর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি মানসিক ভাবে অস্থির হয়ে আত্মনিধনের পথ বেছে নেন। কিন্তু বাংলা ও দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতিদের ধমক খেয়েও কমিশন ও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও হেলদোল নেই। শকুনদের দু’ কান থাকে না।


2 comments:

  1. একদম সত্যি‌‌ কথা।
    আমরা সাধারণ মানুষ ‌‌হলাম যেন‌ আগাছা।
    হাসপাতালে বেড নেই, অক্সিজেন নেই, রেমডিসিভির নিয়ে কালোবাজারি।
    শেষ তিন দফা ভোট তবু একসাথে ‌হলনা।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লেখা । 🌹

    কিন্তু আমাদের চারপাশে অসংখ্য শকুন ঘুরে বেড়াচ্ছে; তাদেরকে তাড়াতে না পারলে আরো
    খারাপ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের সবাইকেই । ☹️

    আশিসদাকে এবং একক মাত্রাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।

    ReplyDelete