Saturday, 17 April 2021

মার্কিন নৌবাহিনীর মাতব্বরি

ইতিহাসের চাকা ঘুরছে?

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


 

দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে বিশ্বের রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক পালাবদলের সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করা যায় না। বিশেষ করে সেই যুগে যেখানে প্রায় সমস্ত দেশ উদার অর্থনীতির দ্বারা অভিগ্রস্ত। দেশে এখন বিধানসভা নির্বাচনের হেলিকপ্টার উড়ছে, একই সঙ্গে কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ রোজ ভেঙে ফেলছে সমস্ত খতিয়ানের নজির– সেখানে দাঁড়িয়ে ১০ এপ্রিল সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠল একেবারে অন্য একটি বিষয়: আমেরিকার নৌ-বাহিনীর ভারতের লক্ষদ্বীপ অঞ্চলে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ। পাকিস্তানের আক্রমণ হলে হয়তো আরও একটু উত্তেজক পরিবেশ সৃষ্টি হত, কিন্তু পুরনো বন্ধু আমেরিকার তরফে এরকম আচরণ বলেই হয়তো এখনও ব্যাপারটা গণমাধ্যমে দাবানল হয়ে ওঠেনি। 

তাই বলে এই ঘটনাকে কি বিচ্ছিন্ন বা আনকোরা বলা যায়? যায় না। কারণ, বিশ্ব-অর্থনীতির মানচিত্র বদলের ইঙ্গিত হল এই ঘটনা যা বিগত কয়েক দশক ধরে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা বিস্তার করেছে। ‘ইতিহাসের চাকা ঘুরছে’ বলে একটি জনপ্রিয় কথা বেশ প্রচলিত। কথাটিকে যতটা অবহেলার সঙ্গে ব্যবহার করা হয় আদতে তা কিঞ্চিৎ গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। এ-কথা তো অজানা নয় যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এককালে যে-মানবসভ্যতার উত্থান শুরু হয়েছিল তা সময়ের অগ্রগতিতে প্রথমে ইউরোপ ও পরবর্তীতে আমেরিকার শাসকদের কুক্ষিগত হয়। এশিয়া সেখানে যেন নিতান্তই দীনবেশ। কিন্তু এক্ষণে, কোভিড অতিমারির প্রভাবে ইতিহাসের রথচক্র এশিয়ার মাটিতে এসে নিশ্চিত করেছে আগামী আর্থনীতিক দৈত্যের মানদণ্ড। আর এশিয় ভূমিতে ভারতবর্ষ ও চিন হল সেই রাজমুকুটের সর্বপ্রথম দাবিদার। ফলে, আমেরিকার সমাগত পতনকালে সে যে অন্তত একবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে নিজেকে রক্ষা করতে চাইবে সে-কথা বলাই বাহুল্য। আর তাই-ই একদিকে দক্ষিণ চিন সাগরকে কেন্দ্র করে ও অন্যদিকে ভারতের ইইজেড অঞ্চলে বিনা অনুমতিতে আমেরিকার নৌ-বাহিনীর গতায়াত শুরু হয়েছে।

গত বছরের ১৭ জুন, টাইমস নাও-এর একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে, 'শি বোধহয় ২০২০ সালটিকে আর্থনীতিক দৈত্য হয়ে ওঠার যানে গতিবৃদ্ধির বছর হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সারা বিশ্ব যেখানে করোনা বিধ্বস্ত সেখানে বেজিং এক প্রজন্মে একটি মাত্র সুযোগ হিসাবে এশিয়ার একাধিপতি হওয়া-কে দেখছে ও আমেরিকাকে ধূলিসাৎ করে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছে।' এই সংবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ২৬ ডিসেম্বর বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত একটি শিরোনামে জানানো হয় যে, 'সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ভাবীকথন অনুযায়ী চিনের অর্থনীতি ২০২৮ সালের মধ্যেই আমেরিকার অর্থনীতিকে ছাপিয়ে যাবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষও নিজেকে তৃতীয় সেরা অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।' তাছাড়া আমেরিকা ও ইউরোপের সুবিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সংযুক্ত আরব ও চিনের ব্যাপক বিনিয়োগের ঘটনাও এখন আর অজানা নয়। তাই সব মিলিয়ে এ-কথা অস্বীকার করার আর সুযোগ নেই যে আগামী পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিকনীতি প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই বেশ কয়েকটি দশক জুড়ে এশিয়দের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। 

অয়েলার এহ্রমেসের একটি গবেষণা অনুযায়ী প্রমাণ হিসাবে তিনটি মূল প্রবণতার কথা বলা হয়েছে। প্রথম, ১৯৯০ সাল থেকে ২০০২ সাল অবধি বিশ্ব-অর্থনীতিতে দুটি মূল স্পৃহা- একটি আমেরিকার গতির বিপরীতে অর্থনীতির যাত্রা ও অন্যটি চিনের ওয়ার্ড ট্রেড অর্গানাইজেসনে প্রবেশ, যা একইসঙ্গে বিশ্ব-অর্থনীতির কেন্দ্রকে প্রথম প্রাচ্যাভিমুখে ঠেলা দিয়েছে। দ্বিতীয়, করোনা অতিমারি এই প্রক্রিয়াকে আরও তরস্বান্‌ করেছে কেননা এশিয়া-পেসিফিক অঞ্চলই একমাত্র যারা কোভিডের প্রভাবকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ২০২০-২১ সালের প্রাচ্যাভিমুখী এই গতি ২০১৫-১৯ সালের থেকে ১.৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ও যা ২০২৪ সাল নাগাদ আরও বাড়বে। তৃতীয়, ২০৩০ সালে এই কেন্দ্র চিন, ভারত ও পাকিস্তান সন্নিহিত অঞ্চলে এসে স্থির হবে। 

এই অনুলাপগুলিকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কেননা, চিন ও ভারতবর্ষের হাতে আছে এমন এক অস্ত্র যা বিশ্বের প্রায় কোনও দেশের কাছে নেই। আর তা হল জনসংখ্যা। পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামো এই জনসংখ্যাকে কেবলমাত্র কয়েকটি মাথা হিসাবে নয়, কনজিউমার বা উপভোক্তা বিবেচনা করে। অর্থাৎ, বিদেশের বাজার ছাড়াও এই দেশের অভ্যন্তরেই আছে এক সুবিশাল বাজার যদি এই উপভোক্তা শ্রেণিকে কার্যকরী উপভোক্তা শ্রেণিতে রূপান্তরিত করা যায়। চিন ইতিমধ্যেই প্রযুক্তি ও উৎপাদন শিল্পে বিপ্লব করে ফেলেছে যা দেশের ভেতরের ও বাইরের প্রায় সমস্ত বাজার দখল করেছে। পক্ষান্তরে, ভারতবর্ষেও ‘আত্মনির্ভরতা’ প্রকল্পের ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতীয় ও জাতীয়তাবাদী পুঁজির জন্ম দেওয়া হয়েছে ও পুঁজির পক্ষে বাজার তৈরির মার্গ প্রস্তুত করা শুরু হয়ে গেছে (যে-কারণে নানারকমের জনবিরোধী নীতি, এনআরসি-সিএএ, কৃষিবিল, শ্রম আইন, পিএসইউ বিক্রি, রেলের বেসরকারিকরণ, পরিবেশ বিল ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে)। দ্য রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের তরফেও এই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হয়েছে যা আর্থনীতিক গতার্তবা আমেরিকাকে বিপদে ফেলেছে। তারা ‘ASEAN’ দেশগুলির মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বাণিজ্য চুক্তির মধ্য দিয়ে নিজেদের আর্থনীতিক বৃদ্ধিকে জোরালো করে তুলছে। চিন-জাপান ও জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার আলাদা বাণিজ্যচুক্তি ছাড়াও একত্ব আকারে চিন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নানা দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে যেমন, তেমন-ই জাপানের যানবাহন ও যন্ত্রপাতির প্রেক্ষিতে ব্যাপক উত্থান দেখা দেবে। ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে রফতানি প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে যা ইন্ধন জোগাবে আরও আগ্রাসী বাজার দখলের প্রক্রিয়াকে। শুধু তাই-ই নয়, চিন নিকটবর্তী দেশগুলির মধ্যে অর্থাৎ ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও কিছুটা থাইল্যান্ডের মধ্যে গড়ে উঠবে সাপ্লাই-চেনের সুসংগঠিত বন্দোবস্ত। ফলে, পলিসি-মেকার ও নানা কর্পোরেটের কাছে এই অঞ্চলগুলি আগামী কয়েক দশকের জন্য হয়ে উঠবে বিনিয়োগ ও লাভের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। 

গভীরভাবে দৃক্‌পাত করলে এ-কথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে এই অঞ্চলগুলি প্রায় সবই দক্ষিণ চিন সাগরের নিকটবর্তী এলাকা যেখানে বছরে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হয়। আর তাই এই সমুদ্রাঞ্চলে এখন আমেরিকা অবৈধভাবে তার প্রভাব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে চিন ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও আমেরিকার নজরে সংশয় বৃদ্ধি করছে। তাই সে এখন ভারতকেও যেন ছেড়ে কথা বলতে নারাজ। এই সমস্ত ঘটনা একত্রে তাই একদিকে আমেরিকার টিকে থাকার আগ্রাসী চেষ্টাকে নগ্ন করে দিয়েছে ও অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ফেলেছে গভীর প্রভাব। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগ হোক কিংবা মধ্য বিশ শতক, যখনই আর্থনীতিক এই রূপান্তর ঘটেছে তখনই, সমগ্র দেশ-দুনিয়াব্যাপী অব্যবস্থা প্রবল হয়েছে। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় এখন তাই দেখা যায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ঘটমান জনরোষ, গৃহযুদ্ধ, শাসকের নির্মমতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, অসহিষ্ণুতা ও মানবতাবাদের প্রতি অবমাননার দৃষ্টান্ত। এমতাবস্থায় এই দেশও একই প্রবাহে শামিল, এখানকার শাসকও ব্যতিক্রম নয়। তাই আগামী দিনে জনসাধারণের কাছে আরও বেঁধে বেঁধে থাকা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। হয় এই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে মগজস্থ করে উপভোগ করতে হবে, নয়তো বিমূর্ত এই ঘূর্ণিঝড়ের অলাতচক্র সব কিছু গিলে ফেলবে। 


তথ্যসূত্র:

1. eulerhermes.com/en_global/news-insights/economic-insights/the-world-is-moving-east-fast.html

2. https://www.businesstoday.in/current/world/global-economic-balance-is-shifting-from-us-eu-to-china-india-un-report/story/394064.html

3. https://www.bbc.com/news/world-asia-china-55454146

4. https://www.asianage.com/world/americas/100421/us-navy-challenges-indias-excessive-maritime-claims-at-lakshadweep-islands.html


No comments:

Post a Comment