মহামারীর জরুরি কথা
সোমনাথ গুহ
কলকাতায় গড়িয়ার কাছে রথতলা বাজারের কর্পোরেশন অফিসের সামনে থেকে লাইনটা মাদার ডেয়ারির দোকানের পাশ দিয়ে বিধানপল্লী ব্রিজ পেরিয়ে খালের ওপারে চলে গেছে। তখন প্রায় সকাল নটা। কীসের লাইন? ভ্যাকসিন- এক পরিচিত বললেন। প্রায় সত্তর-আশি জনের লাইনে সবাই শুধু শিক্ষিত ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক এমনটা নয়, দুঃস্থ গোবেচারা গেরস্থও কিছু আছেন যাঁরা ‘বিনা পয়সায় গু’ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব। গু হোক আর যাই হোক তাঁদের কাছে টিকাই ঈশ্বর, টিকাই সেই বিশল্যকরণী যা তাঁদের কোভিড ত্রাসের থেকে মুক্তি দেবে। সেই পরিচিতকে একটু উসকে দিলাম, টিকা নিলেই যে করোনা হবে না এমনটা কিন্তু নয়! তো, সে নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিল, চান্সটা তো কমবে! এই প্রতিবেদক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে আনাড়ী, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে বিশেষজ্ঞরা যাই বলুন মানুষ এমনটাই ভাবছে।
আর ভাববে নাই বা কেন? টিকা এলেই যে ব্যাধিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা গেছে এমনটা তো নয়। মানুষ বুদ্ধু নন, তাঁরা সেটা জানেন। অনেক বয়স্ক মানুষের বাহুতে ছোটবেলায় টিকা নেওয়ার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ এখনও রয়েছে। কিন্তু তা বলে কি তাঁরা কেউ হাম, মাম্পস, চিকেন পক্সে ভোগেননি? কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল নিরীহ। যেটা প্রাণনাশক ছিল সেটা হচ্ছে স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত যেটাকে টিকা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে পারেওনি। এই সব রোগই আজ পঞ্চাশ বছর পরে ইতিহাস হয়ে গেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে কলেরার আবির্ভাবের প্রায় ৬০ বছর পর তার টিকা আবিষ্কৃত হয়। তারপরেও আধুনিক যুগের আগে কলেরার আরও দুটি মহামারী দেখা গেছে- একটি ১৮৮০'র দশকের শুরু থেকে ১৮৯৬ অবধি এবং পরেরটি ১৮৯৯ থেকে ১৯২৩ অবধি। এই দুটি ঢেউ আগের চারটি ঢেউয়ের চেয়ে কোনওভাবেই কম মারণঘাতী ছিল না। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন মহামারী প্লেগের টিকা আবিষ্কার হয় এই সেদিন, ১৮৯৭ সালে। তারপরেও ২৬ বছর বাদে আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ইঁদুর-বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। সুতরাং টিকা এলেই রোগ নির্মুল হয়ে যায় এমনটা নয়, তা সে মাত্র এক বছরের গবেষণায় ধনকুবেরের ভাণ্ডার পূর্ণ করার জন্য তৈরি করা হোক, বা অর্ধ-শতাব্দীর মেহনতের আবিষ্কারই হোক।
ড্যানিয়েল ডিফো তাঁর ‘রবিনসন ক্রুসো’ উপন্যাসের কারণে বিশ্ববন্দিত। তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে খুব কম মানুষই অবহিত। অথচ ১৬৬৫'র লন্ডন প্লেগের ওপর লিখিত তাঁর ‘দ্য জার্নাল অফ দ্য প্লেগ ইয়ার্স’এর উৎকৃষ্টতা সম্পর্কে স্বয়ং গার্সিয়া মার্কেজ উচ্ছ্বসিত। আজ যখন করোনার দাপটে গোটা দেশ টলোমলো, তখন তাঁর এই ডায়েরির শেষাংশ বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হয়। ডিফো লিখছেন, বৃহস্পতিবার যখন সাপ্তাহিক মৃতের সংখ্যা জানা গেল তখন মানুষের মুখের অভিব্যক্তিটা বর্ণনা করা দরকার। তাদের চেহারায় মনে হল একটা গোপন বিস্ময়ের আভাস, একটা পুলক। অপরিচিত লোকেরা, যারা এতদিন মারীর কারণে একে অন্যকে এড়ানোর জন্য বিপরীত রাস্তায় হাঁটত, তারা করমর্দন করল। যেখানে রাস্তা সংকীর্ণ সেখানে মানুষ বাড়ির জানালা খুলে চেঁচিয়ে পরস্পরের কুশল জানল এবং তারপর জিজ্ঞাসা করল ভালো খবরটা তারা শুনেছে কি না? কয়েক জন জিজ্ঞাসা করল, কী সেই ভালো খবর? যখন তাদের বলা হল যে প্লেগের প্রকোপ কমে এসেছে, তারা উল্লসিত হয়ে উঠল, ঈশ্বর করুণাময় বলে উচ্চস্বরে ফুঁপিয়ে উঠল। চিকিৎসকরা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। দেখল রুগিরা সেরে উঠছে, তারা কম ঘামছে, তাদের আর জ্বর নেই, ফোঁড়া ও রক্তিম ব্রণগুলো শীর্ণ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর মাথাধরাটা হ্রাস পাচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যে সবাই সেরে উঠছে।
গত বছরের জুন মাসের শুরুতে আনলক পর্ব যখন শুরু হয় তখন আমরাও হয়তো ভেবেছিলাম এই রকম নাটকীয় ভাবেই করোনা এক দিন আমাদের জীবন থেকে অন্তর্হিত হয়ে যাবে। আমরা ভেবেছিলাম, লকডাউন শেষ মানে কোভিড১৯ শেষ। দেশে নতুন করে আর একজনও আক্রান্ত হবে না, পুরনো রুগীরা সেরে উঠবে। টিভিতে ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা উত্তেজিত স্বরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের জয় ঘোষণা করবে। লোকে দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে, কোলাকুলি করবে। সমস্ত গাড়ি হর্ন বাজাবে, উল্লসিত যুবক-যুবতীরা হুসহাস করে বাইকে চরে বেড়াবে, শিস দেবে, ভেঁপু বাজাবে। অনেকে বাজি ফাটাবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই জীবনযাপন করতে হবে বিশেষজ্ঞরা নিদান দিলেন। অগত্যা কী আর করা? স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে, যদিও একটা অস্বস্তি থেকেই যাবে এবং মাথার ওপরে কোভিড-১৯ এর খাঁড়া ঝুলতেই থাকবে।
কিন্তু এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাসে কোনও মহামারী নেই যা একটা ঢেউয়ের পরেই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। সভ্যতার শুরু থেকেই প্লেগের আবির্ভাব। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই বিভীষিকা বারবার হানা দিয়েছে, সমাজ ছারখার করে দিয়েছে, লাখো লাখো মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মৃত্যুর কারণ হয়েছে। চোদ্দশো শতাব্দীর প্লেগ যা ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে কুখ্যাত তা ইউরোপ উজাড় করে দেয়। মহাদেশের জনসংখ্যার ৪০-৬০ শতাংশ সাফ হয়ে যায়। ক্ষেতে তখন কাজ করার লোক পাওয়া ভার, সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব সংকটে এবং এই সুযোগে গুটিগুটি পায়ে গিল্ড অর্থনীতির যাত্রা শুরু। প্রায় একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু'র কথা ধরা যাক- ১৯১৮'র শুরু থেকে যা ১৯২০'র এপ্রিল-মে মাস অবধি চলেছিল। এই আড়াই বছরে মহামারীর চার চারটি ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সারা বিশ্ব জুড়ে, যার মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউটা ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। মৃতের সংখ্যা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় যে ৪ থেকে ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন যার মধ্যে অন্তত এক কোটি আমাদের দেশে।
মহামারী যখন শুরু হয় তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তুঙ্গে। আমেরিকা সহ ব্রিটেন, ফ্রান্সে সংবাদপত্রে বা রেডিওতে মারী সম্পর্কে একটি শব্দ উল্লেখ করাও ছিল অমার্জনীয় অপরাধ, কারণ তাতে যুদ্ধের প্রস্তুতির ব্যাঘাত ঘটবে, সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়বে। যুদ্ধ নভেম্বরে শেষ হয় এবং শান্তি স্থাপিত হয়। সৈন্যরা সানন্দে গ্রাম-শহরে ফিরে যান আর তখনই মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। ব্যাধি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সৈন্যরা চতুর্দিকে নিজেদের অজান্তেই সংক্রমণ ছড়ায়, মহামারী ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। আমেরিকায় প্রচুর মানুষ মারা যান কিন্তু যুদ্ধের কারণে মারীর খবর ধামাচাপা পড়ে যায়, তাই বলা হয় ‘দ্য প্যান্ডেমিক আমেরিকা ফরগট’। শুধু কি প্লেগ আর স্প্যানিশ ফ্লু? প্রায় দেড়শো বছরে কলেরার সাত সাতটি ঢেউ ছিল, কোনটা কত বেশি প্রাণনাশক ছিল তা জানতে হলে পূর্ণাঙ্গ রিসার্চ করতে হয়। তাই কোভিডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ এসে পড়লে বিস্মিত হওয়ার কী আছে?
গত বছরের জুন মাসে করোনার সংক্রমণ যখন ইতালি, আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রাজিল এবং আমাদের দেশে যথেষ্ট উদ্বেগজনক, তখন বিখ্যাত এবং বিশ্বাসযোগ্য মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’এ একটি লেখা প্রকাশিত হয়: ‘আজকের এই সংকটের সম্মুখীন হলে গান্ধী কী করতেন?’ তাঁরা বলছেন, প্রথমত, মহাত্মা গান্ধী শুধু জ্ঞান দিতেন না, যা বলতেন তা করে দেখাতেন। দ্বিতীয়ত, তিনি স্থানীয় স্তরে কাজ শুরু করতেন, সারা বিশ্বের পেছনে ছুটতেন না। তৃতীয়ত, তিনি এমন কিছু নিয়ে শুরু করতেন যা খুব মামুলি মনে হত, যেমনটা করেছিলেন একমুঠো নুন নিয়ে যা ইতিহাস পালটে দিয়েছিল। তিনি করোনার আতঙ্ক থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেন।
আশার কথা হল, এই কাজটা আজ মানুষ নিজেরাই করছে। মানুষ ঠিক করে নিয়েছে, আর গৃহবন্দী হয়ে থাকা নেই। কোনও লকডাউন আর সে মানবে না, করোনার ভয়ে না খেতে পেয়ে সে মরবে না। সে অষ্টপ্রহর পরিশ্রম করবে, নিজের এবং পরিবারের ক্ষুধা নিবৃত্ত করবে, তাতে করোনা হলে হবে, না হলে না হবে। পত্রিকায় আরও লিখছে, গান্ধী প্রাকৃতিক নিরাময়ের ওপর জোর দিতেন; পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক পড়া, হাত মুখ ধোয়া। লকডাউনের সময় এই যে আমরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতাম, পরিচিত মানুষকেও এড়িয়ে চলতাম, এমনকি অসুস্থ স্বজনের ধারে কাছেও ভিড়তাম না, গান্ধী কঠোর ভাবে এর বিরোধিতা করতেন। তিনি বলতেন, আমার পাড়া আমার দায়িত্ব। ‘আমার প্রতিবেশী আমারই দায়িত্ব। সেটাই আমার স্বধর্ম, আমার কর্তব্য---বিশেষ করে এই সময়ে।’ লেখক লিখছেন, আমার তো সন্দেহ হয় লকডাউনের সময় বিভিন্ন এলাকায় এই ঘেটো তৈরি করার বিরুদ্ধে তিনি হয়তো সত্যাগ্রহ করে ফেলতেন। আর তিনি বিশ্বায়নের বিপরীতে গ্রাম-স্বরাজের ওপর জোর দিতেন। তিনি হয়তো মানবিক সম্পর্কের ভিত্তিতে স্থানীয় উৎপাদন, স্থানীয় বন্টন ও উপভোগ এবং দৃঢ় সৌহার্দ্যমূলক সম্প্রদায় গড়ে তোলার ওপর জোর দিতেন। তিনি আবারও মনে করিয়ে দিতেন, মানুষের যা প্রয়োজন তা সবই প্রকৃতিতে আছে, কিন্তু তাঁর লোভের জন্য কিছু নেই।
আমাদের নেতারা এইভাবে কোনও সমস্যার অনুধাবন করবে এটা ভাববার কোনও অবকাশই নেই। তাই গত বছরের জনতা কার্ফুর সময় দেশে দৈনিক সংক্রমণ যেখানে ছিল ৫০০'র কাছাকাছি সেখান থেকে আজ আমরা ২,৫৯,১৭০ রোজকার সংক্রমণের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত।
অপূর্ব, মন ভাল হওয়ার লেখা! আমার বন্ধুর বিপদে যখন আমি একছুট দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না, এইসময় এই লেখাটা একটা বৃষ্টির মত !!! বাহ্ !!!!
ReplyDeleteখুুব সুন্দর এবং ভীষণভাবে গবেষণা করা একটি লেখা পড়ে ঋদ্ধ হলাম। একটি ইতিবাচক সুরে লেখা এই প্রবন্ধটি সত্যিই সুখপাঠ্য।
ReplyDelete