নেট নাগরিকদের বিশ্বে থাকবে না প্রসন্নর পাঠশালা
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
করোনা পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে তা নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে এখনই বলার সময় আসেনি। তবে আমার মতো অবিশ্বাসীও চায়, পৃথিবীর সব কিছু আগের মতো আবার সচল হয়ে উঠুক। থমকে যাওয়ার গুমোটকে ভেঙে পৃথিবী আবার সরব হয়ে উঠুক, মানবিক হয়ে উঠুক, কর্মমুখী হয়ে উঠুক, নব আনন্দে জাগুক। মানুষের কলরবে মুখরিত হোক আমার প্রিয় শহর কলকাতার অলিগলি রাজপথ। আবার পরস্পর লেপ্টে থাকুক নন্দন চত্বরে। নাট্যোৎসবে। বইমেলায়। আমি চাই সোনালি ডানার চিলের সঙ্গে আবার ডানা মেলে আকাশে উড়ুক উড়ান। বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ভরে উঠুক বহুস্বরে।
পার্কের মাঠে মানব শিশু আর দোয়েলের দেয়ালায় ভোর হোক এক সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর নতুন পৃথিবীতে। আর কলকে ফুল ফুটে ওঠবার আনন্দে মুখরিত হোক আমার উঠোন। আত্মজার মতো আমাকে ঘিরে থাকুক বৃন্তচ্যুত রক্তকরবী। অতসী আর কাঞ্চন ফুলে লেগে থাকুক ঘুমের কুয়াশা।
আমি জানি, করোনা কাল অনন্তকালীন নয়। এক সময় বিদায় নেবে । বিদায় নেবে অতিমারির নিজস্ব ব্যাকরণেই। দিয়ে যাবে এক স্থায়ী অভিজ্ঞতা। যেমন দিয়ে গিয়েছে স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৮ সালের সেই অতিমারির সময় বাংলার গ্রামে লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। সেই মারির বিদায়ের পর দেখা গেল গ্রামের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদনের ওপর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কৃষি উৎপাদন বিরাটভাবে হ্রাস পেয়েছিল। এবারেও মৃত্যু ও মৃতদেহর পাশাপাশি করোনা আগামী পৃথিবীর যাপনচিত্রে অবশ্যই রেখে যাবে এক চরম বিপর্যয়ের অসংখ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিহ্ন। রেখে যাবে অসহায়তার নামাবলী। রেখে যাবে পরিযায়ী শ্রমজীবী মানুষের প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা আর রক্তমাখা পদচিহ্ন।
আমাদের চারিদিকে তাকালেই দেখতে পাব, যার হাত আছে তার কাজ নেই, যার কাজ আছে তার মাইনে নেই, যার হাত, কাজ দুটোই আছে তার ভাত নেই। ছাঁটাই চলছে নির্বিচারে। চলবেও। এক রুগ্ন ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন। আমাদের মতো দেশে গ্রামীণ সমাজে বিশাল উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি আছে। এই উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তির পুরোটাকেই গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে এসে শিল্পশ্রমিক হিসেবে কাজে নিয়োগ করা তখনই সম্ভব যখন শিল্পোৎপাদনের পরিকাঠামো পর্যাপ্ত। আর সেটা থাকলে কৃষি উৎপাদনের ওপর কোনও নেতিবাচক প্রভাব সাধারণত পড়ে না। কিন্তু সেই শিল্পসম্মত চেহারা পুরোপুরি পরিস্ফুট হওয়ার অনেক আগে এসে গেল করোনা অতিমারি। ফলে, গ্রামীণ উদ্বৃত্ত শ্রমিক আমাদের মতো দেশে করোনা ঝড়ে ঝরে গেল। অথচ বাকি অবস্থা থাকবে যে কে সেই । আমাদের লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, আমলা ও ক্ষমতাসীনরা এর থেকে কোনও শিক্ষা নেবে এমন আশাবাদী আমি নই।
এমনকী, এই অতিমারি আমাদের মতো দেশের গণ চিকিৎসার পরিকাঠামোর রিকেটি চেহারাটা লাইমলাইটে নিয়ে এল। আমরা দেখলাম, স্রেফ চিকিৎসার অভাবে মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেল। তবু আমি নিশ্চিত, এই উপমহাদেশে গণচিকিৎসা ব্যবস্থাকে যেমন সুপরিকল্পিত ভাবে ধবংস করার যে আয়োজন এতদিন চলেছে সেখানে কোনও ছেদ পড়বে না বরং সেই প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে। পুঁজির অমিতবিক্রমে অবশিষ্ট স্বাস্থ্য পরিকাঠামোও পুরোপুরি চলে যাবে আমজনতার ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিজের জীবনকে চড়া দামে কেনার ক্ষমতা যাঁদের থাকবে না, এই সমাজের মতো আগামী সমাজেও তাঁদের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার থাকবে না।
অনেক দেশেই করোনা-পরবর্তী সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। মারিতে বেঁচে যাওয়া বিশেষজ্ঞরা দেশ পুনর্গঠনের স্বরূপ কী হতে পারে বা কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চালাচ্ছেন। কেউ রাষ্ট্রীয় স্পনসরশিপে, কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে। মন্তব্যও করছেন কেউ কেউ। এই অর্থনীতিবিদরা, সমাজতাত্ত্বিকরা তাঁদের বুদ্ধি, মেধা ও অভিজ্ঞতাকে খনন করে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব উপস্থাপনা করেন। তবে বেশির ভাগ তাত্ত্বিকরাই আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। তবু বলব, অতিমারি বা মহামারি জন্ম দেয় তেমন তাত্ত্বিকেরও। যেমন দিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু'র পরবর্তী বিশ্বে মহামন্দার সময় জেএম কেইনসকে। যিনি তাঁর ভাবনা ও অনুভূতির তাত্ত্বিক কাঠামো দিয়েছিলেন ‘A General Theory of Employment, Interest and Money’ বইতে।
তবে তত্ত্বেই তত্ত্বের শেষ। বাস্তবে আমরা ঝুলে থাকি তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের মতো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থে কল্যাণকামী আর্থ-সামাজিক নীতির গভীর অনুশীলন তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অনেক রাষ্ট্র ও তার নেতারা করবেন অঙ্গীকার করেছিলেন। রাষ্ট্রসংঘ ব্যাপ্ত হয়েছিল। তবু কেন বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ প্রাথমিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত। করোনা অতিমারি এসে আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাদের ফাঁপা চেতনা। বস্তুহীন তত্ত্বকথা। তত্ত্বের চর্চা-ভূগোল আজ এক গোলকধাঁধা। কিছুটা এগিয়েই আর অঙ্ক মেলে না। অধিবিদ্যার গ্যাঁজলা উঠতে থাকে। উত্তর-আধুনিক চিন্তার মধ্যেও সেই ফেনা ভেসে ওঠে। ভিত ও উপরিকাঠামোর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক কাটাছেঁড়া করলেও হাতে থাকে পেন্সিল আর দাঁড়ের ময়নাটার ভেঙচানি। করোনা কালের আগে পৃথিবীটা যে খুব ভাল ছিল, মানে সর্বাঙ্গ সুন্দর ছিল এমনটা ভাবি না কিন্তু যা ছিল আমরা কি তাকে আর ফিরে পাব? নাকি আমরা তাকে আবার সেই জায়গাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যাব? নাকি লেনাদেনার সব হিসেব উল্টে দিয়ে আমরা একে নতুনভাবে গড়ে তুলব? যেমনটা বলছেন অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই। অনেকে আবার ভাবছেন করোনা-উত্তর পৃথিবীটা কেমন হবে তার সিদ্ধান্তটা নাকি পুরোপুরিই আমাদের হাতে। পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্কে তা কি সম্ভব? কেননা, লগ্নি ছাড়া কি আদতে কোনও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে?
ধরা যাক শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রটি। অনলাইন শিক্ষাসত্রের কালে আমরা কি কোনওদিন ফিরে পাব সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী'র সেই দৃশ্য! 'অপূর্ব হাসছ যে! এ কী নাট্যশালা।' তুলসী চক্রবর্তীর সেই গলা শুনে অপূর্ব রায় বা অপুর পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। 'পথের পাঁচালী'র সেই অনুপম দৃশ্য। মুদির দোকান কাম পাঠশালা। প্রসন্নর পাঠশালা। যেখানে বিদ্যাচর্চা শুরু হচ্ছে ছোট্ট অপুর। সহপাঠীর হাতে একটা করে বেতের বাড়ি পড়ছে, আর চমকে চমকে উঠছে শ্রীমান অপূর্ব রায়। বা 'কোন দেশেতে তরুলতা— সকল দেশের চাইতে শ্যামল? কোন দেশেতে চ'ল্তে গেলেই— দ'লতে হয় রে দুৰ্ব্বা কোমল? কোথায় ফলে সোনার ফসল— সোনার কমল ফোটে রে? সে আমাদের বাংলা দেশ, আমাদেরই বাংলা রে!' মনে পড়ে, 'অপরাজিত' ছবিতে স্কুল পরিদর্শক এসেছেন, আর শ্রীমান অপূর্ব রায় এই কবিতাটি পাঠ করছেন! অপুর গলায় সেই পাঠ শুনে বিগলিত স্কুল পরিদর্শক অভিনেতা মণি শ্রীমানী। না, আমরা বোধহয় এসব দৃশ্য আর দেখতে পাব না। দেখতে পাব না কেননা, করোনামণ্ডলের মধ্য দিয়ে আমরা একটা নতুন জগতে প্রবেশ করতে চলেছি, যেখানে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে কোনও আত্মিক সম্পর্ক থাকবে না। সবটাই হবে ভার্চুয়াল। অ্যাপের মাধ্যমে। রক্তমাংসের শিক্ষক ও পড়ুয়া এখন ব্যাকডেটেড। কোনওরকম দৈহিক নৈকট্য বা মানসিক একাত্ম- থাকবে না। ফলে শিক্ষক বা শিক্ষয়ত্রী যে ব্যাপকার্থে আমাদের বাবা-মা, সেই ধারণাটাই লুপ্ত হতে চলেছে। এটা মেহসুস করার ব্যাপার, কোনও চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক সংস্কার নয়।
বাস্তব হচ্ছে, এই শিক্ষক ও পড়ুয়ার মধ্যকার এই সমীকরণটি অনেকদিন ধরেই আলগা হয়ে আসছে। শিক্ষার অঙ্গনে যত বেশি ব্যক্তিগত পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছে ততই এই সমীকরণ আলগা হয়ে পড়েছে। তবু একটা জিনিস অক্ষত ছিল, সেটি হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে সাম্য। অনলাইনে পাঠ দেওয়া শুরু করে এবার সেই সাম্য বিনষ্ট হওয়া শুরু হয়ে গেল। করোনা পরিস্থিতিতে এখন শিক্ষা পদ্ধতি চালু রাখার অন্যতম উপায় অনলাইন ক্লাস। নানা অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে এই ক্লাস। মানে, ওয়ান ইজ টু ওয়ান মেথড, ডাইরেক্ট ইন্টারেকশন আর থাকবে না। পড়ুয়া ও শিক্ষকের মাঝে এক অদৃশ্য অচলায়তন। তুমি দেখতে পাচ্ছ, ছুঁতে পাচ্ছ না। শুনতে পাচ্ছ, কিন্তু শ্রুতি নয়। রক্তমাংস-পেশির মাস্টারমশাই হয়ে যাচ্ছেন বিগ্রহের মতো। এই অনলাইন শিক্ষাসত্র নিয়ে ভিন্ন চিন্তার ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের আপত্তি ইতোমধ্যে নানা স্তরে নানা দেশে জানাতে শুরু করেছেন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষা বিতরণ হলে সেটা নিশ্চিত ভাবে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’। আবার দক্ষিণপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো অনলাইনের পক্ষে সওয়াল করছে। হয়তো, কেউই পূর্বাপর ভেবে কিছু করছে না, স্রেফ বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা, সমর্থনের জন্য সমর্থন।
No comments:
Post a Comment