এখন জীবন বেঁধেই চরিতার্থ
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে পেয়ে বাংলার সংস্কৃতির ওপর কিছু রাজনৈতিক দল যেন নামিয়ে এনেছে এক বিধ্বংসী আক্রমণ। অথচ আমরা চিরকাল বলে এসেছি যে আমাদের সংস্কৃতি আমাদের গর্ব, যা আমরা হারাতে চাই না; শুনে এসেছি, শহর মুম্বই যদি বাণিজ্য-রাজধানী তো আমাদের এই কলকাতা নিশ্চিত ভাবে দেশের সংস্কৃতি-রাজধানী। শুনেছি, একজন প্রধানমন্ত্রী নাকি তা স্বীকারও করেছেন এবং এও বলেছেন– কলকাতা মিছিল নগরী। তাতেও আপত্তির কিছু পাইনি। কেবল মাথায় রেখেছি যে কেবল কলকাতা নয় সারা বাংলাই তার সংস্কৃতির জন্য গর্ববোধ করে। সত্যি তো, আমরা বাঙালিরা মিছিলে, আন্দোলনে, বিক্ষোভে আছি এবং থাকতে ভালবাসি। কেউ কখনও বলেছেন: What Bengal Thinks Today... গর্বে আমাদের বুক ফুলেছে। পেটও। তাই সব্বাইকে ডেকে ডেকে প্রায়ই সে কথা কানে কানে আর প্রাণে প্রাণে বলেছি। এই সেই বাংলা– আমরা এখানে সন্ত্রাস দেখেছি, গান্ধিবাদী অহিংস আন্দোলন দেখেছি, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, দেখেছি উদ্বাস্তু স্রোত, দেখেছি ‘গ্রেট কলকাতা কিলিং’, আমফান বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু সংস্কৃতি? তাকে ম্লান হতে দিইনি, ‘সংস্কৃতি আমার’ উচ্চে তুলে নেচেছি কত, কতজনকে নাচিয়েছি। সাম্প্রদায়িকতা নেই, এই রাজ্যে সকলে স্বাগত, উত্তরপ্রদেশ থেকে ভিয়েতনাম হোক বা ওয়াশিংটন বা তিয়েন-আন-মিয়েন– যেখানে দেখেছি মানবতার ওপর কোনও আক্রমণ আমরা প্রতিবাদ করেছি। আমাদের কী হল যে আজ সংস্কৃতি, অন্তত আমাদের বোধে, এমন বিপন্ন?
আমার স্থির বিশ্বাস, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া প্রলয়ঙ্করী কিছুই হঠাৎ হয় না। এই বিপন্নতারও শুরু আছে, কারণ আছে। সে সব কথা অল্প হলেও স্মরণ করি পরে। আগে দেখে নিই, নিজেদের এমন বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে কেন? আলোচনা যখন সংস্কৃতির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তখন তার নানা দিক বিবেচনা করা ভালো। এমন কিছু দিক বেছে আমাদের আলোচনা শুরু করা যাক।
১) ভাষা সংস্কৃতি
ঢাকায় ওপার বাংলার বরকতরা প্রমাণ রাখলেন বাংলা ভাষার প্রতি তাদের আন্তরিক ভালবাসা– গুণ্ডা আয়ুবী সেনার গুলিতে তাঁরা প্রাণ দিয়ে শহীদ হলেন। সেই শেষ নয়, অসমের শিলচরে (বরাক উপত্যকা) ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার ন্যায্য মর্যাদা চাইতে গিয়ে প্রাণ দিলেন আরও ১১ জন। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে পুষ্পস্তবক পাঠিয়েছিলেন উল্লাসকর দত্ত আর আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা ক্ষোভে-দুঃখে মিছিল করেছি, সভা করেছি।
ওরা অসমে, ওপার বাংলায় দাবি আদায় করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস রূপে পালিত হয় দেশে দেশে। অসম সরকার বাংলা ভাষার দাবি মেনে নেয় সেই আন্দোলনের পর। আমরা উল্লাসে ভেসেছি। আন্তর্জাতিক গেয়েছি, ভুলেছি দেশভাগের জ্বালা। অথচ আমরাই এই রাজ্যে তার সংস্কৃতির ওপর ভিন রাজ্যের খবরদারিও মেনেছি। দোকানে-বাজারে-রাস্তায় স্বেচ্ছায় হিন্দি বা ইংরেজির আধিপত্য মেনেছি, আধিপত্য মেনেছি প্রশাসনে, শিক্ষায়, পরিবহনে। বদল ঘটিয়েছি সাহিত্যের ভাষায়। উত্তর কলকাতার নানা ঐতিহ্য হারিয়েছি দিনে দিনে।
মনে পড়ে বিধান রায় এক নির্বাচনের প্রাক্কালে কর্মীসভা করতে চেয়েছিলেন সেদিনের সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে। মুসলমান অধ্যক্ষ তাঁর সে প্রস্তাব খারিজ করে দেন। এখন এমন সমস্যা দেখা দিলে ডাক পড়ে নির্বাচন কমিশনের।
এই সেদিনও সবাই ভয় পেতেন এই কমিশনকে ও এমনকি তার সম্ভাব্য নিষেধাবলীকেও। কোথায় কী? কে বলছে কন্ডোম বিক্রির কথা (এমন অসভ্য কথা প্রথম শুনছি এমন নয়, এক নেতা বলেছিলেন ‘গুলিতে কি নিরোধ লাগানো থাকে'। বলেছিলেন এবং তারপরও তিনি দীর্ঘকাল নির্বাচকমণ্ডলীর নয়নের মণি হয়ে থাকতে পেরেছেন। যিনি ‘কন্ডোম’ প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি আর তেমন কী দোষ করলেন? তবে, মহিলাদের মুখে এই প্রসঙ্গে কিছু শোনায় আমরা আজও তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, এই যা। তবে এ নিশ্চয় আমাদেরই দোষ!), ‘সুনার বঙ্গাল’ গড়তে চাওয়া প্রধানমন্ত্রী বলছেন পঁদে ছাপ দিন, কে বলছে খেলা হবে, কে পা দেখাচ্ছেন, হোঁদলকুতকুত বলছেন, কে কোন মহিলাকে বারমুডা পড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন– নির্বাচন কমিশন দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না– সে যেন এক অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, সঞ্জয়ের ভাষ্য না শুনলে তার চলবে না। আমাদের সংস্কৃতিতে এসব ছিল কী? রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে?
২) প্রশাসনের সংস্কৃতি
একটা সময় ছিল, এই তো সেদিন, যখন দেশের প্রশাসন ছিল সংবিধানের এক প্রধান স্তম্ভ, তাকে বলা হত ‘Steel Frame’। এখন সংবিধানই তার মর্যাদা হারাচ্ছে শাসক দলের প্রতাপে, কোথায় বা সেই ‘স্টিল ফ্রেম’? এখন সর্বত্র প্লাস্টিক। বিয়েবাড়িতে দেখেন না? ‘সে সব দিন দিনে দিনে হারিয়ে কোথায় গেল কে জানে’– এখন কিছু মূর্খ সবজান্তা ভাব করে চেয়ারে বসে থাকে, ছড়ি ঘোরায় আর নিজ স্বার্থ সুরক্ষিত হওয়ার অঙ্ক কষে। তারা প্রশাসক। এরা না জানে বিষয়, না ভাষা। সংবিধানের মূল সুর এরা গ্রাহ্য করে না। নির্লজ্জ চাটুকারিতা প্রকাশে তারা প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের কোনও ছোট মন্ত্রী চাইলে তার জন্য নিজ আসন ছেড়ে উঠে পড়ে, সৌজন্য দেখানোর নামে তারা নেতাদের আলোকবৃত্তে ঘুরঘুর করে আর অন্যদিকে গরিব, শ্রমিক-কৃষকদের দূর-দূর করে তাড়ায়। নিজেদের মধ্যেও রেখেছে জাতপাতের বেড়া।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে যে ভাষায় বা ভঙ্গিতে তাদের সঙ্গে কথা বলেন তাতে তারা লজ্জা পায় না। যেমন লজ্জা পায় না তারা তাদের বাংলা ভাষার জ্ঞান নিয়ে। তারা পঁদ আর পদ্মের তফাত বোঝে না, বুঝতে চায় না। কমিশন এই সব প্রশাসকের অজ্ঞতার আড়ালে প্রয়োজন মতো মুখ ডোবায়।
যেদিন রঞ্জন গগৈ মহাশয় বসলেন প্রধান বিচারপতি পদে, সেদিন থেকে অন্তত আর এক সাংবিধানিক স্তম্ভ ভেঙ্গে পড়ল। দেশ বিক্রি হয়ে যায়, গণতন্ত্র হার মানে স্বৈরতন্ত্রের দাপটে, বিচারব্যবস্থা দেখে শুধু দেখে। দেখে প্রধান কর্তার মুখ– তিনি যেমন নড়াচড়া করতে বলেন বিচারব্যবস্থা তেমন নড়েচড়ে, সেদিকে হেলে।
৩) রাজনৈতিক সৌজন্য ও রাজনীতির সংস্কৃতি
গণতন্ত্রের অনেক সুবিধা যেমন আছে তেমন অসুবিধাও আছে কিছু। মুখ্যমন্ত্রী যখন বিমানবাবুদের নিজ দফতরে ডেকে ‘কাটলেট’ খাওয়ান তখন তা নিশ্চয় রাজনৈতিক সৌজন্য বা তিনি যখন অসুস্থ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় যান তা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করি কেন? আমরা কি রাজনৈতিক সৌজন্য ভুলতে বসেছি? নিশ্চয় তাই এবং তা নির্বাচনের আগেই।
একবার মুখ্যমন্ত্রীর খাস কামরায় বসে কথা বলছি। মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র তাঁকে প্রশ্ন করলেন, মেট্রো চ্যানেলে সভা করা নিষিদ্ধ করলেন কেন? সেই মেট্রো চ্যানেল যেখানে আমরা ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম’ পর্বে এবং তার আগেও অনেক সভা করেছি। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, গান্ধিমূর্তির তলায় সভা করুন না। সুজাত বললেন, ওখানে তো আমি বললে কেবল আপনি যেতে পারেন শ্রোতা হতে, আর তো কেউ যাবে না। আলোচনা ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে ফুরলো। কিন্তু অনুচ্চারিত সেই রাজনৈতিক সৌজন্যর প্রশ্ন থেকেই গেল। এখন আর মেট্রো চ্যানেলে পথসভা থেকে বিতর্কসভা কিছুই হয় না। ৭ জুলাই অবশ্য নিয়মের বাইরে ছিল চিরকাল এবং তা থাকবে, রাজনৈতিক সৌজন্যর প্রশ্ন ভুলে। যখন বিজেপি রাজ্য সভাপতিও বলেন, আরও শীতলকুচি হবে তখন আসলে যে সংকুচিত হয় রাজনীতির সংস্কৃতি এ কথা বোঝায় কে?
৪) সংবাদমাধ্যমের সংস্কৃতি
অসভ্যতা বা অসংস্কৃত আচরণে সকলকে ছাড়িয়ে গেছে সাংবাদিককুল তথা সর্বপ্রকার সংবাদমাধ্যম। মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চারটি যুবক– যেন এমন উদ্ধত কথা শুনেছি যৌবনে আর প্রৌঢ়ত্বে এসে দেখি রাজ্য শাসন করে চার সাংবাদিক! তাঁরা তখন অনায়াসে ঢুকে পড়েন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে, তাঁদের কেউ চিটফান্ড কেলেঙ্কারির নায়ক, কেউ বা দলবদলু বলে খ্যাত আজ। সে সব থাক, কিন্তু সততা? এই রাজ্যরই একজন ছিলেন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। আমরা পেয়েছি গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তদের। তাঁদের ফেলে যাওয়া স্থান এখন দখল করেছেন এমন কিছু লোকজন যারা সততা, নীতি, নিষ্ঠা, একাগ্রতার মূল্য বোঝেন না। কিন্তু তাঁদের পোশাকের মতোই আধুনিক তাদের কথা বলা বা লেখার ভঙ্গি। তাঁরা জল মিশিয়ে মিশিয়ে বাংলা ভাসাতে চান যেন। মালিক যা চান, যেমন চান, তেমনটি পরিবেশনের দায় কাঁধে তুলে নেন এই নব্য সাংবাদিককুল। প্রয়োজনে সংবাদ বিকৃত করেন তাঁরা (একই খবর পাঁচটা কাগজে পাঁচ রকম), অথবা ছাপা বা দেখানোর চেয়ে চেপে যাওয়ার কৌশলে ব্যস্ত থাকেন বেশি, সংবাদের চেয়ে বড় জায়গা ছেড়ে দেন ভাষ্যের জন্য (নিউজের চেয়ে ভিয়্যুজ বেশি!)। তাতে কী? আমরা তাঁদের গেলানো বা খাওয়ানো গপ্পো নিয়ে তক্কো জুড়ি অফিসে আদালতে রেস্তোরাঁয় ক্লাবে (রক তো আর নেই!)।
৫) অর্থনীতির সংস্কৃতি
কিছু শিল্পে বাংলা দেশের অন্য প্রান্তের তুলনায় এগিয়ে ছিল। তার ঐতিহাসিক কারণগুলি আমরা এই আলোচনায় রাখতে পারছি না। কিন্তু এও তো সত্য যে, এই শিল্পগুলি গড়ে ওঠে যে সব অঞ্চলে সেখানে ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদের আনাগোনা বেশি এবং তার প্রভাব পড়েছে সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতিতে। সে শিল্পগুলি অনেকাংশে ধুঁকলেও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব মুছে যায়নি, তা যাবার নয়। বিশ শতকের শেষাংশে হাজির হয় বাজার অর্থনীতি। তার প্রভাব পড়ে সাংঘাতিক এবং তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। লোভের ফাঁদ পাতা হয় বিশ্ব জুড়ে, এ কালের শহুরে যুবক-যুবতীরা অনলাইন বা শপিং মলে কেনাকাটা করে আবার তারাই আদানি-আম্বানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়! তারা বিশ্বাস করে জিডিপি কমা বাড়ায়। তাদের বিশ্বাস করানো হয় কর্মসংস্কৃতির নামে। বাজার নিজেই যেন বিশ্বাস করে যে জিডিপি দিয়ে মাপা যায়! তাই বাজারে হিসেবে অন্য পাঁচটা মাপযোগ্য রাশির মতোই সংস্কৃতিও এক মাপযোগ্য রাশি মাত্র! হায় জিডিপি! হায় সংস্কৃতি!
জিডিপি দিয়ে মাপা যায় না সুখ, শান্তি, অসাম্য। এসব নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই এখানে তাই ছেড়ে যেতে হয়, মানতে হয় জিডিপি দিয়ে দেশের ভালোমন্দ বিচার; ছেড়ে যেতে হয় ক্ষুধা, অশিক্ষা ও দারিদ্র চেপে, ভুলে যেতে হয় গান্ধি-রবীন্দ্রনাথের গ্রাম পুনর্গঠন বা গ্রামীণ অর্থনীতির কথা।
৬) শিক্ষা ও সংস্কৃতি
আইআইএম ও আইএসআই কৃত সমীক্ষায় স্পষ্ট হয় (বিশ শতকের শেষ দশকের আগেই), যে এই রাজ্যের অভিভাবকরা চান তাঁদের সন্তানরা শিক্ষান্তে নিযুক্ত হন হোয়াইট কলার বৃত্তিতে বা উন্নীত হোন ‘বাবু’ শ্রেণিতে। সে সময় সরকার বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি এই তথ্যে, উল্টে তারা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে মন দিয়ে সমস্যা চাপা দিতে ব্যস্ত হয়েছে। এই উল্টোপথে হাঁটা বা বাস্তবকে অস্বীকার করে এগোনোর যে চেষ্টা, তার ফল ভালো হয়নি। ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর তা চরম আঘাত হেনেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও কী তার প্রভাব ইতিবাচক হয়েছে? তা হয়নি। স্বাধীনতার সময় সাক্ষরতায় যে রাজ্য দেশের চতুর্থ রাজ্য বলে স্বীকৃত ছিল তা শতক শেষে ১৮-২০ নম্বরে নেমে যায়। তারপর আরও আরও নীচে। একটা কারণ নিশ্চয় এই যে, অন্য বহু রাজ্য দ্রুত লয়ে এগিয়েছে, আমরা এগোলেও সেই লয়ে চলতে পারিনি। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ ছিল না। আমরা আধুনিকতা আর ইংরেজি শিক্ষাকে সমার্থক ধরেছি, শিক্ষা বাণিজ্যকীকরণ বা বেসরকারিকরণে আমাদের দ্বিধা ছিল স্পষ্ট। এখানে আর কিছু বলার লোভ সংবরণ করতেই হচ্ছে।
অন্যদিকে, সদ্য পেরিয়ে আসা শৈশব বা সদ্যপ্রাপ্ত যৌবনে ছেলেমেয়েদের বিশেষত ছেলেদের অশ্লীল শব্দের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ রোধে সমাজও তেমন জোর দেয়নি। সমাজ ও সাহিত্যের ভাষাতে তা স্পষ্ট হয়। বঙ্কিম বাংলার সেরা ঔপন্যাসিক। তিনি লিখতেন মাগী, এ কালের সমাজ ও তার অনুসারী সাহিত্য শব্দটি বাতিল করে। একটা গল্প বলি।
এক ভদ্রলোক তার প্রিয় বন্ধুকে বললেন, কেমন আছে আপনার মেয়েছেলেরা? বিষণ্ণ বদনে তিনি বললেন, যেমন আছে আপনার বাগানবাড়ি। মারামারি লাগেনি যে তা দুজনেরই কপাল ভালো বলে বোধহয়। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলে বোঝা যায়, একজন জানতে চেয়েছেন কেমন আছে আপনার ছেলে মেয়েরা? প্রশ্নকর্তা যিনি তাঁর বাগানও আছে, বাড়িও। কিন্তু তাঁর নেই কোনও বাগানবাড়ি! তাঁর রাগ হবে না? হয়েছে এবং তাঁদের বন্ধু বিচ্ছেদ কেউ ঠেকাতে পারেননি।
মেয়েছেলে, মেয়ে মানুষ শব্দগুলিও বাতিল হয়েছে শহরাঞ্চলে আর শহুর সভ্যতার অনুসারী সাহিত্যেও। আরও কিছ শব্দ বাতিল হয়েছে যথা, ঝি, চাকর ইত্যাদি সমাজে এবং সাহিত্যেও (রবীন্দ্রনাথ পূজ্য হওয়া সত্ত্বেও)। আমরা কী তাতে আরও সভ্য হয়েছি? না, আরও দীন হয়েছে আমাদের সংস্কৃতি?
৭) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সংস্কৃতি
একদা এই রাজ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হত। বিশ শতকে সেই সব নিয়ন্ত্রণ বিসর্জন দিয়ে সরকার নিজের অক্ষমতা ঢাকতে তাদের সমাদরে বুকে টেনে নিল। তারা তো সেবা করতেই চায়, সেবার জন্য অর্থ আনে দেশ-বিদেশ থেকে। বহু বেকার যুবক-যুবতী চুক্তিতে সেবা করে, অর্থও জোটে। কিন্তু সবটাই যেন শর্তসাপেক্ষে, চুক্তিতে। চুক্তিতে সেবা! শিক্ষিত, পরিশীলিত বামপন্থায় বিশ্বাসী এক সরকারও বাজারের নিয়ম মেনে চুক্তিতে সেবাকর্মে নিয়োগ শুরু করে। অসংগঠিত ক্ষেত্র বাড়তে বাড়তে তা সংগঠিত ক্ষেত্রগুলিও দখল করতে থাকে। কত চাকরি! সরকারের নাম হয়, প্রভাব বাড়ে। প্রভাব বাড়ে কারণ তাদের নিয়োগ যে চুক্তিতে! ট্যাঁফোঁ করলেই চাকরি নট। এভাবে আনুগত্য কেনা হয়। মেরুদণ্ড কেড়ে নেওয়া হয়। এমনটা ছিল নাকি আমাদের সংস্কৃতিতে?
ভয়ংকর হয়ে উঠেছে আমাদের এপার বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এরা আর পথ দেখায় না, পথ চুরি করে যেন। করে নিজের জন্য। এই তো সেদিন যে দলীয় শৃঙ্খলা বা আনুগত্যের অজুহাতে ধর্ষণ বা খুনের সাফাই গেয়েছে, যাত্রাপাড়া থেকে সিনেমাপাড়ায় নেচেগেয়ে পয়সা তুলেছে, তাদেরই কেউ কেউ এখন ছবি বিক্রির এজেন্সি (ছবি আসল না নকল কে জানে? যে জানে সে এমন ব্যবসাতেই থাকে না) ব্যবসা বা আরও কাজ পাবার লোভে কর্তাদের খোশামোদ করছে। কে পুরস্কার পেতে ঘুষ দিচ্ছে, পদ আঁকড়ে থাকতে শাসকের গুণকীর্তন করছে। কে চেয়ার পেতে চেয়ার মুছছে, কে গান গেয়ে বাগিয়ে নিচ্ছে মন্ত্রীপদ (দলিত বা নিচু জাতের বিরোধী হয়েও), কে সেবা করার অজুহাতে দল বদলে ফেলছে। আসলে যে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে মানুষের, তারা সে খবর রাখে না। মানুষের খবরই তারা রাখে না।
পিকে ব্যানার্জি নাকি গ্যাস খাইয়ে এশিয়াডে ভালো ফল চাইতেন। ফুটবলাররা বারবার গ্যাস খেতে চায়নি, চায় না। কিন্তু আমরা চাই। সুনার বঙ্গালের লোভ দেখাতেই ছুট লাগাই অলীক সোনার হরিণের পেছনে।
আমরা জাতপাত, ধর্ম বিচার মানি না। কিন্তু ...
আমরা গণতন্ত্র ভালবাসি, আস্থা রাখি সংবিধানে। কিন্তু ...
আমরা কানাইলাল, ক্ষুদিরামের ভক্ত, তবু আমরা অশান্তি চাই না। কিন্তু ...
আমরা বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ'র মাটির লোক। কিন্তু ...
এমন ছিল না চিরদিন। আমরা কালোকে কালো বা সাদাকে সাদা বলতে জানতাম। তাই তো কেউ বাংলার প্রশংসা করলেই আমরা খুশি হয়ে তার কাঁধে চেপে বসতাম না। সেটাই ছিল আমাদের সংস্কৃতি। সে সব দিন দিনে দিনে হারিয়ে কোথায় গেল কে জানে? ...
এখন জীবন বেঁধেই চরিতার্থ।
যেন বিবেক এ একটা ঝাঁকুনি বোধ হোলো,
ReplyDeleteঅনন্য লেখা