শেখানো হচ্ছে দুই আর দুইয়ে পাঁচ
শোভনলাল চক্রবর্তী
দুই আর দুইয়ে যে চার হয়, সে আমরা সকলেই জানি। তাহলে দুই আর দুইয়ে পাঁচের প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে? দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বুকে যেখানে যখনই একনায়কতন্ত্র জেগে উঠেছে, তারা মানুষকে এই উল্টো হিসাব শিখিয়েছে। এবং ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ তা বিশ্বাস করেছে এবং অনেক পরে নিজেদের ভুল যখন বুঝতে পেরেছে তখন তারা সব হারিয়ে খাদের কিনারে।
মার্টিন হুইটক তাঁর বিখ্যাত 'এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ দ্য থার্ড রাইখ' গ্রন্থে সর্বপ্রথম বর্ণনা করেছিলেন কীভাবে মানুষকে ক্রমাগত দুটি বিপরীতধর্মী বক্তব্যে ডুবিয়ে রাখতে পারলে তাদের দিয়ে যা খুশি তাই বিশ্বাস করানো যায়। যেমন, হিটলার বলতেন যে তিনি পুঁজিবাদ এবং মার্কসবাদ দুটিকেই সমান ঘৃণা করেন। অথচ এই দুটি মতবাদ একেবারে বিপরীতধর্মী। মানুষকে বোঝানো হয়েছিল যে ইহুদীরাই বিশ্বের পুঁজিবাদকে চালনা করছে, অন্যদিকে স্বয়ং মার্কস ছিলেন ইহুদী এবং ইহুদীরাই জার্মান জাতীয়তাবাদের মূল শত্রু। অতএব, দুটি বিপরীত মেরুর ধারণাকে স্রেফ ইহুদী বিদ্বেষ দিয়ে যুক্ত করে দেওয়া গেল এবং মানুষ এই ইহুদী ষড়যন্ত্র মেনে নিল।
এই যে মানুষকে দিয়ে মানিয়ে নেওয়া, এই সর্বাধিপত্যকামী একনায়কতন্ত্রের অস্ত্রের নাম জার্মান ভাষায় 'স্বওই ট্রাই' যার বাংলা করলে হয় 'দ্বিভাগ বিশিষ্ট ভাবনা' বা ইংরেজিতে 'ডবল থিংক'। হিটলার যেটা সর্বদাই করতেন- একই সঙ্গে জানা এবং না-জানা, একই সঙ্গে সত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও মিথ্যার জাল বোনা, পরস্পর বিরোধী কথাকে একই সঙ্গে উচ্চারণ করে চলা এটা জেনেও যে কথা দুটি পরস্পর বিরোধী এবং একই সঙ্গে দুটো কথাতেই বিশ্বাস করে চলা। নৈতিকতার দাবি করা, অথচ কাজে নৈতিকতাকে পায়ের নিচে পিষে ফেলা, একই সঙ্গে মনে করা যে গণতন্ত্র অসম্ভব এবং এই শাসকেরাই গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। প্রয়োজন অনুসারে কোনও কথা ভুলে যাওয়া এবং প্রয়োজন পড়লে ফের তাকে স্মরণে নিয়ে আসা। সোজা কথায়, একনায়কের মনমতো একটি 'বাস্তব' নির্মাণ করে চলা।
উপরের প্রতিটি বাক্য যে আমাদের আজকের ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদীরাও অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে তা একটু চোখ, কান খোলা রাখলেই বোঝা যাবে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যে বিজেপি'র আইটি সেল সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে দিয়েছে একটি তথ্য দিয়ে। তা এই, মুসলমানদের মধ্যে জন্মের হার এতটাই বেশি যে বছর তিরিশের মধ্যে ভারতের কোনও রাজ্যে আর কোনও হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী পাওয়া যাবে না। বহু শিক্ষিত মানুষ এই মেসেজটি শেয়ার করছেন, অথচ কেউ একবার হিসেব করে দেখছেন না যে বর্তমান জন্মের হারে ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের সমান হতে কম করে ২২০ বছর লাগবে। সেটাও বাস্তবে সম্ভব নয়, কারণ ভারতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই জনসংখ্যার হার ক্রমশ নিম্নগামী। এই বাস্তব পরিস্থিতি গুলিয়ে দেওয়াই দ্বিভাগ বিশিষ্ট ভাবনার প্রধান কাজ। এর জন্য দুটো জিনিস দরকার:
প্রথমত, একটা জোরালো শত্রুপক্ষ; হিটলারের ছিল ইহুদীরা, আজকের হিন্দুত্ববাদীদের রয়েছে মুসলমানরা।
দ্বিতীয়ত, মানুষের মনে একটা ভয় জাগিয়ে রাখা, শত্রুপক্ষ যে কোনওদিন তোমার দখল নিতে চলেছে। হিন্দুত্ববাদীরা তাই সকাল সন্ধ্যা আউরে চলেছে 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়'। এই ভয় থেকে জন্মায় 'ফুয়েরার' বা নেতার প্রতি অগাধ আস্থা, যে ইনিই পারবেন আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। নেতা তখন হয়ে ওঠেন বাঁশিওয়ালা, তার পেছনে পেছনে ছোটেন জনগণ, সেই জনগণ তখন সম্মোহিত।
তাই প্রধানমন্ত্রী হুকুম করলে সেই সম্মোহিত জনগণ নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় সমবেত হয়ে থালা পেটাতেও রাজী। চার ঘন্টার নোটিসে নোট বাতিল করে দিলে, ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন চুপ করে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সিয়াচেনের সৈন্য ভাবে সেই জনতা। রান্নার গ্যাসের দাম আগুন হলেও তারা নির্বিকার। এসবই কি অকারণে? একেবারেই নয়। সর্বাধিপত্যকামী রাজনীতি তাদের বুঝিয়েছে যে 'ফুয়েরার' নরেন্দ্র মোদির অনেক বড় কিছুর পরিকল্পনার তারা ভাগীদার হতে চলেছে, তাই এই সামান্য বলিদান স্বীকার করা। মানুষকে এই কথাটা বোঝনো যে, এই কাজের সাফল্যই দ্বিভাগ বিশিষ্ট চিন্তার অস্ত্র প্রয়োগের ফলে। মানুষের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাই এই হাতিয়ারের প্রধান উদ্দেশ্য।
এই আধিপত্যের সুবিধা অনেক। এখানে নেতা জনগণের চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দেন কাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। দাড়ি, টুপিওয়ালা, লুঙ্গিপরা 'ওদের' থেকে, সরকারি বিলের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা 'আন্দোলনজীবীদের' থেকে, আর যারা নেতার কাজের সমালোচনা করেন সেই 'দেশদ্রোহীদের' থেকে, 'গণশত্রুদের' থেকে। এই চিনিয়ে দেওয়া আর চিনে নেওয়ার কাজে জনগণকে ব্যস্ত রাখতে পারলে সুবিধা এই যে, পেছনের দরজা দিয়ে 'নিজেদের লোকেদের' পাইয়ে দেওয়ার কাজটা সহজ হয়ে যায়, ওই লোকগুলোই তখন বাজারের মালিক। তখন প্রধানমন্ত্রী বলতেই পারেন যে ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয় তাই রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলো বেচে দেওয়া খুব জরুরি। প্রধানমন্ত্রী যেটা জানেন কিন্তু বললেন না সেটা হল এই যে, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলো ব্যবসা করে লাভের মুখ দেখবে বলে তৈরি করা হয়নি। হয়েছিল জনসেবা করার জন্য। ভারতীয় রেলের উদ্দেশ্য ছিল বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান করে, রেলপথে সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুলভ করা। বিএসএনএল'এর উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে টেলিফোন পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া, কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে মুনাফার লড়াইয়ে নামা নয়। এই কথাগুলো সুবিধা মতো ভুলে গেলে এবং জনগণকে ভুলিয়ে দিতে পারলে এই সংস্থাগুলোকে 'নিজেদের লোকেদের' কাছে বেচে দিতে আর কোনও নৈতিক আপত্তি থাকে না।
ঠিক যেমন হরিদ্বারের কুম্ভ মেলা। মেলাকে চালু করে হাজার হাজার মানুষকে সংক্রমিত করে অবশেষে মেলা বন্ধ হল প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে। গত বছর দিল্লির নিজামুদ্দিনে মুসলমানদের একটি সভা ঘিরে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। বিজেপি'র আইটি সেল তাকে মুসলমানদের ভারতে করোনা জেহাদের পরিকল্পনা বলে বর্ণনা করে। কুম্ভ মেলায় যা হল সেটা তবে কী? নাকি নরেন্দ্র মোদির ভারতে করোনারও হিন্দু-মুসলমান বিভাজন আছে? প্রশ্নটা অমূলক নয়, কারণ, উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী করোনা পজিটিভ হওয়া সত্ত্বেও হাজির হয়েছিলেন হরিদ্বারে, তিনি মনে করেন যে মা গঙ্গা ভারতের হিন্দুদের করোনা মুক্ত করবেন। এই বক্তব্য যখন তিনি রাখছেন তখন চারপাশ থেকে উঠছে বিপুল জয়ধ্বনি। তাঁদের জয়ধ্বনি, যারা বিশ্বাস করেন ওই মন্ত্রীর কথায়। নাগরিকের সর্বনাশ হোক কিন্তু ভোটের স্বার্থ অনেক বেশি। ওই মন্ত্রীর চোখে এখন শুধুই উত্তরপ্রদেশের ভোট। কোনও কুম্ভস্নান কি ওই মন্ত্রীর পাপ মুছে দিতে পারবে? জানা নেই।
নাগরিকের সর্বনাশ করে ভোট আমাদের রাজ্যেও হচ্ছে। শেষ দু' তিনটি দফার নির্বাচন একসঙ্গে করানোর অনুরোধ বিফলে গেছে। মোদি-শাহ'রা রাজি নন, থুড়ি, ইলেকশন কমিশন রাজি নয়। কেন গররাজি? কারণ, হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্রকে ভারতে যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর ওপরে শেষ আঘাত হানা থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে যে তিনটি রাজ্য তারা হল পাঞ্জাব, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গ। তাই যেন তেন প্রকারেণ পশ্চিমবঙ্গ চাই, নইলে দুই আর দুই পাঁচের অঙ্ক শিখবে কে?
একক মাত্রা ব্লগে শোভনলাল চক্রবর্তীর বেশ ক'টা লেখা পড়েছি । এটা মাস্টারপিস । 👌🏼🌹✅🙏🏼
ReplyDeleteভীষণ জরুরি লেখা।
ReplyDeleteদৈনিক বসুমতীর একটা লেখা সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে কিছু নাই খুব মনে পড়ে
ReplyDeleteসমাজতান্ত্রিক সরকার বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল কিউবা। রোববার রাজধানীসহ বেশকিছু শহরের রাস্তায় নামেন হাজার-হাজার মানুষ।
ReplyDeleteস্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং করোনা মহামারি মোকাবেলায় ভ্যাকসিনের দাবিতে শ্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। কম্যুনিস্ট শাসনের কিউবায় যেকোন বিক্ষোভই বিরল ঘটনা। কিন্তু করোনা ভয়াবহতার সময় বিপুল সংখ্যক মানুষের জড়ো হওয়ায় বিষয়টি উঠে এসেছে আলোচনায়।
সরকার বিরোধীদের দাবি, ৩০ বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় আন্দোলন। কারণ মানুষ খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকটে ক্ষুব্ধ।
দেশটির প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল বিদ্যুৎ সংকটের কথা স্বীকার করলেও; বিক্ষোভে ইন্ধন যোগানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। একইদিন রাজধানী হাভানায় পাল্টা মিছিল করেন কম্যুনিস্ট সমর্থকরাও।
এনএনআর/
https://jamuna.tv/news/237651?fbclid=IwAR2xy9dfxN3Osf9-laTNysG5keA2j2VJqGoiDnQ2glQu_LBz90iFv0bmsoM
সরকার বিরোধীদের দাবি, ৩০ বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় আন্দোলন। কারণ মানুষ খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকটে ক্ষুব্ধ।
ReplyDeleteমমতা ৫ টাকায় ডিমভাত দিয়ে ঠান্ডা রেখেছে - কিন্তু ঝাড়িঙ করছে গোয়েঙ্কার থেকে ইলেকট্রিক বিলের কারচুপিতে।