অসহায় মানুষের হাহাকার
সুমন সেনগুপ্ত
এই সময়ের প্রতিটি দিনই ঐতিহাসিক। প্রতিটি দিন বললে ভুল হবে, প্রতিটি মুহূর্ত ঐতিহাসিক। আপনি সকালে উঠে হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না, এমন কিছু কথা আপনাকে হয়তো সারাদিনে শুনতে হবে। গত বছর এই সময়ে লকডাউন চলছিল আর পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করছিলেন। দেশের নানান প্রান্ত থেকে কোভিডে আক্রান্ত মানুষের হাহাকার শোনা যাচ্ছিল। হেঁটে ফেরার খবরও আসা শুরু হয়েছিল। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন কোনও দিন থালি বা ঘণ্টা বাজানোর এক মহান দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেশের জনগণকে। দেশের অনেক মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালনও করেছিলেন। তারপর তিনি রাত ৯টায় ৯ মিনিটের জন্য বাড়ির সব আলো নিভিয়ে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনায় মৃত মানুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনও করতে বলেন। সেও অনেক মানুষ পালন করেন। তারপর ডাক্তারদের সম্মান জানানো হয়, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হয় এইমসের ওপর। সেই দিনগুলোর কথা যদি মনে করা যায়- সপ্তাহে অন্তত একবার নরেন্দ্র মোদী টিভির পর্দায় আসছেন, মুলত মধ্যবিত্ত মানুষকে কোনও না কোনও কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখছেন যাতে তাঁদের মনে কখনও কোনও প্রশ্ন না জাগে যে সরকার গরিব মানুষদের জন্য কী করল? কেউ যাতে রাস্তায় নেমে ঐ পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে না দাঁড়ায়, তাই দেশ জুড়ে লকডাউন এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল।
ঐ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছিল যে, ডাক্তার, নার্স সহ যারা এই করোনার বিরুদ্ধে সামনে থেকে লড়াই করছেন তাঁদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমা হবে। আজ এক বছর পর যখন আবার কোভিডের দ্বিতীয় সংক্রমণে চারিদিকে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করছে, চারিদিকে চিতা জ্বলার ছবি আসছে, তখন হঠাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই বীমা প্রকল্পটি তুলে নেওয়া হল। (অবশ্য এ নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হওয়ায় নতুন অন্য কোনও বীমা প্রকল্পের অধীন তাঁদের নিয়ে আসা হবে বলে স্তোকবাক্য দেওয়া হয়েছে)। কোনও কোনও মানুষ বা চিকিৎসক যারা মারা গিয়েছেন তাঁদের পরিবার যে এই বীমা প্রকল্পের সুবিধা পাননি তা নয়। কিন্তু তা কি আর এই গুজরাটি বানিয়ারা মেনে নিতে পারে? মৃত মানুষের কোনও দাম নেই তাঁদের কাছে, যদি না তাঁরা সেনাবাহিনীর কেউ হন।
শুধু গুজরাটি বানিয়াদ্বয়েরই বা দোষ দিই কী করে, আমরাও তো নানান সময়ে এই সরকারের বিভিন্ন অমানবিক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছি। এই যেমন সেদিন আমাদের বেশির ভাগ মানুষই ধরে নিয়েছিলেন যে করোনা মুসলমান মানুষজন ছড়ায়। সেদিনও যেমন অনেকে মেনে নিয়েছিলেন যে ‘ওরা’ নোংরা তাই ‘ওদের’ মাধ্যম দিয়েই করোনা ছড়াচ্ছে। আজও তেমনটাই হয়তো ভাবেন অনেকেই। অথচ কেউ প্রশ্ন করেন না যে আমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদী আয়োজিত ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে যদি ঐ রকম জমায়েত না হত, বা আজ যদি কুম্ভ স্নানে এই রকম বাড়াবাড়ি না হত, তাহলে কি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় করোনার ঢেউ এত ভয়াবহ আকার নিত? কেউ কিন্তু জিজ্ঞেস করছেন না যে যদি এই সময়ে বাইরের লোকজন নিয়ে এসে বাংলার নির্বাচনের প্রচার না করা হত, তাহলে কি সমস্যার এতটা বাড়াবাড়ি হত?
অদ্ভুত এক দেশে আমরা বাস করছি। যেখানে কেউ প্রশ্ন করতে ভয় পায়। সব কিছুই কত নর্মাল, কত কী অনায়াসে মেনে নেওয়া হয়েছে। বাংলায় দুটি বিধানসভায় (সামশেরগঞ্জ এবং জিয়াগঞ্জ) প্রার্থী মারা গেছেন করোনাতে। দুটো জায়গাতেই মুসলমান মানুষ সংখ্যায় বেশি সেখানে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়েছে সম্ভাব্য ঈদের দিনে। পরে অবশ্য চাপে পরে সে তারিখ পাল্টানো হয়েছে। কাণ্ডজ্ঞানের বলিহারী! আচ্ছা, ভাবুন তো, এক মাস সংযমের রোজা করে প্রায় প্রতিটি মুসলমান মানুষ যখন ঈদ পালন করবেন, সেদিন নির্বাচন ফেলা কি সেই মানুষদের অপমান করা নয়? এই একই প্রক্রিয়া যদি ষষ্ঠী বা অষ্টমীর সকালে নেওয়া হত আপনার কেমন লাগত? আপনার উৎসবের দিনে জলপাই রঙের জামা পরা কিছু মানুষ আপনার অঞ্চলে ঘুরছে, কারণ আরও বড় উৎসব পালন করছেন আপনি।
আসলে এটাই হচ্ছে সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রে পাশের মুসলমান মানুষের জন্য কোনও সহানুভূতি থাকতে নেই, যে গণতন্ত্রে পাশের পরিযায়ী শ্রমিক বা রিক্সাচালককে আমরা অনায়াসে ‘ওরা’ বানিয়ে ফেলতে পারি। যে সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে অনায়াসে আখলাখ, জুনেইদদের পিটিয়ে মারা যায়, যে সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে আসানসোলের দাঙ্গায় ইমাম রশিদির ছেলেকে মেরে সেই স্মৃতিকে উসকে ভোট চাওয়া যায়। যে গণতন্ত্রে একজন মানুষ তাঁর প্রতিবেশী মানুষটিকে ঘেন্না করতে শেখে, সেই গণতন্ত্রে আমিও একজন অংশীদার ভাবলেই নিজের ওপর ঘেন্না হয়। যে গণতন্ত্রে ‘জয় শ্রীরাম’ না বলার কারণে একটি দশ বছরের বালকের গায়ে ফুটন্ত গরম জল ছুঁড়ে দেওয়া হয়, সেই গণতন্ত্রের অংশীদার হয়ে আমি ভোট দিয়ে নিজের কালি লাগা আঙুলের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েছি ভাবলে লজ্জায় মাথা নীচু করতে হয় না?
যখন সারা দেশে আবার দ্বিতীয় করোনার ঢেউ এসেছে, যখন সারা দেশে মানুষ ‘অক্সিজেন’এর অভাবে হাহাকার করছে, তখন কোনও নেতা মন্ত্রী বলছেন বড্ড বেশি ‘অক্সিজেন’ নিচ্ছেন মানুষ, কিংবা বলছেন মানুষের বয়স হলে তো মারা যাওয়াই উচিত; তখন কি মনে হয় না এটা সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র? যারা সমাজের ওপর তলায় বসে সব ধরনের সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত সেই সংখ্যাগুরুরা এখন নিদান দিচ্ছেন মানুষের মরে যাওয়া উচিত তখন কি মনে হয় না বলি, ‘একটা কুঁড়ি বারুদ গন্ধে মাতাল করা ফুটবে কবে?/ সারা শহর উথাল পাতাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।’
ভীষণরকম সহমত জানাচ্ছি। তাই তো... গণতন্ত্র এই সংজ্ঞা কিংবা বোধে আমরা বিধানসভাকে চিনি জানি, তার বাইরে গণতন্ত্র থাকতে নেই৷ জনমতের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অন্তত সেটুকু ভাবায় কিংবা বাধ্য করে ভাবতে৷ এর বাইরেও একটা আলো-আঁধার আছে৷ আছে প্রতিদিন বেঁচেবর্তে থাকার রাজনীতি৷ জনমানসিকতার বদল যদি না ঘটে, ততদিন প্রশ্নগুলো উহ্যই থাকবে হয়তো। অনেকাংশে অবান্তরও
ReplyDeleteসামন্ততান্ত্রিক ভিতের ওপর গণতন্ত্রের মেকি কাঠামো। কর্পোরেট পুঁজি সামন্তদের হাত ধরে দখলদারি কায়েম করছে। যদিও এ নতুন কোনও কথা নয়, তবুও বাস্তবিক অবস্থায় সামন্ততন্ত্রের আক্ষরিক অর্থে বিলোপ না হলে, এই ফাঁপা গণতন্ত্রের কাছে কোনও প্রত্যাশা নেই আর।
ReplyDelete