আমরা কি প্রেতযোনির দিকে হাঁটব?
শিবশংকর পাল
১৯৫২-এ সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে বাংলার ক্ষমতায় এ পর্যন্ত যে যে দল আসীন হয়েছে তাদের প্রত্যেকের উত্থানের পিছনে ছিল গণআন্দোলনের ইতিহাস। স্বাধীনতা আন্দোলনে আপস-সংঘাত সহ সুদীর্ঘ লড়াইয়ের পরম্পরা আছে কংগ্রেসের। বামপন্থীদের আছে তেভাগা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, খাদ্য আন্দোলন সহ বহু সংগ্রামের পরম্পরা। তৃণমূলেরও আছে ২১ জুলাই, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করার প্রামাণ্য তথ্য। চলমান বিধানসভা নির্বাচনে শাসনক্ষমতার অন্যতম দাবিদার বিজেপি-র এ হেন কোনও পথে নামার ইতিহাস আছে কী?
ইতিহাস বলছে, বাংলার মানুষ যতবার সরকার পরিবর্তন করেছেন ততবারই দেখা গিয়েছে কোনও না কোনও আন্দোলনের শক্তিকেই তাঁরা ঢেলে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গত যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হল, চিল-চিৎকারে ক্ষমতায় আসার কথা বলে চলা বিজেপি-র কোনও গণআন্দোলন করার ন্যূনতম নজির আছে কী? এর একটাই উত্তর: না। ১৯২৫-এ আরএসএস'র জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত জনবিরোধী কোনও নীতির বিরুদ্ধে পথে নামার কোনও ইতিহাস তাদের নেই। বরং ব্রিটিশকে সহযোগিতা করা বা মুচলেকা দিয়ে কারামুক্ত হওয়ার মতো লজ্জাজনক কিছু বৃত্তান্ত রয়েছে সঙ্ঘের চেলাচামুণ্ডাদের।
বিজেপি-র জনক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত জনসংঘই দেশভাগের অন্যতম দাবিদার। কেবল তাই নয়, ওপার বাংলা থেকে আসা বাঙালি উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে গিয়ে মানুষকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করতে তাঁরা বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। হিন্দু শিবিরগুলিতে লাগাতার বর্ণ বিভাজনের চেষ্টা করে গিয়েছেন। জন্মের ঠিক এক যুগ পরে বিজেপি-র নেতৃত্বে ১৯৯২-এ ভাঙা হয়েছে বাবরি মসজিদের মতো একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সৌধ যা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করত। বিজেপি নেতৃবর্গ রথে চেপে দেশ জুড়ে দাঙ্গার উসকানি দিয়েছে; ফলস্বরূপ প্রচুর দাঙ্গা হয়েছে। মানুষ মরেছে হাজারে হাজারে।
বিভাজনের আগুন নিয়ে খেলেই ২০০২-এ গুজরাত দাঙ্গা ও পুনর্দখল দখল- যা এ যাবৎকালে ভারতবর্ষে সংঘটিত দাঙ্গাগুলির মধ্যে বীভৎসতম। মুসলিম নারীর গর্ভের সন্তানকেও রেহাই দেননি তাঁরা। রুটি সেঁকার তন্দুরে পুড়িয়ে মারা হয়েছে মুসলমান ধর্মের অসংখ্য মানুষকে। সেই গুজরাত গণহত্যার নায়ক কে? উত্তর সবাই জানেন-- আজকের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামে অসংখ্য হত্যার অভিযোগ ও কেস রয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে তাঁরা ভারপ্রাপ্ত বিচারককে হয় সরিয়ে দিয়েছেন, নয়তো জেলে পুরেছেন; কাউকে বা জীবন থেকেই সরিয়ে দিয়েছেন চিরতরে।
বিজেপির অন্যতম ‘সুভদ্র’ কবি ও নেতা প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও স্বাধীনতা আন্দোলনে পিছন থেকে ছুরি মারার দায় থেকে মুক্ত নন। সর্বোপরি তাঁরই নেতৃত্বে ২০০৩-এ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আনা হয়। এই আইনে বর্তমান ভারতভূমিতে জন্ম নেওয়া ভারতীয় হলে তবেই জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হওয়ার অধিকার আছে, নইলে নয়। লঙ্ঘিত হয়েছে ভারতের সংবিধান। এই আইন এতটাই অমানবিক যে, অখণ্ড ভারতের হিন্দু বাঙালিরা এনআরসি চালু হলে এ দেশে বেনাগরিক হয়ে পড়বেন।
২০১৪-এ ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদী সংবিধানে মাথা ঠুকে নাটক করে প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হল নোট বাতিল ঘোষণা। তিনি নাকি কালাধন ফেরত আনবেন, সন্ত্রাসবাদ দমন করবেন। এবং দেশবাসীর পকেটে ১৫ লক্ষ করে টাকা ঢুকিয়ে দেবেন। পরিবর্তে কী ঘটল? কোটি কোটি টাকা নিয়ে গুজ্জু ব্যবসায়ীরা ভারতের ধনাগার ফাঁকা করে দিয়ে বাইরে পালিয়ে গেল। আমরা গোটা দেশ জুড়ে লাইনে দাঁড়ালাম। কত প্রবীণ নাগরিক মারা পড়লেন। ছোট ব্যবসায়ী ও গরিব মানুষের আয় সাঙ্ঘাতিকভাবে কমে গেল। মধ্যবিত্তরাও পেটে গামছা বাঁধতে বাধ্য হলেন। কত মানুষের টাকা বদলানো সম্ভবই হয়নি। সেই টাকা শাহ্জীর পকেটে ঢুকে গেল।
২০১৯-এ সংবিধানের প্রতিমায় সাষ্টাঙ্গে গড় করার আর এক দফা নাটক আমরা দেখলাম। সংবিধানের প্রতি নাটকীয় নমনের পরে পরেই সংবিধানকে কাঁচকলা দেখিয়ে সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনের বিল চলে এল। পাশও হল। জাতীয় সঙ্গীতে যে সাতটি ধর্মের কথা বলা হয়েছে তার থেকে বাদ পড়ে গেল ইসলাম ধর্ম। আইনে বলা হল, মুসলমান ছাড়া বাকি ছটি ধর্মের মানুষ ভারতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন।
২০২০-তে করোনার নাম করে এনআরসি-সিএএ বিরোধী শাহীনবাগ আন্দোলন তুলে দেওয়া হল। দাঙ্গা করা হল দিল্লীতে। বহু মানুষকে মারা হল। মানুষকে ঘরবন্দী করে থালাবাটি বাজানো, দিয়া জ্বালানোর আর এক দফা নাটক করে একতরফাভাবে পাশ হয়ে গেল অসংখ্য জনবিরোধী নীতি। গড়ে উঠল হিসাবনিকাশের বাইরে রাখা পিএম কেয়ারস ফান্ড। সে টাকা কে দেয়? কোথায় যায়? কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না। কারণ, এই ফান্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অধিকার এ দেশের নাগরিকদের নেই। মৌলিক বাকস্বাধীনতা হরণের এটি আর একটি নিদর্শন।
ইউএপিএ তো আগেই ছিল, তার সঙ্গে যোগ হল কৃষি, শ্রমকোড সহ বহু জনবিরোধী আইন ও সেই সঙ্গে সংবিধান বিরোধী আইন পাশ করানো। এমনকি আপ-এর দিল্লী সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার জন্য এল লেফটন্যান্ট গভর্নরের পদ। তাঁর অনুমোদন ছাড়া রাজ্য সরকার কোনও আর্থিক নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না। এর ফলে ভেঙে পড়বে বহুত্ববাদী ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। কৃষি আইনে জমি ও ফসল তুলে দেওয়া হল কর্পোরেটের হাতে। চাষি হয়ে পড়বেন নিজের জমির মজুর মাত্র। গত ৭ বছরে রেল, বিমা, ব্যাঙ্ক, দূরসঞ্চার সহ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দেওয়া হল বা তার ব্যবস্থা করা হল। দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি পূরণ করা দূরে থাক নতুন করে ১৩ কোটি মানুষ বেকার হয়েছে গত দু' বছরে।
অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়েছে নিত্য দরকারি জিনিসের দাম। পেট্রোল ডিজেল গ্যাসের দাম এতটাই বেড়েছে যে মধ্যবিত্তেরও কোমর ভেঙে যাবে। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতিটি জিনিসের দাম চড়েই চলেছে। গরিব মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। জিডিপি হ্রাসে বিশ্বে ভারত এক নম্বরে। ক্ষুধা ও আনন্দ সূচকে ভারতের অবস্থান পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালেরও বহু নীচে। লকডাউনের বছরে ভারতের জিডিপি ছিল মাইনাস ২৩.৪। আশ্চর্য সমাপতন এই যে, ওই বছরেই আম্বানিদের আয় বাড়ল ২৪ শতাংশ।
এদিকে নয়া শিক্ষানীতি এনে শিক্ষাকে বেসরকারি করা ও অহিন্দি রাজ্যে হিন্দিভাষা চালু করার ষড়যন্ত্র চলছে। তারই অংশ হিসেবে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে গড়ে তোলা IACS-এ হিন্দি ভাষায় কাজ করার ফরমান এসে গেছে। শুরু হয়ে গেছে এক ধর্ম এক ভাষা এক দেশ অর্থাৎ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার কাজ। হিন্দু সংবিধানও প্রস্তুত যা কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন আরএসএস-এর মোহন ভাগবত। পশ্চিমবঙ্গ জিতে গেলেই আগামী লোকসভার ভোট ডকে উঠে যাবে, কিংবা ইভিএমের জাদুতে জিতে প্রেসিডেন্সিয়াল ধাঁচের রাষ্ট্র গড়ে তুলবে; যার মাথায় থাকবেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী। জানেন বোধহয়, তিনটি সামরিক বাহিনির মাথার উপর বসবার জন্য একটি পদ সৃষ্টি করা হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সেই পদে আসীন হয়েছেন মোদীজী।
উপরে বর্ণিত মোদী-শাহের পরম এই কীর্তিমালা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আরও অসংখ্য কীর্তি রয়েছে, যা মহাভারতের অমৃতকথা, শুনলে নিশ্চিত আপনি পুণ্যবান হবেন। মোদী-সরকারের উল্লেখযোগ্য অবদান হল, দেশের গরিব আদিবাসী মানুষের বসবাসের জায়গা ও মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে ৩ হাজার কোটি টাকায় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি নির্মাণ। করোনার মধ্যে দেশকে লকডাউন করে দিয়ে বিপুল খরচে ও জনসমাগমে রামমন্দিরের ভূমিপূজা করা। লকডাউনের সময় লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের শত শত মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে বাধ্য করা; খাদ্য পানীয় দেওয়া তো দূরের কথা, পশুর মতো তাঁদের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল ব্লিচিং মেশানো বিষাক্ত জল; দেওয়া হয়েছিল ‘সোনা’র উত্তরপ্রদেশে। পশুর মতো রাস্তায় মরে পড়েছিলেন নারীপুরুষ শ্রমিকেরা। এদিকে বাংলার দলবদলুদের জন্য আসে চার্টার্ড প্লেন, খাওয়াদাওয়া হয় পাঁচতারা হোটেলে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নামের স্টেডিয়ামকে পরিবর্তন করা হয় মোদীর নামে।
মোদী-শাহের সবচেয়ে বড় অবদান হল, মানুষকে অভুক্ত রেখে ভারতের রামভক্ত হনুমানদের লাফালাফি করবার জন্য ৬০ হাজার কোটি টাকায় নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে দেওয়া। বরাত পেয়েছে টাটা গোষ্ঠী। আশ্চর্যের সঙ্গে আমরা দেখলাম, বঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার জন্য করোনা বিধি অগ্রাহ্য করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মোদীজী বাংলাদেশ সফরে গিয়ে ওই দেশের জনমানসকে বিচলিত করলেন। বাংলাদেশবাসী এই সফরের বিরোধিতা করেছেন। বিক্ষোভ ঠেকাতে গুলি চলেছে। মারা গিয়েছেন জনাকয়েক বাঙালি। কেবলমাত্র ভোটের জন্য এই আচরণ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
সাম্প্রতিককালে দেশে এ পর্যন্ত যতগুলি নির্বাচন হয়েছে তার কার্যকলাপ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবেন, ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপি-র তিনটে মাত্র হাতিয়ার: ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা এবং দাঙ্গা করা। যদি এই অস্ত্র ফেল করে তবে ইভিএম-এর জাদু দেখানো; যদি এই খেলাতেও হার হয় তবে পিএম কেয়ারস ফান্ড ও অমিত শাহ-এর ফোনাফুনি।
বিজেপি প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে যেনতেন প্রকারেণ মনুসংহিতা-নির্ভর হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ করতে চাইছে। অথচ হিন্দুরাষ্ট্র সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন? 'আমরা যে কল্পনা করি আমাদের কেবল আধ্যাত্মিক সভ্যতা ছিল --- আমাদের উপবাসক্ষীণ পূর্বপুরুষেরা প্রত্যেকে একলা একলা বসে আপন জীবাত্মাটি হাতে নিয়ে কেবলই শান দিতেন --- তাকে একেবারে কর্মাতীত অতি সূক্ষ্ম জ্যোতির রেখাটুকু করে তোলবার চেষ্টা --- সেটা নিতান্ত কল্পনা। আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহু দিন হলো পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজ তারই প্রেতযোনি মাত্র।' [স্বদেশ]। বিজেপি সেই প্রেতযোনিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। যে ‘সোনার ভারত’ তারা গড়েছে, বাংলাকে সেই সোনাতেই মুড়তে চাইছে এই দানবীয় দলটি। যে-কোনও মূল্যে একে রুখে দেওয়া, সে ভোটের মাধ্যমেই হোক বা রাস্তায়, এখন আমাদের এটাই জাতীয় কর্তব্য এবং মানবিক দায়।
No comments:
Post a Comment