শোভনলাল চক্রবর্তী
সামাজিক সংকটের আগুনকে আড়াল করে যে সব কবি পলায়নবাদীর মতো প্রেম, প্রকৃতি আর আত্মগত সংকটের মধ্যে ডুবে থাকেন, শঙ্খ ঘোষ তাঁদের দলভুক্ত ছিলেন না। তিনি আমাদের জাগ্রত বিবেক। তিনি সংগ্রামী মানুষের কানে কানে তূর্যনাদ উচ্চারণ করে গিয়েছেন নির্ভয়ে। আর অত্যন্ত লক্ষণীয় যে, সেই তূর্যনাদের ভাষা মাটি ও রৌদ্রের মতো সরল, সুন্দর ও সবল। সৈনিকের পোশাকের মতো ভারমুক্ত সেই ভাষা। তাঁর গদ্য ও কবিতা একই সঙ্গে চিরকালের ও সমকালের। নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর প্রতিবাদে তিনি সাম্মানিক সরকারি পদ থেকে সরে আসতে যেমন দ্বিধা করেননি, তেমনই গুজরাটের বীভৎস দাঙ্গার সময় 'ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা' নামক নিবন্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভাষায় অকুতোভয়ে লিখেছিলেন, 'গুজরাট জ্বলছে। আমরা জানি, গুজরাটের মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে সে-আগুন নেভাবার দায়িত্ব আমাদেরও, এই রাজ্যের মানুষদেরও।'
যাদবপুরের প্রিয় ছাত্র তিমিরবরণ সিংহ নকশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে পুলিশের হাতে মার খেয়ে মারা গেলে কবির চোখ ময়দানের মাটিতে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার মধ্যে খুঁজে পায় তিমিরের ছিন্ন শির- 'ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়/ দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ/ তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?/ নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই/ তোমার ছিন্ন শির, তিমির।' কোন রহস্যময় সূচনাবিন্দু থেকে একটি কবিতা উঠে আসে তা পাঠকের কাছে জানানোটা কবির কাজ নয়। এ নিয়ে বিস্তর বিতণ্ডা আছে। পাঠকের বোধ ও ব্যাখ্যার বিচিত্র ভিন্নতা ও বৈপরীত্য দেখে নিরুপায় রবীন্দ্রনাথকেও একদা 'সোনার তরী' কাব্যের নাম কবিতাটির একটি মর্মসংকেত দিতে হয়েছিল। শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত কবিতা 'যমুনাবতী' পাঠ করে এক তরুণ পাঠকের মনে হয়েছিল, 'কোনও সত্য ইতিহাসের বিন্দুকে হয়তো-বা ছুঁয়ে আছে ওই লেখা। সে ইতিহাস কি জানা যায় কোনওভাবে।' তারই উত্তরে লেখা হয়ে যায় 'কবিতার মুহূর্ত'। এই গ্রন্থ কোনওমতেই কবিতার নোটবই নয়, ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ নয়। কেবল আলতো হাতে এক একটি কবিতার উৎসমুখ খুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা। ভাগ্যিস, এই সূচনাবিন্দুগুলি হাতে পেয়েছি আমরা, নইলে কি কোনওমতে জানা সম্ভব ছিল ১৯৫১ সালে খাদ্যের দাবিতে কোচবিহারে এক ষোল বছরের কিশোরীর পুলিশের হাতে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত হয়েছিল- 'নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে/ আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে!'
১৯৩২ সালে অভিভক্ত বাংলার চাঁদপুরে জন্মেছিলেন যে চিত্তপ্রিয় ঘোষ তিনিই হয়ে উঠলেন এক অলোকসামান্য স্নিগ্ধ ও মরমি গদ্যের জাদুকর শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কবিতা আমাদের শিখিয়েছে প্রেম, প্রতিবাদ ও আত্মব্যবচ্ছেদের ভাষা কতখানি লক্ষ্যভেদী হতে পারে। তাঁর গদ্য পাঠ করে আমরা অনুভব করতে শিখি জীবনের বহুবর্ণময় বিস্তারকে কীভাবে প্রসাদগুণের আধারে ব্যক্ত করা সম্ভব। সেদিক থেকে মনে হয়, কবি শঙ্খ ঘোষ এবং গদ্যশিল্পী শঙ্খ ঘোষ একে অপরের পরিপূরক। তাঁর কবিতায় রয়েছে প্রগাঢ় দ্যোতনাময় বীজ আর গদ্যের ছত্রে ছত্রে খুঁজে পাই তারই অপার বিস্তার। কোমলে ও কঠিনে অপরূপ সেই বিস্তার। কবিতা পড়ে ঠিক চেনা যায় না তাঁকে। তবু বাংলা কবিতায় তাঁর অবদান কিংবদন্তীপ্রতিম। 'দিনগুলি রাতগুলি', 'বাবরের প্রার্থনা'- যেটি ১৯৭৭ সালে ভূষিত হয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে, 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে', 'ধুম লেগেছে হৃদকমলে'- যার জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান, এছাড়াও পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার- তবে এ সবই আজ কেবলই তথ্য। তাঁর গদ্য পাঠে বোঝা যায় বৈদগ্ধ্য ও রসবোধের স্নিগ্ধতা কত অনায়াসে বসবাস করতে পারে পাশাপাশি। 'ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ', 'এ আমির আবরণ', 'নির্মাণ আর সৃষ্টি', 'কবির অভিপ্রায়', 'শব্দ ও সত্য', 'উর্বশীর হাসি', 'এখন সব অলীক'-এর পাতায় পাতায় যেন ছড়ানো রয়েছে শাশ্বত আনন্দনগরী। ওরকম গম্ভীর আর স্বল্পবাক মানুষের মধ্যেও যে বাস করেন একজন সুরসিক মানুষ, সে কথা অজানাই থেকে যেত 'ইছামতীর মশা' পড়া না থাকলে।
তাঁর গদ্যের সম্ভার কবিতার থেকে কিছু কম নয়। সে সব পড়তে বসলে মনে হয় একজন বন্ধুর মুখোমুখি বসে বিচিত্র বিষয়ের আলোচনা শুনছি; এমন এক বন্ধু যাঁর পঠনপাঠন ও জীবনকে দেখার পরিধি অনেক বড়। বস্তুত শঙ্খ ঘোষ হয়ে রইলেন আমাদের 'সব পেয়েছির দেশ'। তিনি আমাদের আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম। তাঁর গদ্য ও পদ্যের জগৎ সব শ্রেণির পাঠকের জন্য উন্মুক্ত, অবারিত। যাঁর যেমনভাবে খুশি, যাঁর যতদূর সাধ্য ততখানিই অবগাহন করতে পারেন শঙ্খ সমুদ্রে। এক সম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। কল্লোল উত্তরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, গদ্যকার, সাহিত্য অস্বাদক ও সামাজিক বিবেকবান মানুষ তিনি। কেউ যদি আজীবন শুধু তাঁর কবিতার মধ্যেই ডুবে থাকতে চান তবে তিনি সেই নিমজ্জনের দুর্নিবার হাতছানিতেও দেখতে পাবেন কবিতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা গদ্য। কবিতার চিরাচরিত ছন্দের প্রতি যাঁদের পক্ষপাতিত্ব, তাঁরা ছন্দের সামান্য অনটনে ও নতুন নিরীক্ষায় আহত হন, তাঁদের জন্য রইল 'নিঃশব্দের তর্জনী'র সেই অমোঘ কথন, 'ছন্দের সমস্যা আসলে ব্যক্তিত্বেরই সমস্যা, সে তো কেবল ছান্দসিকের শুকনো পুঁথি নয়। ব্যক্তিরই মুক্তির জন্য ছন্দের ক্রম উন্মোচনের প্রয়োজন ঘটে, দরকার পরে তার অনড় চলৎশক্তিহীনতার বাইরে বেরিয়ে আসা।' আজ থেকে বাঙালির শঙ্খ যাপনের কাল শুরু হল।
লেখা টিতে একটা আন্তরিকতার স্পর্শ অনুভব করলাম।ভালো লাগলো তিমিরের প্রসঙ্গটি।কবির বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থের প্রসঙ্গ সবাই উল্লেখ করেন।তাঁর এই মরমী লেখাটির কথা অনেকেরই অজানা
ReplyDeleteঅসাধারণ বিশ্লেষণ। খুব ভালো লাগলো। প্রয়াত শঙ্খ ঘোষের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। শোভন, তোমার জন্য ভালোবাসা
ReplyDeleteখুবই ভালো লিখেছেন l সত্যিই শঙ্খ-যাপনের কাল... অমৃতা ঘোষাল
ReplyDeleteজয় গোস্বামী , শঙ্খ ঘোষ এদের দুজন ই বড় কবি - দার্শনিক।
ReplyDeleteকিন্তু দুজনের ওপর এখন বাঙালির রাগ। আমারও। উদাহরণ দিলাম থার্ড পার্টি কোটেশন দিয়েই।
"Tanmoy Sanyal
t5Sphohnsoermed ·
শঙ্খ বাজল কি বাজল না সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কবিতার আঁতলেমিতে পেট ভরে না, 34বছরের রাজত্বে হাজার হাজার শিল্পে লকআউট করে কজনের মুখের ভাত কেড়েছেন জানেনত সেটা? ওদের কবিতা শোনান পেট ভরবে? #ভাত_দে_কমরেড👊
Gopal Mandal, Advocate, Calcutta High Court.
ReplyDelete"চুপ করো, শব্দহীন হও "
এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও-
প্রয়াত বিশিষ্ট কবি এবং শিক্ষাবিদ পদ্মশ্রী শঙখ ঘোষকে তারই কবিতার লাইন উচ্চারন করে আজ তার প্রয়ান কালে শেষ সম্মান জানাই।হ্যা পুর্ব পাকিস্থানের চাঁদপুর থেকে আগত এই কবি আজ নিঃশব্দে ৮৯ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। ১৯৫৪ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে MA পাশ করা উচ্চ শিক্ষিত মানুষটার রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার সাথে আমি বিন্দু মাত্র সহমত ছিলাম না, কিন্তু বাংলা সাহিত্য জগতে তার অবদান তার প্রতি আমাকে শ্রদ্ধাশীল করেছিল।ওনার সাথে আমার শেষ দেখা হয় বছর দুই আগে বিধাননগরে শিক্ষকদের এক অনশন মঞ্চে। দেখা হতে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করতেই জিগাসা করলেন "আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না"। আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলেম " আমায় চেনার কথা নয় আপনার কারন আমি সমাজে তেমন পরিচিত গোত্রের মানুষ নই আর আপনার সাহিত্য জগতের ধারে কাছেরও লোক নই।" সে দিন আর বলা হয় নি যে আপনার সেকুলারিজম উক্তিকে কটাক্ষ করে তার দিন কয়েক আগে সোসাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলাম আপনাকে তুলোধোনা করে যা ৫০০ এর উপর শেয়ার হয়েছিল।
যাইহোক পরিশেষে বলব-
"দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু।"
বাঙালি বলছেন কেন, বলুন দাঙ্গাবাজ,হনুমান ভক্ত, রুচিহীন বাঙালি। ভুলে যাবেন না আপনাদের মত হিন্দুত্ববাদী ট্রোলাররা সমাজের একটা পিছিয়ে পড়া অংশ। অশিক্ষাই আপনাদের পুঁজি। ওই সোশ্যাল মিডিয়ার মেঘের আড়ালেই আপনাদের যত লম্পঝম্প।আপনাদের শব্দ চয়ন প্রমান করছে আপনাদের শিক্ষা, রুচি। তা আপনাদের প্রিয় কবি কে জানার আগ্রহ রইল।
ReplyDeleteএকটা কথা আছে ইংরাজীতে - “Do not wrestle with a pig. Both of you ll get dirty but pig enjoys it” , এই ধরনের ভক্ত দের উত্থান আর তাদের ব্রেনসাইজ বাদামের মতো , এরা আসবে যাবে মিলিয়ে যাবে। খামোকা সময় নষ্ট করবেন না। ইগনোর করুন এদের
Delete