Friday, 27 August 2021

গোঙানি

যন্ত্রণাকর সময়ের উচ্চারণ

সোমা ঘোষ বিশ্বাস


মানুষের গভীরের এক শব্দ- গোঙানি। গভীর যন্ত্রণার শব্দ। সে শব্দের কোনও শ্রোতা নেই। তার কোনও বৈচিত্র্য নেই। তার আঘাত আছে। বারবার বুকে এসে লাগা ঢেউয়ের মতো, পৌনঃপুনিক অস্তিত্ব আছে। 

আইসিইউ'এর বাইরে বসে সারাদিন গোঙানির শব্দ শুনেছি। তার মধ্যে একজন ছিলেন আমার মা। এখনও সেই গোঙানির শব্দ হঠাৎ কখনও কখনও মনের অদৃশ্য কোনও কোণ থেকে জেগে ওঠে। স্তব্ধ হয়ে যাই ক্ষণিকের তরে। গভীর দুঃখ আরও একবার নিজেকে জানিয়ে মিলিয়ে যায়। বলে যায়, আমিও আছি। 

গোঙানির কোনও মানে নেই। প্রকাশ আছে। সেই প্রকাশে সুখ আছে। মানুষ শব্দের কাছে এতটাই ঋণী। সব শেষ হতে হতে এইটুকুকেও অন্তত সে আঁকড়ে থাকতে চায়। যন্ত্রণা যেন সেইটুকুতেই নিজেকে জানান দেয়। ওতে যন্ত্রণা কমে না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা আরাম হয়। আত্মপ্রকাশের আরাম। 

যে মানুষ দীর্ঘদিন কথা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, তার পাশে বসে থেকেছি। গোঙানির শব্দই তার অবশিষ্ট ভাষা। সেই তার প্রকাশ। চোখ বন্ধ করে কী এক অদ্ভুত শব্দ জন্ম দিয়ে চলেছে। ওইটুকুই তার সম্বল। সুস্থ মানুষ গোঙানির শব্দে বিরক্ত হয়। তার কাছে তো অনেক শব্দ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এটা সেটা নিয়ে থাকলেই হল। কিন্তু যে মানুষ প্রান্ত সময়ে এসে ঠেকেছে অথবা যার যন্ত্রণায় দিক ভুল হয়েছে, সে কী করবে? তার ওটুকু যে না থাকলেই নয়। এমন অনেক বয়স্ক মানুষ দেখেছি, সারাদিন শুয়ে শুয়ে গোঙিয়ে যান। তাঁর বাড়িতে তিনি ও অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা করে রাস্তায় নেমেছি, জানালা দিয়ে তাঁর গোঙানির শব্দ আসছে। অটোর জন্যে অপেক্ষা করছি। আশপাশে কাকের ডাক, রিকশা-সাইকেল-গাড়ি কত কিছুর শব্দ। মানুষের কত কথা। তার মধ্যে একজন কেউ গোঙিয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন শব্দ। কিন্তু কী গভীর যন্ত্রণা! অসহায়তা। কারও সময় নেই শোনার।

হাসপাতালে এ অভিজ্ঞতা হয় সব চাইতে বেশি। মাথার কাছে মা বসে, বাচ্চাটা গোঙিয়ে যাচ্ছে। মা অসহায়ের মতো অন্যদিকে তাকিয়ে বসে। সারা পৃথিবীর সব শব্দ অর্থহীন সেই মুহূর্তে তাঁর কাছে। তাঁর কানে শুধু ওই একটি গোঙানির শব্দই অক্ষরব্রহ্ম। মাঝে মাঝে বাচ্চাটার মাথায় হাত রাখছেন। আবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন। এক করুণাহীন সময়ের আবর্ত ঘুরেই চলেছে। যার একমাত্র বাঙ্ময় প্রকাশ গোঙানি।

সবার ভাগ্যে গোঙানিতে সাড়া দেওয়ার মানুষ থাকে কই? মানুষ যখন আর কোনও মানবিক শব্দ না পেয়ে শুধুমাত্র একটি আদিম শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে, যে শব্দের মানে খুঁজতে কোনও অভিধান লাগে না, যে শব্দের অর্থ মানুষ কিছুতেই ভোলে না, সে শব্দের যে অসহায় হাত, সেটা ধরার মানুষ কি সবাই পায়? গোঙানি তাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে ফিরে তারই কাছে আসতে থাকে।

শুধু কি মানুষ? গোঙানিতে আমরা সবার সমান। রাস্তার পাশে পা ভেঙে কুকুরের গোঙানি শুনেছি। কাতরভাবে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। যদি কেউ সাহায্য করে। অথবা, হয়তো কোনও সাহায্যই চায় না। শুধু জানিয়ে যাচ্ছে গোঙানিতে নিজের গভীরতম যন্ত্রণার কথা। জানি না। তবে সে গোঙানির শব্দ ভুলেছি কই? সব কান্না শেষ হলে জন্মায় গোঙানি। কান্নার তবু কিছু দাবি থাকে, অভিমান থাকে, কিন্তু গোঙানির সেটুকুও থাকে না। তার নিঃসঙ্গতাতেও কোনও ক্ষোভ নেই। তার অভিমান নেই। সে শুধু আছে। 

উপনিষদের ঋষিরা জেনেছিলেন, সমস্ত সৃষ্টির আদিতে ছিল এক শব্দ। সেই নাকি আদি সত্য। বুদ্ধ বললেন, দুঃখ, সেই সত্য। তবে কি বুদ্ধ সৃষ্টির গভীরে কোনও গোঙানির শব্দ শুনেছিলেন? এক গভীর যন্ত্রণা, এক অব্যক্ত ব্যথা থেকে মুক্তির আকুতি। গোঙানি মুক্তি চায়। দুঃখ আছে- এ সত্য নিয়ে সংশয় জাগে না। তাই, পৃথিবীর গভীরে এক গোঙানিও আছে। আদি অথবা অন্তিম শব্দ।


No comments:

Post a Comment