Monday, 16 August 2021

প্রদীপের নিচে অন্ধকার

যদিও জনমোহিনী সামাজিক প্রকল্পই এখন রাজনীতি

সোমনাথ গুহ


গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রথম যখন 'দুয়ারে সরকার' প্রকল্প শুরু হয়েছিল, তখন বিজেপির বঙ্গ বিজয়ের অভিলাষ তুঙ্গে। প্রচুর অর্থ, প্রচার, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সীমাহীন প্রশ্রয়ে বলীয়ান, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এই দল ব্যঙ্গ করে বলেছিল- যমের দুয়ারে সরকার। আজ সাত মাস বাদে আমরা এক উলটপুরাণ প্রত্যক্ষ করছি: প্রবল প্রত্যাশা জাগিয়ে দুয়ারে সরকার ২.০ যখন শুরু হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় চমকপ্রদ সাফল্যের পর দিল্লি, ত্রিপুরায় ডানা মেলার চেষ্টা করছে আর প্রবল গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে দীর্ণ রাজ্য বিজেপি দিশাহারা, নিজেদের ঘর সামলাতে রীতিমতো খাবি খাচ্ছে। রাজ্যের প্রধান বাম দল ভুল স্বীকার করেছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুদান-নির্ভর সামাজিক প্রকল্পগুলিকে ভিক্ষার ঝুলি বলা তাদের ভুল হয়েছিল; মানুষের কাছে ভুল বার্তা গেছে। তারা তো বটেই, অন্য বাম দলগুলিও দিশাহীন। কারণ, এটা পরিষ্কার যে এই প্রকল্পগুলি বিপুল সংখ্যক মানুষকে উপকৃত করেছে যার ফলে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, মেহনতী মানুষের ওপর মুখ্যমন্ত্রী প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন। হায়, যা ছিল এক সময় প্রধানত সিপিএম এবং অন্য বাম দলগুলির অটুট জনভিত্তি তাতে আজ তারা আর দাঁত ফোটাতে পারছে না।  

শুধুমাত্র সংখ্যার নিরিখেই এই প্রকল্পগুলির সাফল্য তাক লাগানো। প্রথম 'দুয়ারে সরকার' প্রকল্পে ৩২,৮৩০টি ক্যাম্প হয়েছিল যাতে ২ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। এক কোটি ৭৭ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছিল, যার মধ্যে ২০০০ বাদে বাকি সব মঞ্জুর হয়েছিল। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেয়েছেন ৮৫ লক্ষ মানুষ, জাতি শংসাপত্র পেয়েছেন ২২ লক্ষ,  'কৃষক বন্ধু' প্রকল্পে সাহায্য পেয়েছেন ৬২ লক্ষ মানুষ। 'পাড়ায় সমাধান' প্রকল্পে ১০,০০০ আবেদনের মধ্যে ৭৫০০ সমাধান হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ‘পাবলিক টু সিএম’, যে প্রকল্পে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে অভাব অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাতে গত দেড় বছরে ১২ লক্ষ সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। মহিলাদের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে এই প্রকল্পগুলি, ভোটবাক্সে যার প্রতিফলন দেখা গেছে। বলা হচ্ছে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী'র মাধ্যমে তিনি ৪৮ শতাংশ মহিলার কাছে পৌঁছে গেছেন। গতবার ছিল বারোটা প্রকল্প, এবার হয়েছে আঠারোটা, যার মধ্যে আছে 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার'এর মতো প্রকল্প যা ইতিমধ্যেই মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। আছে 'স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড' যার অপকারিতা সম্পর্কে বিদ্বজ্জনেরা জ্ঞান দিলেও গরিব ছাত্ররা কিন্তু এটাকে উচ্চশিক্ষার সোপান হিসাবে মনে করছে। 

কোনও সন্দেহ নেই, এই প্রকল্পগুলির ফলে মুখ্যমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন। এই ধরনের জনমোহিনী রাজনীতি নতুন নয়, বিশেষ করে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে তা বহু দিন ধরেই চালু আছে। সেই ১৯৬৭ সালে ডিএমকে'র প্রবল প্রতিপত্তিশালী প্রতিষ্ঠাতা সি এন আন্নাদুরাই  প্রথম এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছিলেন। তিনি দুঃস্থ মানুষদের এক টাকায় সাড়ে চার কিলো চাল দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে ভোটে বাজিমাত করেছিলেন। ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এন টি রামা রাও অন্ধ্রপ্রদেশে রীতিমতো সাড়া জাগিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তাঁর জয়ের অন্যতম কারণ ছিল দু' টাকা কেজি চাল দেওয়ার  প্রতিশ্রুতি। এবারের তামিলনাড়ু নির্বাচনে ডিএমকে এক বছরের মাতৃত্ব ছুটি এবং মহিলাদের বাস ভাড়া মকুব করে দিয়ে তাদের বিপুল সমর্থন নিশ্চিত করেছে। মন্দির সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ, এমনকি তীর্থযাত্রার জন্য অর্থ দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংখ্যাগুরু মানুষদের তুষ্ট করেছে এবং হেলায় নির্বাচন জিতেছে। এগুলি হল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যার কিছু পূরণ হয়, অনেকটাই হয় না। গালভরা প্রতিশ্রুতির কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্বাচনী ইস্তাহারগুলি হাস্যাস্পদ হয়ে দাঁড়ায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকল্পগুলি কিন্তু নিছক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নয়। তিনি জনমোহিনী রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন এনেছেন; তিনি এই প্রকল্পগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, বছরে দুবার দুয়ারে সরকার হবে। এর অর্থ ১৮টি প্রকল্প পাঁচ বছর ধরে প্রতিটা দিন চালু থাকবে। 

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। সাধারণ মানুষের কাছে সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি এমন একটি ব্যাপার যা ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভোটের সময় তাদের প্রতিনিধিদের টিকিটা মাত্র দেখা যায়, তাই মানুষ ভাবেন এদের ওপর ভরসা করে লাভ নেই, নিজেকেই করে কম্মে খেতে হবে। অর্থাৎ, সরকার আর মানুষের মধ্যে এক অলঙ্ঘনীয় ফাঁক থাকে যা ভরাট হবার নয়। 'দুয়ারে সরকার' নামক কনসেপ্ট এই ফাঁক অনেকটা ভরাট করে দিচ্ছে, সরকারকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসছে, মানুষ ভাবছে এটা আমাদেরই সরকার।   

মুদ্রার একটা পিঠ যদি এরকম ঝলমলে হয়, অন্য পিঠটা বিবর্ণ, অন্ধকার না হলেও মলিন। নার্সরা বেতন সমতার জন্য কয়েক বছর ধরে সোচ্চার, কোনও সমাধান নেই। তাঁদের দাবি মেটানোর জন্য আবার প্রায় ছয় মাস সময় চাওয়া হয়েছে। এসএসসি প্রার্থীরা পরীক্ষায় পাস করার পরেও ২০১৬ থেকে নিয়োগপত্রের আশায় বসে আছেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও নতুন সরকার এখনও অবধি তাঁদের সমস্যার কোনও সমাধান করে উঠতে পারেনি। ঝড় জলের মধ্যে তাঁরা অবস্থান করেছেন, পুলিশ মারধোর করে তাঁদের তুলে দিয়েছে, সরকার আদৌ তাঁদের নিয়োগ করতে আগ্রহী কিনা তাও এখনও পরিষ্কার না। গ্রুপ ডি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। প্রায় ৫৮০টি পদ এখনও খালি রয়েছে, ১২০০ নাম ওয়েটিং লিস্টে রয়েছে কিন্তু এই শূন্য পদগুলি পূরণ করা হচ্ছে না। অনেক ঘটা করে ‘খেলা হবে’ দিবস হচ্ছে, ক্লাবগুলোকে লাখ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে, প্রচুর ফুটবল বিলি হচ্ছে, খেলাধুলোর কিছু উন্নতি হচ্ছে কী? ভারতীয় ফুটবল দলে বাঙালি খেলোয়াড় এখন দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয় অথচ এই বাংলাকে এক সময় ফুটবলের মক্কা হিসাবে গণ্য করা হত। অলিম্পিকে ছোট রাজ্যগুলি সাফল্য পাচ্ছে, বাংলার কেউ নেই। থাকবে কী করে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিকাঠামো নেই, অনুশীলন করতে অন্যত্র যেতে হয়। হকি খেলা তো উঠেই গেছে। অথচ এক সময় দেশের সেরা খেলোয়াড়রা কলকাতার মাঠে খেলে গেছেন। সেই ২০১৬ সালে একটা অ্যাস্ট্রো টার্ফ মাঠ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এখনও সেই প্রকল্প বিশ বাঁও জলে। প্রবাদপ্রতিম গুরুবক্স সিং চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। রাজ্যের বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থাগুলো চাটুকারদের আখড়া, খেলাধুলোর উন্নতি করার কোনও আগ্রহই তাঁদের নেই।   

তাই, প্রদীপের তলায় অন্ধকার আছে। বাম দলগুলিকে শ্রেণি আন্দোলনে জোর দিতে হবে। 'কৃষক বন্ধু' প্রকল্পে শুধু যাঁদের জমি আছে তাঁরা টাকা পাচ্ছেন, এক একরের কম জমি থাকলে ৪০০০ টাকা, তার বেশি হলে ১০,০০০ টাকা। ভূমিহীন চাষি, ক্ষেতমজুরদের কী হবে? কৃষকদের নিয়ে তো চরম দ্বিচারিতা চলছে। দিল্লিতে সংগ্রামরত কৃষকদের আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছি অথচ নিজের রাজ্যে মান্ডি প্রবল ভাবে অপ্রতুল, কৃষিপণ্যের ন্যূনতম দাম পাওয়া তো স্বপ্নের শামিল। এসব নিয়ে বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলিরও কোনও হেলদোল নেই, তারা ধর্মতলায় অবস্থান করেই সন্তুষ্ট। বাংলার কৃষকের কী সমস্যা সেটা নিয়ে তারা আদৌ ওয়াকিবহাল কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে! 

শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রের নয়া শ্রম বিধিও নাকি এই রাজ্যে লাগু হবে। সেটা হলে সর্বতোভাবে তার বিরোধিতা করতে হবে। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি নিয়ে লুকোচুরি চলছে। বলা হচ্ছে, ৬৩ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁরা কারা তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও ঘোষণা নেই। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার জোরদার দাবি করতে হবে। যাঁরা ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত তাঁদেরকে এই ধারা থেকে মুক্তি দিতে হবে; সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে এই রাজ্যে ইউএপিএ প্রয়োগ করা হবে না। বাংলায় ৯০ শতাংশ কৃষকের জমি দুই একরের কম। এখানে বহু বছর ধরে সরকারি ব্যবস্থা দুর্বল, এমএসপি প্রায় কেউই পায় না। এখানে মান্ডি ব্যবস্থা আরও প্রসারিত করতে হবে, কৃষক যাতে চাষের লাভজনক দাম পায় তা নিশ্চিত করতে হবে, অভাবী বিক্রি বন্ধ করতে হবে। বাংলার মতো রাজ্যে সরকারকে চাষির স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। আক্রমণের বর্শামুখ অবশ্যই আরএসএস-বিজেপি মুখি হতে হবে। কিন্তু আবার হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতার পুরো পরিসর তৃণমূলের হাতে ন্যস্ত করা যাবে না। তাহলে তো বাম দলগুলিকে হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হয়। মুখ্যমন্ত্রীর জনমোহিনী প্রকল্পগুলির সুবিধা যাতে মানুষ পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে, একই সাথে বাম রাজনীতির ভিত নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।


5 comments:

  1. 🎯
    বাহ্, ভালো লেখা । মোটামুটি ব্যালেন্স লেখা । সোমনাথদা যে বর্তমান সরকারের ভালো ও মন্দ দুটো দিকই, দুটো দিক নিয়েই-- সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়েই যে লেখাটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেইজন্য ওনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ । অনেক সুবিধাবাদী, ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবীদের (🩴👅) মত মমতা সরকারের পদলেহন করেই চলেন নি সোমনাথদা । ভালো-মন্দ দুটো দিকই তুলে ধরেছেন লেখায় । সোমনাথদা'র লেখা এইজন্যই এত ভালো লাগে । 🌹♥️🤝🏼

    ReplyDelete
  2. বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রষ্ফুটিত লেখকের সাবলীল লেখনীতে। তথাকথিত বাম রাজনৈতিক দলগুলোর আশু কর্তব্য সম্পর্কেও মতামত দেয়া হয়েছে। সোমনাথ গুহর অন্য আরো লেখার মতোই আবারও ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। এইসময়ে সাংবিধানিকভাবে সমগ্র বাম ও প্রগতিশীল দলগুলোর সংঘবদ্ধতা ও ঐকবদ্ধ আন্দোলন নিয়ে কোনো লেখার প্রতিখ্যায় রইলাম।

    ReplyDelete

  3. বেশ ভালো লেখা। দিশা দেখিয়েছেন।
    লেখক কে অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই।

    ReplyDelete
  4. বক্তব্য পরিস্কার । বিজেপির ভাঁওতাবাজীর বিরুদ্ধে মমতা এককট্টা লড়াইও প্রসংশার।
    লেখাটি তথ্য বহুল।
    ধন্যবাদ

    ReplyDelete