Thursday, 26 August 2021

ক্রুসেড'এর ধারাবাহিকতা

তালিবান, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

শোভনলাল চক্রবর্তী


জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর 'অব্যক্ত' গ্রন্থের 'ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে' প্রবন্ধে যখন নদীকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'নদী তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?', তখন উত্তর পেয়েছিলেন, 'মহাদেবের জটা হইতে।' আমাদের শিরোনামের এমন সহজ উত্তর পেলে বড় ভালো হত। কিন্তু এ এক রক্তবীজ, যার জন্মান্তর ঘটে বারবার। গেলাম আর বোমা মেরে নিশ্চিহ্ন করে এলাম- সে প্রতিপক্ষ এরা নয়। এদের দেখলে মাইকেল হয়তো রামচন্দ্রের জায়গায় এদের বসিয়ে দিয়ে বলতেন, মরিয়া না মরে, এ কেমন বৈরী। 

ইতিহাস সন্দেহাতীত ভাবে নির্মম। সেই ইতিহাস বলে, মধ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামি সন্ত্রাস আসলে আমেরিকা ও তার লেজুড় দেশগুলির অন্ধ, নির্বিচার আঘাতের বিরুদ্ধে এক ধরনের অন্ধ ও নির্মম প্রত্যাঘাত। ব্রিটিশ-মার্কিন মিলিত বাহিনী ইরাকে যে অপপ্রয়াস চালায়, তাকেই ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের ধাত্রী বলা যেতে পারে। ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে যখন ইসলামি জঙ্গি সংগঠন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি তাদের সম্পর্কে এক আপাত অবজ্ঞা প্রকাশ করেন, যা আসলে ছিল ওই জঙ্গি সংগঠনগুলিকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে তাদের বিষদাঁত উপরে ফেলতে না পারার দরুণ এক চরম ব্যর্থতার হতাশা। ওবামা বর্ণিত সামান্য কয়েকজন 'খুনি'র জন্য আমেরিকাকে লড়তে হয়েছে প্রায় একটা বিষযুদ্ধ। সারা দুনিয়া জুড়ে ঘুরে ঘুরে জোটাতে হয়েছে সঙ্গী। এত করেও শেষ করা যায়নি ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের ক্রিয়াকলাপ। 

রাজনৈতিক স্বৈরাচারই রাজনৈতিক ইসলামের নিয়তি কিনা, সে বিচার করবে সময়। বর্তমানে তালিবান সহ ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলি আদতে একটি ইসলামি খিলাফতের স্বপ্ন রচনা করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে  অটোমান খলিফার পরাজয়ের পর থেকে মুসলিম বিশ্বে ইসলামের হারানো সুদিন ফিরে পাওয়ার যে আকুতি ছিল, তাকে উসকে দিয়েছে। দেশে দেশে মুসলিম যুবকরা যে ভাবে সেই স্বপ্নের টানে ইসলামি জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে তার হিসেব করা শক্ত। যে ভাবে এই যুবকরা জেহাদে অংশ নিয়ে শহিদ হতে ঝাঁকে ঝাঁকে দৌড়েছে, তা সেই মিলেনারিয়ান স্বপ্নের অমোঘ আকর্ষণকেই প্রতিপন্ন করে। দশম- একাদশ শতাব্দীর ধর্মযুদ্ধের যুগে যা ইসলামকে প্রাণিত, তাড়িত করেছিল। এই যোগদানের পেছনে অতিরিক্ত তাড়না হিসেবে সক্রিয় থেকেছে ইসলাম আতঙ্ক এবং অবশ্যই নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, দারিদ্র পীড়িত, ধর্মীয় বৈষম্যে জর্জরিত, আত্মপরিচয় উন্মুখ এক জনগোষ্ঠীর মরিয়া প্রতিকারকামিতা। 

কেন রাষ্ট্রীয় সমানাধিকারের ঢক্কানিনাদ এবং সাম্য, স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্বের গালভরা বুলির চেয়ে ইসলামের সাম্যাদর্শ এই তরুণদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে, সেই আত্মসমীক্ষা করার সময় এসেছে। আসলে এদের বর্বরতাকে ধিক্কার জানানো খুব সহজ। সত্যিই হাত, পা, গলা কাটা, কিংবা নির্বিকার চিত্তে মানুষ খুনের ভিডিওগুলি ভয়ঙ্কর। কিন্তু একবার মনে করে দেখুন তো, মার্কিন বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রে যখন মেসোপটেমিয়া, সুমের ও ব্যাবিলন ধূলিসাৎ হচ্ছিল, যখন আফগানিস্তানকে বোমায় বোমায় প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন পশ্চিমি মিডিয়ার ক্যামেরাগুলো কোথায় লুকনো ছিল? 

আচ্ছা, মেসোপটেমিয়াকে কে ইরাক বানালো? কে গড়ে তুলল ইসলামের দুই পবিত্রতম তীর্থ মক্কা, মদিনার দখল নিয়ে তৈরি কাল্পনিক ভূখণ্ডে সৌদি আরব এবং তার শাসক হিসেবে বৈধতা দিল সৌদি সর্দারদের, যাঁরা সবচেয়ে গোঁড়া? প্রতিক্রিয়াশীল সুন্নি ইসলামকে পরবর্তী একশো বছর ধরে ওয়াহাবি ও সালাফি মতাদর্শে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দূষিত করে ইসলামের মধ্যযুগীয় উদারনীতি ধ্বংস করে দিল কারা? অবশ্যই ইউরোপিয় পাশ্চাত্য, বিশেষত ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, যারা পরাজিত অটোমান খলিফার সাম্রাজ্যকে ইচ্ছেমতো টুকরো করে মানচিত্রে পেন্সিল দাগিয়ে সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে পশ্চিম এশিয়ার এক একটি মুসলিম রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ও সীমানা নির্ধারণ করার অনুমতি আদায় করেছিল লিগ অফ নেশনস'এর কাছ থেকে। 

এখনও যে  তালিবান সহ ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলির তীর শুধুই শিয়া ইসলামের দিকে তাক করা, তার পেছনে কি সৌদি পেট্রো ডলারের হাত নেই? যে পশ্চিমি সভ্যতা ইসলাম ধর্মকে প্রাচীনতর অন্যান্য সেমেটিক ধর্ম থেকে টুকে মেরে দেওয়া বলে অপবাদ দিয়েছিল, একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ লড়েছিল, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কোনও দায় এদের নেই। এরা গোটা পশ্চিমকে, তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা সব কিছুকে 'হারাম' বলে ঘৃণা করে। মুশকিল এই যে, গুলি মেরে খিলাফতের স্বপ্ন মুসলিম মানস ও চৈতন্য থেকে ঘুচিয়ে দেওয়া অসম্ভব। স্যামুয়েল হাটিংটনের 'সভ্যতার সংঘাত' বিষয়ক তত্ত্বটি এ ক্ষেত্রে এখনও দীর্ঘকাল বৈধ থাকবে বলে মনে হয়। 

ইউরোপিয় ও মার্কিন নয়া-উপনিবেশবাদীরা মুসলিম প্রাচ্যকে নিজের প্রয়োজনে শোষণ করার ধনবাদী প্রবণতা রোধ করতে অপারগ। আর এই প্রবণতা যতদিন সক্রিয় থাকবে, এডওয়ার্ড সাঈদ কথিত প্রাচ্যবাদী বাচন যত দিন পাশ্চাত্য মেধা ও মননকে ইসলামের প্রতি তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার মনোভাব নিয়ে তাকাতে প্ররোচিত করবে, ইউরোপিয় চেতনার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা ক্রুসেড মানসিকতা যত দিন ইসলামোফোবিয়ায় রূপান্তরিত হতে থাকবে, ততদিন নিছক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার আঙিনা থেকে রাজনৈতিক ইসলামের হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক বিবর্তন রুদ্ধ করা যাবে না।


No comments:

Post a Comment