Sunday, 1 August 2021

শিক্ষাদীক্ষার অশ্বডিম্ব!

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সিঁদুরে মেঘ

শোভনলাল চক্রবর্তী


জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেছেন যা ইতিমধ্যেই সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলা সহ আরও চারটি আঞ্চলিক ভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ, ডাক্তারি পড়ার পরিকাঠামো বাড়ানোর জন্য আরও কলেজ তৈরি, যার মধ্যে বাংলায় তৈরি হবে দুটি নতুন কলেজ, ডাক্তারি পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে ওবিসি সংরক্ষণ বৃদ্ধি করা (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে নয়া মন্ত্রীসভাতেও ওবিসি মুখের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে)। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এই ওবিসি প্রেম। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্প যেমন, গ্রামে প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের জন্য 'বিদ্যাপ্রবেশ', শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য 'নিষ্ঠা ২.০' উল্লেখযোগ্য। সাইন ল্যাংগুয়েজ (সাংকেতিক ভাষা)কে  পৃথক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যা বিশেষভাবে সক্ষম পড়ুয়াদের উপকারে লাগবে। 

এই পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। এর পরেই প্রধানমন্ত্রীর ঝুলি থেকে বেরিয়েছে একাধিক বেড়াল যাতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে শিক্ষাবিদ মহলে। প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন উচ্চ শিক্ষায় একাডেমিক ব্যাংক অফ ক্রেডিটের কথা, যা নিয়ে চটজলদি নির্দেশিকা জারি করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। যে নির্দেশিকা অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষায় যে কোনও সময় পড়ুয়ারা যে কোনও কোর্সে ভর্তি হতে ও ছাড়তে পারবে। এহ বাহ্য, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েও পরে ফের সংশ্লিষ্ট বা অন্য কোর্সে যুক্ত হয়ে ক্রেডিট তুলে ডিগ্রি পেতে পারবেন! এমন মামাবাড়ি ব্যবস্থায় পড়াশোনা যে ক্রমে লাটে উঠবে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন আছে কী? প্রধানমন্ত্রীর তরফে এই ক্রেডিট ব্যাংকের সুবিধা সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, এর ফলে উচ্চ শিক্ষায় পড়ুয়ারা একসঙ্গে সম্পর্কহীন অনেক বিষয়ে পড়তে পারবেন, যেমন, কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং'এর পড়ুয়া ইচ্ছে করলে মিউজিক বা ইতিহাস থেকে ক্রেডিট সংগ্রহ করতে পারবেন। এতে তাঁদের জানার ও জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। 

এখানে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে, উচ্চ শিক্ষায় পড়ুয়ারা একসঙ্গে অনেকগুলি সম্পর্কহীন বিষয়ে পড়ে কী করবেন?  উচ্চ শিক্ষায় পড়ুয়ারা যান কোনও একটি বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার জন্য। তবে কি সেই রাস্তা সুকৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে? এই নীতির ফলে শিক্ষার মান লঘু হবে এবং গভীর জ্ঞানচর্চার সুযোগ আর থাকবে না। বোঝা যাচ্ছে যে, সরকার বাহাদুর উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এমন মানুষ চাইছেন যারা প্রকৃত অর্থেই হবে 'জ্যাক অফ অল ট্রেড, মাস্টার অফ নান'। 

এ তো গেল বহিরঙ্গের দিকটা। এবার আসা যাক প্রয়োগগত দিকটায়। প্রথমত, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে যে সেমেস্টার ও চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম চালু করা হয়েছে তার সুযোগ বাস্তবে কত জন পরীক্ষার্থী পান, তার কোনও হিসেব কি সরকার পক্ষের কাছে আছে? থাকলে দেখা যেত, সেই সুযোগ পাচ্ছেন শুধুই সমাজের উঁচুতলার মানুষ। ক্রেডিট ব্যাংকে উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী পড়ুয়ারা একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহু বিষয়ে প্রয়োজনীয় ক্রেডিট সংগ্রহ করে ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন। এই ক্রেডিট দেশি-বিদেশি যে কোনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সংগ্রহ করা যাবে। বেশ, কিন্তু কীসের বিনিময়ে? সেখানেই আসল খেলা। বিনিময় মূল্য এখানে মেধা নয়, শুধুই অর্থ। একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট সংগ্রহের জন্য প্রচুর ফি গুনতে হবে। উচ্চ শিক্ষার খরচ এক ধাপে অনেকটা বেড়ে যাবে। ক্রেডিট ব্যাংক চালু হলে বেসরকারি ও বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিই ফয়দা পাবে এবং শহরের ধনী ঘরের পড়ুয়ারা টাকার বিনিময়ে ক্রেডিট সংগ্রহ করবে। বিপাকে পড়বে গ্রামের ও দরিদ্র ঘরের পড়ুয়ারা। উচ্চ শিক্ষায় এইসব সুযোগ পেতে গেলে আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে  ন্যাক'এর 'এ' গ্রেডে থাকতে হবে, এনবিএ'তে ৬৫০ পয়েন্টে থাকতে হবে এবং বিভিন্ন বিদেশি র‍্যাঙ্কিং-এর প্রথম সারিতে থাকতে হবে। আমাদের দেশের ক'টা সরকারি প্রতিষ্ঠান সেই তালিকায় আছে? এই প্রশ্নের উত্তর হাওয়ায় উড়ছে। 

এবার আসা যাক অনলাইন পড়াশোনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে, যা আমাদের দেশের পড়াশোনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে। সারা দেশ জুড়ে যখন প্রায় সমস্ত শিক্ষক সংগঠন অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা সম্পর্কে তাঁদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তখন সবাইকে চমকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে অনলাইনে পড়াশোনাতেই দেশের ভবিষ্যৎ। তিনি অনলাইন ক্লাসের ভূয়সী প্রশংসা করেন ও বলেন যে পরীক্ষা অনলাইন হওয়ায় পড়ুয়াদের পরীক্ষা ভীতি কেটে গেছে এবং তারা চাপহীন হয়ে পড়াশোনা করছে। আমাদের মতো গরিব দেশে অনলাইন ক্লাস করার পরিকাঠামো, যেমন স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সংযোগ, উপযুক্ত ডাটা ইত্যাদিতে পয়সা খরচ করা যখন একটা বিপুল অংশের মানুষের কাছে স্বপ্ন এবং একটা আরও বড় অংশের মানুষের কাছে বিলাসিতা, তখন সে সব ভুলে গিয়েও যদি চারপাশে তাকাই তাহলে বাস্তবতা কি তাই? দেখা যাচ্ছে, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক এবং ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অনলাইন পড়া অনেকটাই সামলাচ্ছেন পড়ুয়ার বাবা মায়েরা। স্কুল থেকে নির্দেশিকা দিয়ে বলা হচ্ছে যে পড়ুয়ারা ঠিক করে নিয়মিত ক্লাস করছে কিনা তার দেখভাল করতে হবে বাবা মাকেই। ফলে এখন বেশিরভাগ বাড়ির একটি ঘর ক্লাসরুম, অন্য ঘরটি বাবা বা মায়ের অফিস। বাড়ি বলে আর কিছু নেই। যে বাড়িতে বাবা মা দুজনেই কর্মরত সেখানে অবস্থা আরও খারাপ। বহু বাবা মায়ের চাকরি গেছে করোনা কালবেলায়। সেখানে বেড়েছে গার্হস্থ্য হিংসা যার শিকার শিশুরা। জাতীয় শিশু অধিকার কমিশন তাদের রিপোর্টে তুলে ধরেছে সেই ছবি। এই ভয়ঙ্কর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ক্লাসের স্মার্টফোন গ্রাস করেছে শৈশব। আকাশ, রূপকথা, গান, নদী, ছড়া ভুলে তারা ডুব দিয়েছে মোবাইলের অতলে। আমাদের দেশের তেরো বছরের বেশি যাদের বয়স তাদের ক্লাস করার জন্য প্রয়োজন হয়েছে স্মার্টফোন, তাদের ৩৭ শতাংশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে পর্ন সাইটে। দশ বছর বয়সী যারা তারা আসল বন্ধু ছেড়ে মেতেছে সমাজ মাধ্যমের নকল ফ্রেন্ড নিয়ে। এর ফলে এদের শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। এরা ক্রমশ হয়ে উঠছে ভাঙা মনের মানুষ, অস্থির, বিরক্ত, স্বার্থপর। সমীক্ষাটি এই পরিস্থিতিতে সরাসরি দায়ী করেছে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থাকে। ছোট, মেজ, বড় সবার কাছেই স্মার্টফোন। পর্দা থেকে দিদিমণি, মাস্টারমশাইরা সরে গেলেই মোবাইল তার মায়া, বিভ্রম, মোহের রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে অপরিণত মনের কাছে। সে বড় ভয়ঙ্কর হাতছানি: মিথ্যের, অপরাধের, লোভের। 

প্রযুক্তির জয়গান গেয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা বন্ধ হোক। ধিক এই মোবাইল নিয়ে দিনরাত বসে থাকার প্রযুক্তি। আগুন প্রয়োজন, বিদ্যুৎ প্রয়োজন- তবে সে কি হাতে করে খেলার জিনিস? স্মার্টফোন দিয়ে অনলাইন ক্লাস হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতবর্ষের মতো গরিব দেশের জন্য অনলাইন ক্লাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হতে পারত টেলিভিশন চ্যানেল। চ্যানেল বাড়িয়ে ইচ্ছামতো ক্লাস করা যেত। তাতে খরচ কমত। একটা টেলিভিশন দিয়ে অনেকে ক্লাস করতে পারত। কিন্তু আমাদের দেশ ধর তক্তা মার পেরেকের দেশ। যে প্রধানমন্ত্রীর সরকার বলছে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে করোনায় কোনও সমস্যা হয়নি, অক্সিজেন ঘাটতির জন্য কেউ মারা যাননি, তারা যে দুদিন পরেই বলবে দিল্লির বুকে কোনও গণচিতা জ্বলেনি, গঙ্গা দিয়ে কোনও শব ভেসে যায়নি, তাতে আর আশ্চর্য কী। আর তারাই একটা প্রজন্মকে পঙ্গু করে দিয়ে বলছে অনলাইন ক্লাস লা জবাব, এটাই স্বাভাবিক। 

একাদশ-দ্বাদশ ও কলেজের অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো। সেখানে ক্লাস চলছে ক্লাসের মতো, পাশাপাশি চলছে উচ্চগ্রামে গান, গেম, নেটফ্লিক্স, লাইভ সেক্স চ্যাট (এই দলটি আবার পর্ন সাইট দেখে দেখে ক্লান্ত) ইত্যাদি। হাতে গোনা দু' চারজন ক্লাস করে। অনলাইন পরীক্ষা এখন পুরোটাই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে চুরি। এটা সবাই জানেন এবং মেনে নিয়েছেন। পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধানের জন্য এখন অনেককে পাওয়া যায়, অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। স্কুল, কলেজ সমস্ত স্তরে এই ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। এছাড়াও নেটের যে কোনও সার্চ ইঞ্জিনে প্রশ্ন টাইপ করে দিলেই উত্তর পাওয়া যায়। সেটাই পড়ুয়ারা লেখে। লিখে পুরো নম্বর পায়। কম নম্বর দেওয়া হলে বাবা মায়েরা স্কুলে এসে মোবাইল খুলে দেখিয়ে দেন যে তাঁর সন্তান ঠিক লিখেছে! বেশির ভাগ পড়ুয়ার কাছেই পড়ার জন্য পাঠ্য বই বলে আর কিছু নেই। কারণ, পড়ার কিছু নেই, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এখন আর কিছু পড়ার দরকার হয় না। সত্যিই পড়াশোনা আজ একটা দূরগত নক্ষত্রের মতো। 

এই গা শিউরে ওঠা ব্যবস্থার জয়গান গাইছেন প্রধানমন্ত্রী! বোঝাই যাচ্ছে, তিনি চাইছেন সবাই তাঁর মতো শিক্ষিত হয়ে উঠুন। স্কুল, কলেজ খোলা আপাতত অতএব দূর অস্ত। আমাদের দেশে লেখাপড়ার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে গেলে এখন একটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের দরকার। সেই যুদ্ধ লড়ার লোক সহজে পাওয়া যাবে কী?

 

5 comments:

  1. 🚨📚📲

    বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারা তুলে ধরেছেন লেখক ।🪞
    🙁😌

    ReplyDelete
  2. অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী,আজ দেশের মানুষের সম্যক উপলব্ধ হচ্ছে।

    ReplyDelete
  3. এত পড়াশুনা করেই কি লাভ? শিক্ষার উপযুক্ত চাকরি নেই। Tax এর টাকায় কোটি কোটি শিক্ষিত বেকার তৈরি করা বন্ধ হওয়া দরকার।

    ReplyDelete
  4. গ্যাট চুক্তি, পেটেন্ট আইন চালু করে শিক্ষার তে অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছিল,তার এখন পঞ্চত্বপ্রাপতি পূর্নতা পেল।

    ReplyDelete
  5. বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার একেবারে হাঁড়ির খবর তুলে ধরেছেন।-শুভজিৎ

    ReplyDelete