Tuesday, 3 August 2021

শিক্ষা যখন পণ্যগ্রাসী

সাক্ষরতার ভিন্ন ভুবন

প্রবুদ্ধ বাগচী


ছেলেটাকে দেখে মনে হয়েছিল বেশ চৌখস। কোম্পানির দেওয়া ইউনিফর্ম পরে যখন কাজে এল, প্রথমেই খুব পেশাদারি ভাবে তার কোম্পানির পরিষেবা সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ ভাষণ শুনতে হল আমায়। তারপর কাজ। আদপে সে একজন ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি। সদ্য চালু হওয়া অ্যাপ-নির্ভর গৃহস্থালির পরিষেবা কেন্দ্র থেকে বুকিং করতে হয়েছিল তাকে। অবশ্য তাকে ঠিক নয়, এলাকা অনুসারে কোম্পানিই তাকে কাজে পাঠায়। তার কোম্পানির অ্যাপটির খুঁটিনাটি অত বিশদে সত্যিই আমার জানা ছিল না। তার কাছেই শিখলাম, বলতে গেলে প্রায় হাতেনাতে। কীভাবে বুক করলে রিবেট পাওয়া যায়, কীভাবে টাকা পেমেন্ট করে রশিদ পাওয়া যায়, কীভাবেই বা ফিডব্যাক দেওয়া যায় সব সে আমায় শিখিয়ে দিল। কিন্তু মুশকিল হল, যখন আমি তাকে বললাম আপনি যে সব যন্ত্রাংশ কিনে আনলেন তার একটা হাতে লেখা রশিদ দিন। লেখা ও সই করায় দেখলাম তার প্রবল আড়ষ্টতা। কার্যত কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হাতের লেখায় যে কাগজ আমি হাতে পেলাম তার মর্মোদ্ধার করা কঠিন।

বস্তুত এই ধরনের ঘটনা যে খুব নতুন তা নয়। রাস্তাঘাটে এমন অনেক মানুষের এখন দেখা মেলে যারা নিজেরা শিক্ষা ও সামর্থ্যে তেমন পোক্ত না হলেও মোবাইল ফোন, বিশেষত স্মার্ট ফোন নিয়ে তাদের একটা অন্যরকম সাক্ষরতা আছে। নিজে চোখে দেখেছি রিকশায় আয়েস করে বসে রিকশাচালক হাতের স্মার্টফোনে ইউটিউবে ফিল্ম দেখছে, এমনকি তার জন্য সে সওয়ারি তুলতেও বিতৃষ্ণ। ভ্যানগাড়ির ওপর সব্জি সাজিয়ে পথে নামা যুবক বিক্রিবাটার অবসরে টুক টুক করে হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ আদান-প্রদান করছে। চলতে-ফিরতে অনেক তথাকথিত সাধারণ মানুষকে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেখতে পাই, নিজেরা সেলফি তুলছেন বা অন্য কোনও ছবি তুলে ফেলছেন হাতের ক্যামেরা-যুক্ত স্মার্টফোনে এবং দ্রুত নিজের বন্ধুমহলে তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফেসবুক বা অন্য কোনও মাধ্যমে ভর করে। পরিচিত এক ভদ্রমহিলার বাড়ি কাজ করেন এক মধ্যবয়সী গৃহ পরিচারিকা, যিনি জাতি পরিচয়ে তপশীলী উপজাতি এবং থাকেন বর্ধমান জেলার এক প্রান্তীয় ব্লকে- সম্পূর্ণ নিরক্ষর এই মহিলা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, দিব্যি হোয়াটসঅ্যাপ করতে পারেন।

এখানে দুটো বিষয়ে কথা বলার জায়গা আছে। প্রথমত, স্মার্টফোন প্রচলনের পর এবং প্রতিদিনে তার সর্বস্তরে উপযোগিতা বেড়ে বেড়ে চলার প্রেক্ষিতে একটা সমস্যার কথা আমরা শুনি- অনেক প্রবীণ/প্রবীণা সেই সঙ্গে অন্য একশ্রেণির মানুষ এই সুবিধার নাগাল না পেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন। বলা ভালো, একরকমের অসুবিধের সম্মুখীন হচ্ছেন। তাঁরা ফোন-নিরক্ষর- এই মর্মে একটা পরিভাষাই প্রায় চালু হয়ে গেছে। এঁরা যে সকলেই শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে আছেন তা মোটেও নয়, সমস্যাটা প্রযুক্তির সঙ্গে মোকাবিলা ও পরিচিত হওয়ার। খেয়াল করা দরকার, মোবাইল ফোনে ব্যবহারকারীর জন্য সমস্ত নির্দেশ দেওয়া থাকে ইংরেজি ভাষায়। ইদানীং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার হচ্ছে বটে কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড প্রযুক্তির আওতায় সেই অনুদিত বাংলার এমন হাল যে তা অনুসরণ করে কাজ চালানো দুষ্কর। মূলত ব্যবহারকারীরা ইংরেজি ভাষার নির্দেশ নিয়েই কাজ করেন। এটা তাই বেশ বিস্ময়কর যে শিক্ষিত সাক্ষর ব্যবহারকারীরা এইসব নির্দেশ মেনে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে ভয় পান, আড়ষ্ট হয়ে থাকেন অথচ প্রায়-নিরক্ষর মানুষও দিব্যি সেটা ব্যবহার করতে পারেন।

কেউ বলতেই পারেন, দৃষ্টিহীন বা বধির মানুষও তো লেখাপড়া শেখেন বা ডিগ্রি পান- শিখবার পদ্ধতির মধ্যে তফাত আছে। কিন্তু জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধকতা থাকলে তাঁদের শিক্ষার কিছু নিজস্ব প্রকরণ বৈজ্ঞানিকভাবেই তৈরি করা গেছে। তার সঙ্গে নিরক্ষর মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের তুলনা টানা সমীচীন নয়। কম্পিউটার প্রযুক্তিও আজকাল সকলেই ব্যবহার করতে পারেন। একটা সময় ছিল যখন কম্পিউটার বিষয়টা নিয়ে মানুষ কিছুই জানতেন না, মুষ্টিমেয় কিছু প্রযুক্তিবিদ ছাড়া। ডেস্কটপ বা পার্সোনাল কম্পিউটার (পিসি) এই ধারণায় একটা বিপ্লব এনে দিয়েছে বহুদিন আগেই। সম্ভবত গত শতকের শেষ দশকে লন্ডনের 'টাইমস' পত্রিকা ‘ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল একটি পার্সোনাল কম্পিউটারকে। প্রথম দিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছাত্ররাই এই যন্ত্রের সঙ্গে সড়গড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, যারা কম্পিউটারের প্রকৌশল জানতেন। কাকে বলে অপারেটিং সিস্টেম, কোনটা র‍্যাম, রম'এর সঙ্গে র‍্যামের কী পার্থক্য, হার্ড ডিস্ক আসলে কীভাবে কাজ করে, ফ্লোচার্ট কী ইত্যাদি ইত্যাদি খুঁটিনাটি জানতে হত। আজ তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আজ একজন কলা বিভাগের পড়ুয়া বা সাধারণ স্বল্প শিক্ষিত কেউ এতটুকু বিজ্ঞান বা কম্পিউটার প্রযুক্তি না-জেনেও তা অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন।

আসলে এর পেছনে একটা ভিন্ন কারণ আছে। প্রযুক্তি তার নিজের স্বার্থেই সাক্ষরতার এক নতুন পাঠ্যক্রম নির্মাণ করে নিয়েছে যা আমাদের চেনা আদলের শিক্ষা ও সাক্ষরতাকে তোয়াক্কা করে না। প্রযুক্তির আছে একটা অন্যরকমের ভাষা যা শেখার জন্য সহজপাঠ বা ফার্স্ট বুক পড়তে হয় না। এইটাই খেয়াল করার মতো বিষয়। যে কোনও যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা কথা শুনতে পাওয়া যায়- ‘ইউজার ফ্রেন্ডলি’ বা ‘ব্যবহারকারীর পক্ষে সহায়ক’- এই শব্দের পেছনে থেকে গেছে এক বিরাট আয়োজন। যন্ত্র ও প্রযুক্তিকে দ্রুত সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে গেলে অন্য একরকম সাক্ষরতার দরকার। কারণ, প্রযুক্তি কিন্তু স্বয়ম্ভু নয়, তার পেছনে বিপুল বিনিয়োগ আছে, আছে অপার পুঁজির স্বার্থ। তাই শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয় বিজ্ঞান বিভাগের পড়ুয়ার জন্য আর পার্সোনাল কম্পিউটার তৈরি করলে চলবে না। পিসি ছাড়িয়ে আরও নিজের মতো ল্যাপটপ- তার ক্রেতা চাই, বিপুল ক্রেতা চাই। এত ক্রেতা পেতে গেলে চাই সেই ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগের ভিন্ন এক ভাষ্য যা স্কুল-কলেজে শেখার প্রয়োজন হয় না। একইভাবে স্মার্টফোনের হরেকরকম প্রযুক্তি প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু ওই যারা শুধু পড়তে জানে লিখতে জানে তাঁদের দিকে তাকিয়ে স্মার্টফোন-এর বাণিজ্য চলা সম্ভব নয়। প্রচুর প্রচুর মানুষকে আনতে হবে উপভোক্তা হিসেবে, ক্রেতা হিসেবে, নইলে বিনিয়োগের ফসল ওঠে না।

সরকারি তথ্যও তো এর পক্ষে সায় দেয়। দেশের সাক্ষরতার হার প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ যারা কেবল স্বাক্ষর করতে পারেন। আর এই মুহূর্তে দেশে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করছেন ৭৬ কোটি মানুষ। আর এই বাজার বেড়ে বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের সঙ্গে জুড়েছে অনলাইন কেনাবেচা ও নানা পরিষেবার সুবিশাল জগৎ যার সুবিধে পেতে গেলে ওই দুটির কোনও একটি হাতে থাকা দরকার। সব মিলিয়ে এক প্রকাণ্ড সাম্রাজ্য। কম্পিউটার প্রযুক্তি মানে মাইক্রোসফট, স্মার্টফোন প্রযুক্তি মানে গুগল- এই কথা আজ অতি সাধারণ মানুষও জেনে গেছেন আর এই জ্ঞানের জন্য তাঁদের কোনও শিক্ষাসত্রে গিয়ে যোগ দিতে হয়নি, বিএ এমএ পাশ করতে হয়নি। প্রযুক্তির এক অন্য সাম্রাজ্য যারা তাদের ক্রেতার সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাজারের বিস্ফোরণ চায় তারা ঠিক তাদের মতো করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছে মানুষকে। যিনি নাম সই করতে জানেন না তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করতে জানেন, জানেন কীভাবে ইউটিউবে গান শুনতে হয় বা ছবি দেখতে হয়। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

লর্ড মেকলে নামে এক সাহেবকে এক সময় আমরা খুব গালমন্দ করেছি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের টিকে থাকার স্বার্থে তিনি আমাদের দেশে একরকম কেরানি তৈরি করার শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তার সেই বিখ্যাত লেখা আজকাল ইন্টারনেটে পড়া যায়। কিন্তু আজ তার থেকেও অনেক গুন বড় এক সাম্রাজ্য তার পণ্যের সঙ্গে জুড়ে দিতে পেরেছে ভিন্ন এক শিক্ষা আর সাক্ষরতার সিলেবাস। সমাজবিজ্ঞানের চর্চায় এই নতুন দিকটা আমরা খেয়াল রাখছি তো?


2 comments:

  1. পণ্য ও বানিজ্য পুঁজিবাদের বড় সাফল্য।
    শিক্ষা ও মূল্যবোধ এর গভীরে যাওয়া হয়নি।
    তাই সমাজ বদলের সূত্রগুলো ভিন্ন মুখী।

    ReplyDelete
  2. ভালো লেখা। বেশ সাবলিল সহজ ভাষায় ঝরঝরে লেখা।

    ReplyDelete