'রক্তচোষা পলাতক' প্রেসিডেন্ট গনি
ও হিংস্র তালিবানি দাপট
শোভনলাল চক্রবর্তী
দেশের মানুষকে ভয়ঙ্কর সঙ্কটে রেখে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহচরকে নিয়ে হেলিকপ্টার ও চারটি গাড়ি ভর্তি টাকাপয়সা সহ দেশত্যাগ করেছেন কাবুল পতনের আগেই। ফেসবুকে তিনি জানিয়েছেন, রক্তপাত এড়াতেই তাঁর এই দেশত্যাগ। গনি যে শেষমেশ আমেরিকাতে গিয়েই উঠবেন তাতে কারওর কোনও সন্দেহ নেই। আপাতত তিনি সংযুক্ত আমিরশাহী থেকে ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন যে দেশে থাকলে তাঁকে নাজিবুল্লা'র মতো ফাঁসি দেওয়া হত, তাই তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। জীবনের বড় একটা সময় তিনি আমেরিকায় কাটিয়েছেন। আমেরিকার 'পুতুল' হিসেবেই তিনি আফগানিস্তানের শাসনভার চালিয়েছেন, বহু মানুষের অপছন্দ সত্ত্বেও। দেশের চরমতম বিপদে গনি'র পলায়নে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বলছেন, 'ঈশ্বর তাঁকে ক্ষমা করবেন না।' সাংবাদিক আনিশা শাহিদ গনিকে বলেছেন বিশ্বাসঘাতক। তীব্র ঘৃণায় টুইটারে তিনি লিখেছেন, 'দেশের রক্ত চুষে একদল বিশ্বাসঘাতক দেশত্যাগ করেছে দেশবাসীকে ফ্যাসিস্টদের হাতে সঁপে! এই বিশ্বাসঘাতকদের কি শিং আর লেজও আছে।'
২০১৪ এবং ২০২০'এ দু' দফায় প্রেসিডেন্ট হলেও গনি কোনওদিনই দেশবাসীর আপন হতে পারেননি। লেবানন ও আমেরিকায় শিক্ষা ও কর্মজীবনের বেশির ভাগটা কাটানোর পর বাহাত্তর বছরের গনি দেশে ফেরেন আমেরিকান সেনা আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর। দেশ গঠনের নামে গনি এবং তাঁরই মতো বিদেশে বড় হওয়া কয়েকজন এলিটের সে ঘরে ফেরাকে দেশের মানুষ সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। দেশের মানুষ বুঝেছিলেন যে আমেরিকা পুতুল সরকার গঠনের ঘুঁটি সাজাচ্ছে। দু' দফা নির্বাচন জয়েও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। তিনি জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কথা কানে তুলতেন না বলে অভিযোগ। তাঁর সরকারের আমলে চলে দেদার লুঠ ও দুর্নীতি। নিজের ভাই থেকে শুরু করে বিদেশ ফেরত বন্ধুদের যাবতীয় বরাত বিলির মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য আসা আন্তর্জাতিক সাহায্য নয়ছয় করেছিলেন তিনি।
বস্তুত, চার দশকের যুদ্ধবিধ্বস্ত, অতীতের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় পড়ে থাকা দেশটার জন-পরিষেবা ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যয়ের ৭৫ শতাংশই বিদেশি সাহায্য। সরকারে থাকার সুবিধায় সেই অর্থের বিলি ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন গনি। তাঁর দেশবাসীদের মতে দেশ পুনর্গঠনে সব শক্তিকে নিয়ে চলার মনোভাব ও যোগ্যতাতেই ছিল ফাঁকি। নিজের ছোট্ট বৃত্তে আটকে থাকা এলিট সুলভ আত্মঅহঙ্কারি, দুঃসময়ে শেকড়হীন নেতার পলায়নই যে চেনা চিত্রনাট্য তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আফগানরা এখন তাঁদের পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্টকে বলছেন, 'রক্ত চোষা পলাতক'। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে মরিয়া আমেরিকা গনি'র কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের 'সেফ প্যাসেজ'এর শর্তে তাঁকে বাধ্য করে ৫০০০'রও বেশি গুরুতর অপরাধে বন্দী তালিবান জঙ্গিকে মুক্তি দিতে।
নব্বইয়ের দশকের শেষে তালিবান বলতে যেমন পাহাড়ি, খালি পা, শুষ্ক চেহারা, পুশতু ভাষায় কথা বলা জঙ্গি গোষ্ঠীকে দেখা যেত, সেই গোষ্ঠীই এখন হাতে রকেট লঞ্চার নিয়ে শহরে ঢুকছে অত্যাধুনিক সমরসাজের 'হামার' চড়ে। চোখে নাইটভিশন গগলস, সঙ্গে অটোমেটিক মেশিনগান, গলায় দামি ম্যাগাজিনের মালা। ইংরেজিতেও চোস্ত অনেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মানির সমরকৌশল 'ব্লিৎজরিগ'এর থেকেও বেশি গতিতে চলেছে এবারের তালিবান আগ্রাসন।
যে তালিবানকে ২০০১ সালে আমেরিকার বোমারু বিমান কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেয়, তারা কোন জাদুবলে রক্তবীজের মতো ফের ছড়িয়ে পড়ল কাবুলিওয়ালার দেশে? তাও আবার রাষ্ট্র দখলের শক্তি নিয়ে। দামি অস্ত্র, দামি গাড়ি, দামি সজ্জা- এত বিপুল টাকা এল কী করে তালিবানের হাতে? এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের অবদান। অতীতে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়ে দেশ ছাড়া আফগানদের সীমান্ত এলাকায় মাদ্রাসা ও গ্রামে আশ্রয় দিয়েছিল পাকিস্তান। সঙ্গে চলেছিল মৌলবাদী শিক্ষা ও অস্ত্রের ট্রেনিং। সেই প্রশিক্ষিত তালিবান জঙ্গিরাই আফগানিস্তানের দখল নিয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। ২০০১ সালে মার্কিন হানার পর তালিবানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় জঙ্গি ট্রেনিং। বরং, আফগান কিশোরদের তুলে এনে মগজধোলাইয়ের কাজ চলেছে পুরোদমে। তাদের শুধু আফগানিস্তানে নয়, টাকার বিনিময়ে আল-কায়দা, জৈশ-ই-মহম্মদের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ইরান সহ পশ্চিম এশিয়ার বহু যুদ্ধক্ষেত্রে। ন্যাটোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালে আফগান সীমান্তবর্তী একটি মাদ্রাসায় পাক সরকারের বার্ষিক অনুদান ছিল ৩০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ সালে এমন কয়েকটি মাদ্রাসার বার্ষিক বাজেট ছিল আকাশচুম্বী ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার! পাক মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তালিবান জঙ্গিরা আফগানিস্তানের বিভিন্ন দুর্গম প্রদেশে নিজেদের জায়গা তৈরি করছিল গত পাঁচ বছর ধরেই।
একে তো বিশ্বের প্রধান আফিম উৎপাদক দেশ আফগানিস্তান। ফলে, আফিমের জমি দখলে রাখতে পারলেই বিদেশি মুদ্রা নিশ্চিত। আর তা থেকে সস্তায় হেরোইন তৈরি করতে পারলে তো কথাই নেই। তালিবান সেই ব্যবসা থেকে বিরাট মুনাফা করেছে গত কয়েক বছরে। পাহাড়ি এলাকায় পরের পর ল্যাব বানিয়ে হেরোইন বেচেছে তালিবানরা। তার ফলেই, ২০১৬ সালে ফোর্বস'এর তালিকায় বিশ্বের পঞ্চম ধনী জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে নাম ওঠে তালিবানের। তখন তাদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪০ কোটি মার্কিন ডলার! মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, অপহরণ, হুমকিতে সিদ্ধহস্ত তালিবানের হাতে এমন মোটা অঙ্কের অর্থ তখনই ছিল, যখন আফগানিস্তানে তারা দ্বিতীয়বার সে অর্থে দাঁত ফোটাতেও পারেনি। ২০১৯ সালে তালিবানের সেই বার্ষিক লেনদেন বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার, মানে আগের চেয়ে প্রায় ৪০০ শতাংশ বেশি! কারণ, দেশের দুর্গম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংস্থা, মোবাইল পরিষেবা সংস্থাকে কাজ করতে হত তালিবানকে 'তোলা' দিয়েই। নইলে টাওয়ার উড়ে যাবে, খুঁটি উপড়ে যাবে। কিছুই করতে পারবে না পুতুল আফগান সরকার।
১৯৯৪-এর সেপ্টেম্বরে মাত্র ৫০ জন নিয়ে মোল্লা মহম্মদ ওমরের হাতে তৈরি জঙ্গি গোষ্ঠী তালিবান ২ বছরে লক্ষাধিক হয়ে আফগানিস্তানে ক্ষমতা কেড়ে মৌলবাদী শাসন চালু করেছিল ঠিকই, কিন্তু দেশের ৩৪টি প্রদেশের ৯০ শতাংশ জায়গায় নিজেদের ঝাণ্ডা ওড়াতে তাদের লেগে গিয়েছিল আরও দুটো বছর। অথচ এ বার এপ্রিলে আমেরিকা সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর কেটেছে মাত্র সাড়ে তিন মাস। তাতেই মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগান সেনা সম্পূর্ণ রূপে পর্যুদস্ত। টাকায় কিছুটা হয়, তাই বলে সবটা?
একক মাত্রা ম্যাগাজিনের ব্লগের স্টার খেলোয়াড় হলেন শোভনলাল চক্রবর্তী । তাঁর প্রতিটি লেখাই অনবদ্য, অসাধারণ ও রত্নখচিত । মুগ্ধ হয়ে ওনার প্রতিটি লেখাই পড়ি এবং শেয়ার করি । ♥️👑🙏🏼
ReplyDelete• কিন্তু আফগানিস্থানে বর্তমানে যা হচ্ছে তা জঘন্যতম বললেও কম বলা হয় । ধিক্কার । 👹👎🏿😡
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=22153
ReplyDeleteউপরের লিংকটায় শোভনলাল্বাবুর লেখাটির বিরোধীতা রইলো।
ReplyDelete