Thursday, 19 August 2021

তালিবান রাজ

স্বাধীনতা ও সন্ত্রাসের দোলাচলে আফগানিস্তান

সোমনাথ গুহ


আমেরিকা যে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় হস্তক্ষেপ করেছে সেখানেই নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাস এটাই বলে। গত শতাব্দীতে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, মাত্র কুড়ি বছর আগের ঘটনাবলী তাই প্রমাণ করে। 

৯/১১'র মর্মান্তিক ঘটনার পর ক্রোধে উন্মত্ত আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করল এবং ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর সঙ্গীদের খুঁজে বার করার জন্য পুরো দেশটাকেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে দিল। কাজের কাজ কিছুই হল না, লাদেন বা তৎকালীন তালিবান নেতা মোল্লা ওমর কারও টিকিটাও তারা খুঁজে পেল না। কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে, দেশবাসীকে তো দেখাতে হবে যে টুইন টাওয়ারের ওপর আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। অতএব, আফগানিস্তান থেকে সরে গিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে বলির পাঁঠা করা হল, যে সাদ্দাম লাদেন ও আল কায়েদা'র লাগাতার বিরোধিতা করে এসেছেন, ইরাকের মাটিতে তাঁদের কোনওদিনও স্থান দেননি। সাদ্দামের কাছে প্রচুর ডব্লিউএমডি (উইপন্স অফ মাস ডেস্ট্রাকশন) আছে- এই মিথ্যা অজুহাতে বিধ্বংসী আক্রমণে আমেরিকা দেশটাকে ছারখার করে দিল। ২০১১'এ যখন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করা হল এবং বেশির ভাগ মার্কিনি সৈন্য বাড়ি ফিরে গেল, দেখা গেল প্রাক্তন শাসক দল বাথ পার্টি ইসলামিক স্টেট বা দায়েশে রূপান্তরিত হয়ে সারা দেশে ছেয়ে গেছে, বাগদাদের দুর্বল সরকারের কোনও ক্ষমতা নেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার। একই গল্প লিবিয়া, সিরিয়াতে। লিবিয়াতে গদ্দাফির পতনের ফলে সেখানে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির বাড়বাড়ন্ত। সিরিয়ায় মরণপণ গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আশাদ কোণঠাসা, তবুও তিনি নাছোড়বান্দা; কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া সত্ত্বেও নিজের শাসন এখনও অটুট রেখেছেন। প্রতিটি দেশে যেখানে আমেরিকা এবং তার দোসর ন্যাটো হস্তক্ষেপ করেছে, সেগুলি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মৃগয়া ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে সন্ত্রাসবাদেরই আরও বৃদ্ধি হয়েছে। 

সন্ত্রাসবাদ নির্মাণ করার এই প্রক্রিয়া আফগানিস্তান থেকেই শুরু। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে ইঙ্গ-মার্কিন সেনা ঐ দেশে বম্বিং শুরু করে। ডিসেম্বর মাসে তালিবান সরকারের পতন ঘটে, লাদেন ও আল কায়দা পলায়ন করে। হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে একটা পেটোয়া সরকার তৈরি হয়। নতুন সংবিধান তৈরি হয়। জঙ্গিদের মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন দেশের একটা মিলিত বাহিনী মোতায়েন করা হয়। বিদেশি সেনাদের আদলে আফগান সেনাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়। ২০০৬-০৭ নাগাদ আমেরিকার শ্যেন দৃষ্টি ইরাকের ওপর নিবদ্ধ হয়, ঘোষণা করা হয় যে আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। আক্রমণের তীব্রতায় তালিবানরা এতদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, গুহা গহ্বরে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বের সর্বশক্তিমান দেশের অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভারের দাপটও তাদের কোনওদিনও সম্পূর্ণ নিকেশ করে দিতে পারেনি। মৌলবাদের শেকড় দেশটায় গভীর ও বিস্তৃত। শহরগুলো মার্কিনিদের সহায়তায় আফগান সেনাদের কব্জায় থাকলেও, বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল ও প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকাগুলোতে তালিবানরাই রাজ করেছে, আমেরিকান সেনাও সেখানে দাঁত ফোটাতে পারেনি। ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে যখন মার্কিনিদের দাপট, হিংস্রতা সবচেয়ে বেশি ছিল, সেই সময়েও গ্রামেগঞ্জে মেয়েদের গোপনে স্কুল করতে হয়েছে, তালিবানিদের নজরদারি তখনও ঐ সব অঞ্চলে ছিল এতটাই তীক্ষ্ণ ও প্রখর। 

ইরাক যুদ্ধের ফলে আমেরিকানদের দৃষ্টি সরে গেল যা তালিবানদের দম ফেলার সুযোগ করে দিল। তারা আবার সংঘবদ্ধ হতে শুরু করল। চোরাগোপ্তা আক্রমণ শুরু হল, সরকারি অফিস, সেনা দফতরকে নিশানা করা হল। আমেরিকা প্রমাদ গুণল। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা আরও ৩০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করল। আফগান সেনাদের দক্ষতা বাড়াতে তাদের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হল যাতে কিছু সময় বাদে তাদের হাতে দেশের নিরাপত্তা অর্পণ করা যেতে পারে। আট বছরের যুদ্ধে এই প্রথম সৈন্য অপসারণের কথা উল্লিখিত হল। জুলাই ২০১১'তে অপসারণের প্রথম পর্বের দিনক্ষণ ঠিক হল। দশ বছরের যুদ্ধে দেখা গেল ১৮০০ মার্কিন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন, ৪৪৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। কত হাজার আফগান মানুষ বা তালিবান যে মারা গেছেন তার হিসাব রাখার কেউ কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি। ২০১২'র জানুয়ারিতে তালিবান কাতারে তাদের একটা অফিস খোলার চুক্তি করল। এ থেকে বোঝা গেল যে দেশে একটা নির্বাচিত সরকার থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে তালিবানের সাহায্য ছাড়া আফগানিস্তান থেকে সম্মানজনক অপসারণ অসম্ভব। 

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর স্বভাবসুলভ বাগাড়ম্বর শুরু করলেন। বললেন, যুদ্ধ চলবে, সৈন্য তুলে নিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ দেওয়া বরদাস্ত করা হবে না। এই প্রথম একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণে ভারতের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিলেন এবং একই সাথে পাকিস্তানকে জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তুলোধোনা করলেন। ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন সৈন্য গ্রামীণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল, বিমান আক্রমণ তীব্র করা হল। তালিবানরা তৈরি ছিল। তারা প্রত্যাঘাত করল। কাবুলে সন্ত্রাসবাদী হানায় ১১৫ জন নিহত হলেন, সারা দেশ জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ল। ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর থমকে গেল, তিনি আলোচনার প্রস্তাব দিলেন। দু' পক্ষের দরাদরি শুরু হল যা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে কুড়ি বছরের দমনপীড়নের পরেও তালিবানদের সেভাবে শক্তিক্ষয় হয়নি। 

২০১৯'এর ফেব্রুয়ারি মাসে দোহাতে আমেরিকা ও তালিবানের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা হল। আমেরিকা সৈন্য সরিয়ে নেবে, তার পরিবর্তে তালিবানকে নিশ্চিত করতে হবে যে কোনও জঙ্গি সংগঠন আফগানিস্তানে ঘাঁটি গাড়বে না কিংবা সেখান থেকে আমেরিকাকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করবে না। মার্কিন দূত জালমাই খালিলযাদ বললেন যে তাঁরা চেষ্টা করবেন, তালিবান, আফগান সরকার এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে যেন সমঝোতামূলক কথাবার্তা হয়। তাঁরা যুদ্ধবিরতিরও চেষ্টা করবেন। ঠিক এক বছর বাদে খালিলযাদ এবং তালিবান দূত মোল্লা আবদুল গনি বারদার (যাঁর তালিবান শাসনে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে) দোহাতে শান্তি চুক্তি সই করলেন। চুক্তির মূল পয়েন্টগুলি হল: 

(১) তালিবান গ্যারান্টি দিল তাদের দেশকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না; 

(২) আমেরিকা ধাপে ধাপে সৈন্য সরিয়ে নেবে; 

(৩) পরের মাস থেকে আন্তঃ-আফগান আলোচনা শুরু হবে কিন্তু আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি প্রস্তাব দিলেন যে আলোচনায় বসার আগে তালিবানদের কিছু শর্ত মানতে হবে; 

(৪) আশ্চর্যজনক ভাবে চুক্তিতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার কোনও প্রস্তাব নেই। তাই চুক্তির পরেই আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ চলতে থাকল। সেপ্টেম্বর মাসে আন্তঃ-আফগান আলোচনা হল। সরকার প্রায় ৫০০০ তালিবান বন্দীদের মুক্তি দিল। সরকার যুদ্ধবিরতির আর্জি জানাল। তালিবান এর বিপরীতে ইসলামিক রীতিতে দেশ পরিচালনার ডাক দিল। 

২০২১'এর এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা করলেন যে আন্তঃ-আফগান আলোচনায় যদি কোনও সন্তোষজনক সমাধান নাও হয়, যদি তালিবান আফগান সেনা এবং নাগরিকদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তবুও ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমেরিকা সমস্ত সৈন্য সরিয়ে নেবে। 'আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ করার সময় হয়ে গেছে', তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন। এর চেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনও সিদ্ধান্ত হতে পারে! যুদ্ধ শুরু করেছিল আমেরিকা, যুদ্ধবিরতি যাতে হয় সেটার জন্য তারা কোনও চেষ্টাই করল না। একটা দেশকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়ে তারা স্রেফ পলায়ন করল। তালিবান এর সুযোগ নিল। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে বিদেশি সৈন্য সম্পূর্ণ অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনও আলোচনায় বসবে না। 

২০১২ থেকেই আমেরিকা বুঝে গিয়েছিল যে আফগানিস্তানের ভাগ্য তালিবানের হাতে, আফগান সরকারের জনভিত্তি দুর্বল। তাই তারা মৌলবাদী হলেও তালিবানদের গুরুত্ব দিয়েছে। তারা নিজেদের দেশ ও নাগরিকদের নিরাপত্তা ছাড়া কোনও কিছুকে পাত্তা দেয় না। তাই তাদের স্বার্থ এবং সুরক্ষা যাতে কোনও ভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেটা তারা তালিবানদের দিয়ে সাদা-কালোয় চুক্তিতে সই করিয়ে নিয়েছে। এরপর আফগানিস্তানে মানবাধিকার বা নারী স্বাধীনতা রক্ষা হল কি হল না, তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। নারী স্বাধীনতাকে বিশ্বের সর্বশক্তিমান দেশ কি কোনওদিনও অগ্রাধিকার দেয়? যদি দিত তাহলে সৌদি আরবে মহিলাদের শুধুমাত্র গাড়ি চালানোর অধিকার পাওয়ার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হত না। সেখানকার রাজ পরিবারের সঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদের তো ওঠাবসা, তার জন্য কি সৌদিদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা এতটুকুও প্রভাবিত করতে পেরেছে? তাদের এবং আফগান সিভিল সোসাইটি'র সরব উপস্থিতির কারণে শহরাঞ্চলে নারীরা গত কুড়ি বছর স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেয়েছে। এর বাইরে যে বিশাল প্রত্যন্ত অঞ্চল, সেখানে নারীরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই আছেন। মৌলবাদ, পুরুষতন্ত্রের দাপট সেখানে সীমাহীন। 

তালিবান কি এই কুড়ি বছরে পাল্টেছে? নব্বইয়ের দশকে তারা টিভি, সিনেমা, মেয়েদের স্কুল, কাজ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, এবারও নিশ্চিত তাই করবে। তারা কাবুল দখল করার পরই আতঙ্ক ছড়িয়েছে, মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন, মহিলাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, তাঁরা  ঘরবন্দী হয়ে গেছেন। তবে তাদের মেলামেশার গণ্ডি প্রসারিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে তাদের সরকারকে মাত্র তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। এবার চিন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান সহ কিছু দেশের স্বীকৃতি পাওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এটাই একমাত্র আশা। আন্তর্জাতিক চাপের ফলে যদি তাদের শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়, নারীদের শ্বাস নেবার একটা পরিসর তৈরি হয়। 


1 comment:

  1. 💓👌🏼
    বেশ ভালো লেখা । লেখা কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সেটা সোমনাথদার থেকে শেখা দরকার । আমেরিকার কোনদিনই মানুষের স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, যেকোনো দেশের উন্নতি, গণতন্ত্র এইসবে কোনদিনই মন ছিল না; থাকবেও না । তারা শুধুমাত্র নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে, বাড়াতেই আগ্রহী । আমেরিকা ভালো মানুষের একটা ভেক ধরে দিনের পর দিন অন্যায়, অসৎ কাজ করে চলেছে শুধুমাত্র পয়সা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে । আমার তো মনে হয়, পৃথিবীর সবথেকে সন্ত্রাসবাদী দেশ আমেরিকা নিজে । কিন্তু তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ভয়ে বাকি দেশগুলি এবং বিভিন্ন মানুষ মুখ বুঝে থাকে । 😡😷

    ReplyDelete