'...স্বর্গ খেলনা গড়িব-না ধরণীতে'
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
'নীড় ছোট, ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড় ....'
এই ব্লগে স্বাধীনতার ৭৫ বছর সম্পর্কিত লেখাটি পড়ে অনেকেই জানতে চেয়েছেন করণীয় কী? উত্তর একেবারেই জানা নেই এমন নয়। তা নিয়েই আমার আজকের এই কিছু কথা। অনেকেই একমত হবেন না জেনেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস রেখে বলি এবং পাঠকদের প্রতিক্রিয়াতেও যেন মতপ্রকাশের সেই স্বাধীনতাই অনুরণিত হয়, এই আমার প্রার্থনা।
সকলেই বোঝেন ও মানেন যে দেশ এগিয়েছে। একটা সেফটিপিনও তখন বিদেশ থেকে আসত। সেদিন গিয়াছে। তবে এও সত্য যে, দেশের মানুষের এগোনোর হার কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছয়নি। কাঙ্ক্ষিত মান বলতে বুঝি সসম্মানে বাঁচার অধিকার। সসম্মানে বাঁচতে হলে সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা ও যাবতীয় মানবাধিকার চাইই। সেই সঙ্গে অবশ্যই চাই জীবিবৈচিত্র আর পরিবেশের ভারসাম্য।
অধিকার চাইলে কে দেয়? কাকেই বা দেয়? সবার আগে প্রস্তুত হতে হবে অধিকার পেতে। কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হলেও চলবে না। কর্তব্যও করব, অধিকারও চাইব। কার কাছে চাইব? চাইব, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে নিশ্চয়। সমাজ নিশ্চয় তার সব দায়িত্ব রাষ্ট্রের পাতে তুলে দেয়নি। রাষ্ট্রও ভুলে থাকতে পারে না তার দায়িত্ব। সুশিক্ষার আয়োজন নিশ্চয় রাষ্ট্রের দায়। তার প্রতিশ্রুতিও তেমন। রাষ্ট্র এখন যে নীতির রূপায়ণ চাইছে তাও যদি সে কার্যকর করে! এতেও যে মন ভরে না, প্রশ্ন থাকে- এই আয়োজন কী সুশিক্ষা নিশ্চিত করবে? সুশিক্ষার লক্ষ্য যদি হয় সুনাগরিক তৈরি, তবে তো মানতেই হয় যে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় নীতিতে তা প্রতিফলিত নয়।
সকলের জন্য আরও চাকরি, আরও কর্মসংস্থান? তাও যে নিশ্চিত নয়। তবে, যদি চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে কর্তাদের পকেট ভারী হয়, পরের নির্বাচনে জয় নিশ্চিত হয় (আরও চাকরি, আরও কর্মসংস্থানের লোভ দেখাতে পারলে!) তবে তো সে পথে দৌড়তেই হয়। সকলের জন্য আরও কর্মসংস্থান সম্ভব করে তুলতে আমরা চাইছি দ্রুত হারে উন্নয়ন। চাইছি শিল্পোৎপাদন বাড়াতে। কেবল এ দেশ বলে নয়, প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশই সেই সব্বনেশে পথে। সে সমাধান আবার প্রকৃতির পছন্দ নয়। সুপরিবেশের দাবি মেনে যথেচ্ছ শিল্পোৎপাদন সম্ভব নয়। অন্তত এ দেশে এখন যা হচ্ছে। তাহলে বিকল্প কী? নেই নাকি?
দেশের বহু মানুষ হতাশ। তাঁরা ভাবেন যে, এ পোড়া দেশের অভাগা মানুষের কিছু হবে না। সে মানুষগুলো কেবল মার খাবে আর মরবে। করোনায় মরলে শ্মশানেও ঢুকতে দেবে না। অর্থাৎ, বাঁচলেও বিপদ, মরলেও। যেমনটা দেখেছিলেন শরৎচন্দ্র- বর্মা মুলুকে প্লেগ-কালে। সত্যিই কী তাই- বাঁচলেও বিপদ, মরলেও? ঘুরে দাঁড়ালে হয় না? যাবে না ঘুরে দাঁড়ানো? নিশ্চয় যাবে। যদি চাই। যদি চাই পরের প্রজন্মের জন্য বিকল্প পথে হাঁটতে তবে তার জন্য আমাদের বদলাতে হবে মানসিকতা।
ভূটানের দিকে তাকালে বুঝি সমাধান আছে। সে দেশ তো শিল্পোন্নত নয় আজও। পরিবেশ বাঁচিয়ে সমাধান পেতে সবার আগে প্রয়োজন শিল্পে যথেচ্ছ ও নিয়মিত উৎপাদন বাড়িয়ে জিডিপি বাড়ানোর ধারণাটি ত্যাগ করা। এর অর্থ এই নয় যে শিল্প স্থাপন করা যাবে না। নিশ্চয় যাবে, কিন্তু তা যথেচ্ছ বা অপরিকল্পিত হলে চলবে না। যেমন আশু লাভের কথা ভেবে আমরা বড় বড় নদীবাঁধ বা মাটির তলা থেকে জল তুলে নিতে পারি না। স্বামীনাথন এখন স্বীকার করছেন যে তাঁর 'সবুজ বিপ্লব'এর পরিকল্পনায় ভুল ছিল। ভুল স্বীকার করে তিনি ফের আমাদের আর এক সর্বনেশে পরিকল্পনার অংশীদার (দ্বিতীয় 'সবুজ বিপ্লব') করতে চাইছেন। আমরা যদি তা গ্রহণ না করি?
তবে আর জিডিপি দ্রুত হারে বাড়বে কেমন করে? মানতেই হবে যে, তা বাড়বে না তেমন দ্রুত হারে। মেনে নিতেই হবে যে, কেবল দ্রুত জিডিপি বাড়াটাই সুলক্ষণ নয়। আবারও বলি, এর মানে এই নয় যে উন্নয়ন চাই না। চাই, অবশ্যই চাই। পৃথিবীতে এমন দেশও তো আছে যারা কেবল সামুদ্রিক উদ্ভিদ বেচে উন্নতির শিখরে, কোনও কোনও দেশ ভ্রমণকে শিল্পে পরিণত করে দ্রুততালে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এ দেশের মতো এশীয় দেশবাসীর একাংশ 'লুক ইস্ট' নীতির অনুগামী কিছু মার্কিনী বেওসায়ীদের নজরে থাকায় (জিডিপির কলে পড়ে, সেই কল যাকে সুকুমার রায় বর্ণনা করেছেন 'খুড়োর কল' রূপে) এগোচ্ছে একালের বিচারে। তারা পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে জেনেও দূষণ-প্রধান গাড়ি বা রসায়ন শিল্পকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। ঠিক হচ্ছে টা কী?
পরের প্রজন্মকে চাকরির লোভ দেখালেও হবে তো উদ্দেশ্যসিদ্ধ? পরিবেশ-বিশেষজ্ঞরা যে বলছেন আর বড় জোর ৫০ বছর, তারপর আমরা পানীয় জল পাব না, গরমে সেদ্ধ হব, গ্লোবাল ওয়ার্মিং পৃথিবীর স্থলভাগ কেড়ে নেবে। স্পষ্ট উচ্চারণের সময় এসেছে, সময় এসেছে এই কথা বলার যে, এমন আত্মঘাতী উন্নয়ন চাই না, তার চেয়ে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় পেয়েই তুষ্ট থাকব।
এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছতে চাই যেখানে সুশিক্ষা যা সমাজকে নিছক কিছু হাত-পা বিশিষ্ট মানুষ দেবে না, দেবে সুনাগরিক। যে নাগরিক চর্চা করবে এমন এক সমাজের ও এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার যেখানে ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে ভাগ হওয়ার সুযোগই থাকবে না, নিশ্চিত হবে মানুষের মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার। নিশ্চিত হবে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, আহার্য, শিক্ষার অধিকার। সুশিক্ষিত হলে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা চাইব যেখানে একবার ভুল করে বা কোনওভাবে কোনও অত্যাচারী স্বৈরাচারীকে যদি ডেকে আনা হয়ও তাকে কুলোর বাতাসে বিদায় দিতে পারব।
এই সব স্বপ্ন সার্থক হতে পারে যে আবহে, যে সংস্কৃতিতে তা আমাদের আছে। যে কাঠামোতে এমন সব স্বপ্ন সার্থক হতে পারে তাও আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আছে। তাই স্বপ্নগুলি দিবাস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেবার নয়। পৃথিবীকে পথ দেখানোর পথে আমরা এগিয়ে চলি, আসুন।
হৃদয় ছুঁয়ে গেল। লেখককে প্রণাম
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল! তবে আশু কর্তব্য, মনে হয়, মূল্যবোধের লড়াই! সুস্থ চেতনার জন্য!!!
ReplyDeleteকিন্তু চাকরি না হলে জনগণ খাবে কি? বিশেষ করে শহরের লোকজন। বেকার ভাতা ইত্যাদি ভিক্ষা জীবি হওয়া ছাড়া কি উপায় নেই? বেকারের অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যুব সমাজের পরিবেশের ভালো মন্দে কিচ্ছু এসে যায় না। তাদের তো society reject করে দিয়েছে, অপ্রয়োজনীয় বোঝা বলে দাগিয়ে দিয়েছে। পঞ্চাশ বছর পরে শ্বাস নেওয়া যাবে কিনা এটা আজকের বেকার যুব সম্প্রদায় ভাবিত হবে, ত্যাগ স্বীকার করে নেবে এটা আশা করা উচিত নয়। তাদের তো জীবনটাই living hell হয়ে আছে।
ReplyDelete