Friday, 9 July 2021

সংকটে সংবাদপত্র

খবরের কাগজের দিন কি শেষ?

নিলয় সামন্ত


অতি সম্প্রতি সকাল থেকে মোটামুটি দুপুর পর্যন্ত এক ধরনের ফেরিওয়ালার ডাক খুব শুনতে পাওয়া যায়। এই ধরনের ফেরিওয়ালারা জিনিস বিক্রি করেন না। এরা বাতিল জিনিস কেনন। আর সেই জিনিসগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান হল খবরের কাগজ। কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে লকডাউন পরিস্থিতিতে সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কয়েক মাস আগেও পুরনো খবরের কাগজের কিলো প্রতি দর ছিল ৯-১০ টাকা। এখন হয়েছে ১২-১৫ টাকা। কারণ, খবরের কাগজের আকাল। আর, তার ফলে মাথায় হাত ঠোঙা বানিয়েদের। 

কেন এই রকম হল? প্রথমত, গত বছর খবরের কাগজবাহী করোনা ভাইরাস বাড়িতে আসবে এই আশঙ্কায় অনেকেই খবরের কাগজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিকল্প হিসেবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন খবরের কাগজগুলোর ই-এডিশনে। কিন্তু বহু দিনের অভ্যেস বদলাতে অনেকেরই বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ্ব মানুষজনের। হাতে খবরের কাগজ নিয়ে পড়াটা তাঁরা ই-এডিশনে পাচ্ছিলেন না। তাই, গত পুজো থেকে যখন পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হল, তখনও কিন্তু খবরের কাগজের বিক্রি লকডাউনোত্তর সময়ের তুলনায় কিছুটা বেড়েছিল। 

দ্বিতীয়ত, সংবাদ মাধ্যমের যাবতীয় গুরুত্ব বোদ্ধা মানুষের কাছে কিন্তু কমতে শুরু করল গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা মানুষ করতে থাকল এই সময়। তাতে সাধারণের প্রতিক্রিয়া হল- বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ সমর্থন করে সংবাদ পরিবেশন করে। ফলে, প্রথমেই কোপ পড়ল সংবাদপত্রের উপর। তার কারণ, সংবাদপত্র মুল্য দিয়ে কিনতে হয়। তাই, ইচ্ছে থাকলেও এই বেরোজগারির সময় সেটা কেউ করতে চাইল না। আর বিকল্প হিসেবে মোবাইল ফোনেই বিভিন্ন বড় বড় সংবাদপত্রের ই-এডিশন দেখে নেওয়া যায়। 

এ তো গেল সংবাদপত্র পাঠকদের বিকল্প বেছে নেওয়ার কারণ। আর একটা কারণ, বাজারে, চায়ের আড্ডায়, রেল স্টেশনে, দূরপাল্লার বাস স্ট্যান্ডে যে সংখ্যায় কাগজ বিক্রি হত সেটা একেবারেই প্রায় বন্ধ হয়ে গেল এই বছরের লকডাউনের সময়। সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে শুরু করেছে ছোট ছোট ব্যবসার বিজ্ঞাপন, বিনোদনের বিজ্ঞাপন। এখন শুধু পুঁজিপতিদের অনলাইন বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কোনও বিজ্ঞাপনই প্রায় দেখা যাচ্ছে না খবরের কাগজে। ফলে, আয় কমায় চাকরি যাচ্ছে সাংবাদিকদের। বৈচিত্র্য হারাচ্ছে সংবাদ পরিবেশনে। 

পরিস্থিতি কীরকম একবার দেখে নেওয়া যাক অভিজ্ঞ সাংবাদিক অশোক সেনগুপ্তর ফেসবুক পোস্ট থেকে। সেখানে তিনি বিশিষ্ট গণমাধ্যম কর্মীদের উক্তি পরিবেশন করেছেন। যেমন, সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্কোচন নিয়ে অ্যান্টো টি জোসেফ লিখেছেন, 'India’s fourth estate is staring at imminent danger. Several newspapers across the country are gasping for breath. Shrinking readership and ad revenues, rising costs, waning credibility, and an onslaught of digital and social media have taken a huge toll on their financial health. Recently, published data collected by the Indian Readership Survey shows that their future is pretty bleak.' (Is Newspaper Dying, Newslaundry, 3 February 2020)। 

অথচ আনন্দবাজার পত্রিকা ক’ বছর আগে যখন অনলাইন সংস্করণ বার করে, সাধারণ পাঠক তো দূরের কথা, অনেক মূল ধারার সাংবাদিকরাও ভাবতে  পারেননি ওই অনলাইন ধারা অচিরে এভাবে পুষ্ট হয়ে উঠবে। প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, এটাই হবে ভবিষ্যৎ। 

এই অবস্থার কারণ কী? এক প্রাক্তন উপাচার্যর কথায়, 'একটা বড় কারণ, ফোর্থ এস্টেটের ওপর সেই বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। সত্য খবরের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে কুন্ঠা করেননি জেমস লঙ কিংবা হরিশ মুখার্জিরা। ওয়াটার গেট স্ক্যান্ডাল-এর সময় আমি আমেরিকায়। কাগজের খবর নিয়ে সে কী উন্মাদনা! তারপর প্রায় পাঁচ দশক কাটতে চলল। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দু' দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদে ছিলেন বিল ক্লিনটন। হোয়াইট হাউসের ইতিহাসে কলঙ্কিত একটি অধ্যায় তাঁর ও মনিকা লিউয়েনস্কির গোপন অভিসার। হোয়াইট হাউসে ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দেওয়া মনিকার সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সে খবরের জন্যও কাগজ বিক্রি হয়েছে হু হু করে। কারণ, বিষয় যাই হোক, প্রকাশিত খবর লোকে বিশ্বাস করতেন। এখন আর করেন না।'

একটি নামী সংস্থায় সংবাদপত্র সার্কুলেশনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আর্যকমল মিত্র'র মতে, খবরের কাগজের এই সঙ্কটের মূল কারণ করোনা। গোড়াতেই কাগজ থেকে সংক্রমণের আশঙ্কায় কেনাবেচা সঙ্কুচিত হয়ে গেল। ট্রেন-বিমান বন্ধে আরও ধাক্কা খেল বিপণন। একটি নামী বাংলা দৈনিকের সার্কুলেশন ২০১১ থেকে ২০১৪'এ দৈনিক ১৩ লক্ষ হয়েছিল। রবিবার তা হত প্রায় ১৬ লক্ষ। এর পর কিছুটা কমে। কিন্তু গত বছর করোনার পর তা প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। তার ওপর কাগজে বিজ্ঞাপন নেই। জলের দরে বিজ্ঞাপন টানার চেষ্টা করতে লাগল কর্তৃপক্ষ। তাতেও সুফল মিলল না। কারণ, করোনার দাপটে বিজ্ঞাপনদাতারাও সঙ্কটে। নানা স্তরের বিভিন্ন কর্মীদের কাজ চলে যেতে থাকল। একই ছবি অন্যান্য সংবাদপত্রেও। 

অডিট ব্যুরো সার্কুলেশনের তথ্য (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৯)

যদিও সেভন্তি নিনন লিখেছেন সংকটটা শুরু হয়েছে আরও আগে থেকে। তাঁর কথায়, 'The India-Ratings analysis of revenue growth in print showed that print media growth halved between FY15 and FY19 from 8% to 4% and turned negative (estimated) in FY20, though the lockdown came only in the last week of FY20. In FY20, according to the same analysis, key listed print media players— Jagran Prakashan Ltd (publisher of Dainik Jagran), DB Corp Ltd, (Dainik Bhaskar), Hindustan Media Ventures Ltd (Hindustan) and HT Media Limited (Hindustan Times)— showed declines in advertisement, circulation and overall revenue, with a negative growth in total income that increased steadily to -19% from -3% over four quarters. (Three of the four quarters were pre-Covid-19).'

ছয় দশকের ওপর সাংবাদিকতা করেছেন মিহির গঙ্গোপাধ্যায়। এখন বয়স ৮২। কাজের সুবাদে এবং নেশার টানে সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়তেন। তাঁর কথায়, 'এখন দুটো কাগজ রাখি। পুরনো অভ্যেস মতো একটু প্রথম আর শেষ পৃষ্ঠা ওল্টাই। বাড়িতে কন্যা আর ক্লাশ ইলেভেনে পড়া মেয়ে। ওরা তো কাগজ ছোঁয়ই না।' মিহিরবাবু বলছিলেন, ভোরের কলকাতায় কাগজ বার হয়েছে এমন সময়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আসতেন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ। তাঁর চোখে সমস্যা ছিল। তাঁর এক সঙ্গী তাঁকে কাগজ পড়ে শোনাতেন। ডায়মন্ডহারবারের সিপিএম সাংসদ জ্যোতির্ময় বসু গোটা সাতেক কাগজ রাখতেন। তিনি দু’ জন রিসার্চ স্কলার রেখেছিলেন যাঁরা ঠিক করে দিতেন কোন খবরের ওপর সংসদে কী আলোচনা করতে হবে। 

লক ডাউনোত্তর সময়ের বিষয়ে সেভন্তি নিনন লিখেছেন, 'India’s newspapers are unlikely to regain their numbers anytime soon, if ever. Of readers lost to online editions, many will not return to print. It is also doubtful if print will gain new readers since the millennials are getting their news and information online.' (‘The India Forum, 15 Jan 2021)। একই সুর আর্যকমল মিত্র'র। তাঁর মতে, 'সেই সম্ভাবনা খুব কম। কারণ, খবরের কাগজের নতুন পাঠক তৈরি হচ্ছে না। পুরনো পাঠকরা অনেকেই অনলাইন বা বৈদ্যুতিক সংস্করণে নিজেদের মানিয়ে বা অভ্যস্ত করে নিয়েছেন। কাজ হারিয়ে বা বেতন কমে যাওয়ায় অনেকে আর্থিক চাপে আছেন। মনে হয় না তাঁরা কাগজ কিনবেন। আর একটা বড় সংখ্যক পাঠক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ পরিবেশনের জন্য বিরক্ত হয়ে কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ।'

অ্যান্টো টি জোসেফ লিখেছেন, 'Consider this. The country’s most widely circulated newspaper, Dainik Jagran, had an average issue readership of 1.75 crore in the third quarter of 2019, a drop of 3.6 percent from the second quarter and 13.6 percent from the first. Average issue readership is the number of readers who have read the newspaper the previous day, while total readership is the number of those who have read it at least once in the previous 30 days.

'It is a similar story with other newspapers. According to the IRS data, Hindustan’s average issue readership fell 21 percent over the first two quarters of last year to 1.46 crore, Amar Ujala’s dropped by 4.8 percent in the same period, Malayala Manorama’s by eight percent, Rajasthan Patrika’s by 10 percent, and Eenadu’s 21 percent.

'In spite of the steep decline in its readership, however, Dainik Jagran remains India’s most widely read daily while Malayala Manorama is the most widely read regional daily with an average issue readership of 89.81 lakh.' (Is Newspaper Dying, Newslaundry, 3 February 2020)। 

করোনা-পূর্ব সময়ে খবরের কাগজের বিক্রি কতটা ছিল তার একটা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে অডিট ব্যুরো অফ সার্কুলেশনের শেষ রিপোর্ট থেকে। কিন্তু বর্তমানে এই প্রচার সংখ্যাগুলোই প্রায় দশ গুন করে কমে গিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখন অধিকাংশ ছোট পত্রিকাই তাদের মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ রেখেছে। আর বাণিজ্যিক খবরের কাগজগুলোর মুদ্রণ সংস্করণ ছোট পত্রিকার মুদ্রণ সংস্করণের সমান হয়ে গিয়েছে। সন্দেহ নেই, সমীক্ষার সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশিত হলে আরও কত গভীর ভাঁজ পড়বে এই শিল্পের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের কপালে!


6 comments:

  1. এখন এক করোনার কারণ দ্বিতীয়ত দলদাস সাংবাদিকতার নির্লজ নগ্ন চেহারা দেখেও পাঠক বীতশ্রদ্ধ এটা মানতে হবে সংবাদপত্র বিক্রি কমার কারণ। পয়সা দিয়ে পাঠক সংবাদ পড়তে চায়,কে কার বউ নিয়ে চলে গেল এমন নিম্নরুচির কেচ্ছা দিন কেন পড়বে পাঠক তাই এই হাল বলা যায়।

    ReplyDelete
  2. এটা হওয়ারই ছিল। টিভির নিউজ চ্যানেল গুলোর ও এই দশা হতে চলেছে। আগে প্রাইম টাইম বিতর্কের একটা মান ছিল, আজ সেটা একেবারেই নেমে গেছে। এত বড় কৃষক আন্দোলনের কোন খবরই পুঁজিবাদী মিডিয়া দেখায় নি। ফলে যুক্তিবাদী মানুষ ক্রমশই web magazine, twitter বা facebook page গুলোকে বেছে নিচ্ছে।

    ReplyDelete
  3. করেনা, রাজনীতি বা কোনো ভুল সংবাদ প্রকাশ হওয়া এর জন্যে তেমন দায়ী নয়। এর জন্যে প্ৰথম ও শেষ দায়ী ফেসবুক ও প্রথম থেকেই সস্তার ইন্টারনেট পরিষেবা। আর দুই দিন বাদে সংবাদ এর প্রথম সারির চ্যানেলেরও একই অবস্থা হবে। এর কারণ এখন সময় কাটানোর অনেক অপশন চলে এসেছে। আগে যেখানে কোনো সংবাদ পড়ে বা দেখে কোনো সমলোচনা করতে হলে পাড়ার চায়ের দোকান বা সেলুন ছিল এখন সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মানুষের সাথে বিতর্ক, যুক্তি আলোচনা করা যায়। এইভাবেই এখন যুগের হাওয়ায় তাল মিলিয়ে না চললে এগুলো বন্ধ হতে বাধ্য। কয়েকদিন পর সিনেমা হলেরও একই অবস্থা হবে কারণ OTT প্লাটফর্ম এসে গেছে। " করলো দুনিয়া মুঠঠি মে" - সত্যিই আজ পুরো দুনিয়া স্মার্টফোনে কেন্দ্রিভূত।

    ReplyDelete
  4. আপনার পুরো প্রতিবেদনটি খুব যুক্তিগ্রাহ্য এবং সর্বৈব সত্য। আজ আর নতুন করে নিউজ পেপারের পাঠক বাড়ানো খুবই কঠিন। অনেক কারণ আপনি বলেছেন তবে সবথেকে বড় কারণ সবার হাতে স্মার্টফোন এক ক্লিকেই (এখন তো আবার মুখে বললেই হয়) বাজিমাত।

    ReplyDelete
  5. Khub e guruttopurno samasamoyek prasanga.

    ReplyDelete
  6. দারুন সুন্দর প্রতিবেদন

    ReplyDelete