'পুরানো সেই দিনের কথা'
অনুপম চক্রবর্তী
তখন আমার বয়স বছর সাত-আটেক। হলঘরের জানলার তাকে দাঁড়িয়ে ধনুক হাতে হাঁপাচ্ছি। দু' পা দূরে ছোড়দি দণ্ডায়মান। দাঁত কিড়মিড় করছে আর 'মর মর' ধ্বনিতে আমার জীবৎকালের দফারফা করে ছাড়ছে। ছোড়দি আমার থেকে বছর চারেকের বড় হলেও ঐ ছিল শৈশবের সব থেকে কাছের জন। আমার আয়ু নিয়ে ওর এই ছিনিমিনি খেলার পরিসর একান্তই আমার নিজের তৈরি।
ছোটবেলায় আমরা একই স্কুলে পড়তাম। হাঁটা পথের বিভাবতী স্কুল। ওর ছুটি হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে আমার ছুটি হত। সদর দরজার লাগোয়া বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম ওর ফেরার অপেক্ষায়। ছোড়দির রঙ-বেরঙের বাহারি জামার প্রতি আমার একটা আলগা আকর্ষণ ছিল। মাঝে মধ্যে ওর অগোচরে সেগুলো পরে বাড়ির মধ্যেই এদিক ওদিক পাক খেয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিতাম। সেদিন একটু বাড়াবাড়ি রকম সেজে ফেলেছিলাম। ওর একেবারে নতুন কমলা ফুলছাপ ফ্রক, হাল্কা গোলাপি কাঁচের পুঁথির মালা আর চিকমিকি ওড়না মাথায় নিজেকে অমন ফুলকুমারী না বানালেও পারতাম। আর কী যে হল, ঐসব ধরাচুড়ো পরেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। স্কুল ফেরতা বাড়ি ঢোকার রাস্তা থেকে আমাকে নজর করেই ছোড়দি ওর হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। দরজা টপকে একশো মিটারের স্প্রিন্ট টেনে আমাকে প্রায় ধরে ফেলছিল। সঙ্গে ধনুক না থাকলে আর এক লাফে জানলার তাকে উঠতে না পারলে, টান মেরে সব খুলে নাগা সন্ন্যাসী করে ছাড়ত। এই খ্যাপানোর খেলা প্রায় রোজকার ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ওর 'মর মর' ধ্বনি রাস্তা থেকেই শোনা যেত। আমার সঙ্গে প্রতিবেশীরাও এই অভিসম্পাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে পুঁটিদের বাড়ি। প্রতি বছর রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ওদের লম্বা উঠোনের শেষ প্রান্তে সিমেন্টের বেদিতে গান, নাচ, নাটক, ছড়া, কবিতা পাঠের আয়োজন হত। রবি ঠাকুরের রচনার সঙ্গে আরও অন্যান্য লেখক লেখিকার রচনাও আমরা মঞ্চস্থ করতাম। একটা গানের প্রথম দু' কলি ও তার নাচের চলন আজও মনে গেঁথে আছে। 'পাহাড়ি দেশের বন্ধু স্বপ্নে আমায় ডাকে/ তার মাথায় রঙিন পাখীর পালক, কাঁধে বর্শা ধনুক'। দুপুরে হলঘরে ছোড়দি আর আমি এই গানটা গাইতে গাইতে নাচের মহড়া দিতাম। সেদিন সকাল থেকেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বেলা শেষের আলো জানলা ছুঁয়ে মেঝেতে গ্রিলের আবছা ছবি এঁকেছে। দেওয়ালের সব কটা হুকে শাড়ির খুট বাঁধা। বনবন করে পাখা ঘুরছে। সারি সারি শাড়ি ঝুলছে, হাওয়ায় দুলছে, ঢেউ খেলছে। মঞ্চে যেমন পর্দা ওঠানামা করে, সরে সরে যায়, দোল খাওয়া শাড়ির মেলায় হলঘর যেন রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে। তারই মাঝে আমরা ধনুক কাঁধে নেচে চলেছি। ঘুরেঘুরে, দুলেদুলে। কখনও পাশাপাশি, কখনও পর্দার এপারে ওপারে। মায়াবী আলোয় ঘরময় ছায়ানৃত্য হয়ে চলেছে।
ছুটির দিন দুপুরে ভরপেট খেয়েও ঘণ্টা দুই কাটতে না কাটতেই আবার খিদে পেয়ে যেত। খাটে জলচৌকিতে বই বইয়ের মতো খোলা। পেটে দুষ্টু খিদে মোচড় মারছে। একদিকে মা ঘুমচ্ছে। পাশের ঘরে বাবা নাক ডাকছে। কাকা-কাকিমারা ভাতঘুমে আচ্ছন্ন। দাদা-দিদিরাও যে যার ঘরে। জানলা দিয়ে দেখছি ঠাম্মা উঠোনে টুকটুক করে নানা কাজ একে একে সেরে ফেলছে। বড়ি দেওয়া থালা রোদের গতি আঁচ করে এদিক ওদিক করল। নারকেল ছোবা বঁটি দিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটল। তুলসি মঞ্চ পরিষ্কার করে ঝুড়ি হাতে জবা গাছের পাশে পিঁড়ি পেতে বসল। দুব্বো তুলবে বোধহয়। চোখ বুজে আসছে। মা-র গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লাম। স্বপ্নে পাড়ি দেব দেব, কে যেন কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
- নাড়ু খাবি?
চোখ মেলে দেখি শিয়রে ছোড়দি। ওর টানা দুই বড় ঝকঝকে চোখ খুশিতে নাচছে।
দুপুর তিনটে, সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। নাড়ু চুরি করতে আমরা ঠাকুরঘরে সেঁধিয়েছি। ঠাকুরের আসনের মুখোমুখি দেওয়ালে শান বাঁধানো তাক। একেবারে উপরের তাকে দেওয়াল ঘেঁষে গত বছরের সরস্বতী মূর্তি রাখা। চেয়ারে দাঁড়িয়ে মূর্তির পাশে রাখা টিনের কৌটোগুলো সরাতেই দেখি বোতল ঠাসা গুড়ের নারকেল নাড়ু, তিলের তক্তি, তিলের নাড়ু। কদমা, সাদা বাতাসা, নকুলদানা তো আছেই। নারকেল নাড়ু কপাকপ মুখে পুরছি। প্যান্টের পকেট ফুলে ঢোল। একটা তক্তি মুখে দিয়েই টের পেলাম এ লৌহসম, একে কব্জা করা দাঁতের কাজ নয়। ছোড়দি নীচে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
- কিরে, আমার নাড়ু?
যত বলছি নেমে দিচ্ছি, মানতে চায় না। অগত্যা আধচাটা তক্তিটাই দিয়েছি ওর হাতে ধরিয়ে।
- এটা কী হল? এক টানে আমাকে চেয়ার থেকে নামিয়ে সবে ও উঠেছে, মা-র গলা শুনতে পেলাম।
- অপু, কতবার বলেছি বই খুলে রাখতে নেই, সরস্বতী ঠাকুর পালিয়ে যায়। আমি হাত দিয়ে প্যান্টের দুই পকেট চেপে এক ছুটে বাথরুমে। ছোড়দিও আমার সঙ্গে। ওর এক হাতে তিলের, অন্য হাতে নারকেল নাড়ুর বোতল।
ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর সময় দাদাভাইয়ের হাত ধরে আমরা বাকী ভাইবোনেরা একসঙ্গে
ঠাকুর দেখতে বেরতাম। নবমীর দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে পাড়ার পিকনিক পার্কের ঠাকুর
দেখে, একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাব হয়ে পার্ক সার্কাস ময়দানের পুজোমণ্ডপে যাব। সেখানে
বিশাল মেলা বসে। ঠাকুর দেখার থেকেও আমাদের সবার আকর্ষণ ছিল ঐ মেলা। কথা হয়েছে
মেলায় পৌঁছেই প্রথমে আমরা ভেলপুরি খাব, তারপর বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটাব, ম্যাজিক
দেখব, নাগরদোলায় চড়ব এবং শেষে আইসক্রিম। তারপর হজমি লজেন্স কিনে বাড়ি ফেরা। আইসক্রিম খেয়ে সবাই কেমন গা ছেড়ে দিয়েছি। কম তো হাঁটিনি!
বাড়ি থেকে বেরনো ইস্তক কেবল হেঁটেই চলেছি। দোকান ঘেরা মাঠের মাঝের ঘাসজমিতে চোখের
নাগালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে সবাই জিরোচ্ছি। কিন্তু ছোড়দিকে দেখছি না তো! গেল কোথায়? আমাদের মধ্যেই
কে একজন বলল, হজমি লজেন্সের দোকানে যাই চল। আইসক্রিম খেয়ে তো আমাদের ওখানেই
যাওয়ার কথা। না, ওখানেও নেই। এখন কী উপায়? হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল দুটো দোকান পরেই
একটা মনিহারির দোকানে। ঐ তো ছোড়দি। দুই হাত ভরা নানা রঙের কাঁচের চুড়ি। আপন মনে হাত দুটো ঘোরাচ্ছে, আলো পড়ে রামধনু খেলে
যাচ্ছে ওর সারা গায়ে মুখে।
আজ বিজয়া দশমী। সারা সন্ধ্যে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বিজয়ার প্রণাম সেরেছি। পুজোর ক'দিন এলোমেলো খাওয়া আর ঘোরাঘুরিতে আজ শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। বালিগঞ্জ ষ্টেশন থেকে শেষ ডাউন ট্রেনের হুইসেল ক্রমে হাওয়ায় মিশে গেল। শাঁ শাঁ করে ট্রেন ছুটছে। ক্ষেত, খানাখন্দ, ঝোপঝাড়ে থেকে থেকেই জোনাকিরা আলোর চাদর মেলে ধরছে। সহস্র কোটি নক্ষত্র মর্ত্যে নেমে এসেছে যেন। মহামায়া আজ ঘরে ফিরছেন তারার আলোর পথ ধরে। আমিও চলেছি সেই পথে, ভেসে ভেসে, কখনও মেঘের পিঠে চড়ে। কানে এল ঠাম্মার গলা, ছোড়দিকে জিগ্যেস করছে,
- ও পদ্ম, সব নাড়ু খাইয়া থুইছো?
তাজ্জব ব্যাপার, ঠাম্মা জানলো কী করে যে ছোড়দিই নাড়ুর বোতল হাতিয়েছে? মা যেন ডাকছে,
- ও পদ্মা, চারটে তো বাজে, চা বসাবি না?
ঘড়ি ধরে ঠিক চারটে বাজলেই ছোড়দি রান্নাঘরে চা-এর জল চাপিয়ে দেয়। সে যে ঋতুই হোক, এই নিয়মের অন্যথা হয় না।
- এই ছোড়দি, কোথায় গেলি তুই, চা করবি না?
- এই তো আমি।
ফুল ছাপ ফ্রক ও ওড়না মাথায়, হাত ভরা চুড়ি আর ঘুঙুর পায়ে মেঘপরীর দেশে নাচ করছে আমার ছোড়দি।
স্মৃতিমেদুরতা..!
ReplyDeleteধন্যবাদ 🙏🏽
Deleteঅপু এ,কি করলি তুই -- লেখা পড়ে এগোতে পারছিনা তার মধ্যেই ছোটোবেলার সব কথা আবার নতুন করে মনে আসছে , কতো কথাই না ভুলে গেছিলাম তুই এক ঝটকায় সব ওলটপালট করে দিলি ।
Deleteধন্যবাদ 😊
DeleteChhoto chhoto chhabir maalaa gnethhe shudhu chotdi'r charitra noy ektaa shomoy'k khhub munshianaar shange dharaa hoechhe. Upobhogyataar madhhye besh ektu mon kemon karaa meshaano.
ReplyDeleteধন্যবাদ ইন্দ্রদা 🙏🏽
Deleteসব চেনা মানুষদের নিয়ে ফেলে আসা ছেলেবেলার গল্প। পদ্ম বড়ো ভালো মেয়ে। স্মৃতি সততই সুখের। ভালো লিখেছিস অপু।
ReplyDeleteধন্যবাদ পরাগ 😊
Deleteবড্ড ভালো।নারকেল নাড়ুর স্বাদ লেখার আনাচে কানাচে। আর হাত ঘোরালে নাড়ু শুধু নয় কাঁচের চুড়িও রইলো। সেই যেমন আমরা ক্যালাইডোস্কোপ দেখতাম তেমন--ধূসর আকাশে রামধনু।
ReplyDeleteছোটবেলাটাই ভালো ছিল যেন 😊
Deleteদারুন লিখেছো। আমার নিজের ছেলেবেলা মনে পড়ে গেল। আমার মফস্বলে বড় হয়ে ওঠা ।একান্নবর্তী পরিবার ।দিদিদের সংসর্গ। লেখাটা পড়তে পড়তে যেন এক লহমায় ছেলেবেলায় ফিরে গেলাম।
ReplyDeleteস্মৃতি সততই সুখের 😊
ReplyDeleteকি অসম্ভব ভালো অনুপম দা। এত কিছু মনে আছে? এত ডিটেল? ছোড়দি এখন কোথায় থাকেন?
ReplyDeleteধন্যবাদ অমৃতা।
ReplyDeleteছোড়দি বেশ কয়েক বছর আগেই চলে গেছে না ফেরার দেশে।
শৈশবের কোলাজ-ছবি....জলছবি তে ছোড়দি র অবয়ব...চির মধুর!...easily relatable..
ReplyDeleteধন্যবাদ দেবাশীষ বাবু 🙏🏽
ReplyDeleteআমার কলোনিতে ঘর । হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু খুঁজে পেলাম । আরো লিখুন অনুপমদা ।
ReplyDeleteবিশ্ব
Deleteধন্যবাদ বিশ্ব 😊
Deleteযে স্মৃতিলেখা সামাজিক ইতিহাসের উপাদান।
ReplyDeleteBoro choto hoe gelo.. Arektu boro hole aro portam.. Darun dada..
ReplyDeleteধন্যবাদ 😊
ReplyDeleteSmritir jol-chhobi....
ReplyDeleteধন্যবাদ 😊
Deleteখুব ভালো লাগল। সুন্দর স্মৃতিচারণ।
ReplyDeleteধন্যবাদ 😊
Deletesmriti romanthan ke uske dilo ei chhotto galpota.
ReplyDeleteDhanyobad Kalyan babu 😊
DeleteMama golpo ta kamon laglo seta sotti bolte perbona tar karon ai golpota somporke bolar Moto Amar Kono vasa ney...
ReplyDeleteSabdhane thakis 💗
ReplyDelete