চিকিৎসার এ কূল সে কূল
সঞ্জয় মজুমদার
সেই কোন হবকালে হগ সাহেবের মার্কেট থেকে ট্রামে চড়ে বছর চল্লিশের শ্যামবর্ণ, বেঁটে, গোলগাল চেহারার নন্দবাবু বাড়ি ফিরছিলেন। বিডন স্ট্রিট ছাড়িয়ে বাড়ির মুখে এসে বন্ধু বঙ্কুকে দেখে বেকায়দায় নামতে গিয়ে ধুতির কোঁচায় পা বেঁধে নিচে পড়ে যান। চোট একেবারেই পাননি নন্দ। তারপর? বাকি কাহিনির সরস বর্ণনা আছে পরশুরামের (রাজশেখর বসু) গড্ডলিকা সিরিজের (১৯২২) 'চিকিৎসা সঙ্কট'-এ। বাপের এক ছেলে নন্দবাবুর পৈতৃক সম্পত্তি এবং পয়সার অভাব ছিল না। কাজেই বন্ধুদের পরামর্শে চিকিৎসার কোনও ত্রুটি তিনি রাখেননি। এই সরস কাহিনি প্রকাশিত হওয়ার প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর পর ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়। নন্দ'র চিকিৎসা সঙ্কট বিপুলানন্দে (ডাক্তার মিস বিপুলা মল্লিক) মধুরেণ সমাপয়েত হলেও অধুনা ১৩৮ কোটি দেশবাসীর চিকিৎসা সঙ্কট গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
এই সঙ্কটের কারণ বিশ্লেষণ বা উৎস সন্ধান করার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। সচেতন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। ঠিকঠাক সার্চ প্যারামিটার দিলেই ইন্টারনেটে যে কোনও সঙ্কটের ভুরিভুরি কারণ এবং তার চুলচেরা বিশ্লেষণ বেরিয়ে আসে। সে সবের বঙ্গানুবাদ করার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। সেই চর্বিত চর্বণ। সরকারি ব্যর্থতার খতিয়ান। রোগী প্রতি ডাক্তারের সংখ্যা, বেডের সংখ্যা, হাসপাতালের সংখ্যা- এইসব মাথামুণ্ডু রাশিবিজ্ঞানের ছড়াছড়ি। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও এইসব কারণ একই থেকে গেছে। কী হবে এসব বিশ্লেষণের পাহাড় মাথায় নিয়ে? তার চেয়ে বরং নন্দবাবুর কথায় ফিরে আসি।
পরশুরাম লেখক হিসেবে অত্যন্ত বাস্তববাদী। কাহিনির শুরুতেই নন্দ'র আর্থিক সচ্ছলতার পরিমাণ উল্লেখ করতে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি। ১৯২২ থেকে আজ ২০২১- প্রায় একশো বছরেও ছবিটা এক চুল বদলায়নি। দেদার গাঁটের পয়সা খরচা করতে পারলে তোমার চিকিৎসা হবে, যদিও সঙ্কট কাটবে কিনা তার নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। মজার কথা হল, ট্রাম থেকে পড়ে গিয়েও নন্দ'র কিছুই চোট লাগেনি। তা সত্ত্বেও স্রেফ বন্ধুদের সু বা কু-পরামর্শে অ্যালোপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথি, কোবরেজি এবং শেষমেশ হেকিম- সবার কাছেই মাথা খুঁড়ে মরেছে সে। অর্থাৎ, কিছু হোক না হোক, সঙ্কট কাটুক না কাটুক, পকেটে পয়সা না থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থার দরজায় কড়া নাড়া খুব মুশকিল।
তাহলে কি দেশের লোক চিকিৎসা করায় না? করায় বৈকি। আলবাত করায়। এই যেমন নমিতাদি। আমাদের পাশের গলিতে সুমনদের বাড়িতে আজ প্রায় পাঁচ বছর কাজ করছেন। দুজন অসুস্থ বয়স্ককে দিনের বেলা দেখাশোনা করতে হয়। থাকেন মল্লিকপুরে। স্বামী রংয়ের মিস্ত্রি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আমি বীরেনদার দোকানে ওষুধ কিনি। সেখানেই আলাপ ওনার সাথে। মাধ্যমিক পাশ বীরেনদা ওষুধ বেচতে বেচতে হাফ ডাক্তার হয়ে গেছেন। চোখ কপালে তুলে লাভ নেই। এরকম সিকি, হাফ বা পৌনে ডাক্তারেই দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের চিকিৎসা চলে। ফল জেনে আর কী হবে। যাক গে, নমিতাদি তাঁকেই ডাক্তার মানেন। বীরেনদা চশমাটা নাকের উপর নামিয়ে গম্ভীরভাবে ওষুধও দেন সমস্যা শুনে। নমিতাদি তো বলেন, দিব্যি কাজ দেয় বীরেনদার ওষুধে। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি, বীরেনদার ওষুধের দোকান বেশ বড়। আঁটঘাট বেঁধে সেই কবে থেকে দোকান চালিয়ে যাচ্ছেন। দুটো কম্পিউটারে সমানে জনা চারেক কর্মচারী অনর্গল অন্তহীন ওষুধের ব্যাচ নম্বর, হেন নম্বর, তেন নম্বর তুলেই যাচ্ছেন। সঙ্গে বিনি পয়সার ডাক্তারি। নিজের বিদ্যেয় না কোলালে লাগোয়া চেম্বারে মিত্তির ডাক্তারের কাছে ভিড়িয়ে দেন। এছাড়াও নানান মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট, অক্সিজেন সিলিন্ডার, মায় আয়া নার্স পাঠানো, ফাউলার বেড ভাড়া দেওয়া- কত কী যে বীরেনদা একসাথে চালান! মানে, বেশ গোছানো কারবার, আর এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অজস্র এমন ডাক্তারের চেম্বার সমেত ওষুধের দোকান-কাম-মাইক্রো হাসপাতাল আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
তাও তো নমিতাদির মতো মানুষজন বীরেনদাদের ওষুধের দোকান পর্যন্ত পৌঁছন। বিস্তর লোকজনকে চিনি, এমনকি আমি নিজেও স্রেফ ফোনে ডাক্তারের কথা শুনে বা না শুনে, নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী টুকটাক ওষুধ চালিয়ে টুপটাপ ভালোও হয়ে যাই। লাগলে তুক না লাগলে তাক। পরের স্টেজে বীরেনদা, তা না হলে মিত্তির ডাক্তার, তাতেও না সারলে হাসপাতাল।
আর মন্টু সিং? মাথায় পাগড়ী, গালপাট্টা দেওয়া ইয়া গোঁফ। হার্ডওয়ারের দোকান থেকে একগাদা সিমেন্ট বালির বস্তা ভ্যান রিকশায় চাপিয়ে প্রায় দিনই কোথায় কোথায় পৌঁছতে যায়। সে তো আরেক মক্কেল। শরীর খারাপ হওয়াটা খুব অপরাধের মনে করে। ভ্যান থামিয়ে সেদিন দেখি রাস্তার ধারে গাছতলায় দাঁড়িয়ে বেশ হাঁফাচ্ছে। বিরল দৃশ্য। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেয়া হুয়া, তবিয়ত ঠিক হ্যায়? দাওয়াই লোগে?' শুনেই মন্টু সিং নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, 'নেহি রে বাওয়া, এইসে হি ঠিক হো যায়গা।' এইরকম নিজের ডাক্তার নিজেতে ভর্তি। তবে প্রথাগত ডাক্তারি ছাড়াও শুশ্রূষা হয় কিন্তু। খোঁজ নিলেই জানা যাবে, গ্রাম ভারতের এমনকি খাস শহর, শহরতলি, মহানগরেও তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক স্রেফ বিশ্বাসে ভর করে, চুপিচুপি বা ঢাকঢোল পিটিয়ে জ্যোতিষ, ওঝা, তান্ত্রিক নির্ভর চিকিৎসার পেছনে সময় আর পয়সা খরচা করে। আসলে 'বিশ্বাস' শব্দটা চিকিৎসায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, আর সেখানে ব্লিচিং পাউডার, ডেটল, স্যানিটাইজারের সাথে ভোগ-প্রসাদ চরণামৃতও এক পঙক্তিতে বসে যায়।
'ডাক্তার তফাদার (MD, MRAS) গ্রে স্ট্রিটে থাকেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, দু' খানা মোটর, একটা ল্যান্ড। খুব পসার, রোগীরা ডাকিয়া সহজে পায় না। দেড় ঘন্টা পাশের কামরায় অপেক্ষা করার পর নন্দবাবুর ডাক পড়িল।'
স্বাধীনতার আগে পরে এই বিশ্বাসের কোনও পরিবর্তন আমাদের হয়েছে কী? হয়নি বোধহয়। দু' তিন লাইন জোড়া ডিগ্রি (তার মধ্যে কয়েকটা আবার বিদেশি হলে বিশ্বাসটা বেশ মজবুত হয়), অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা (ডাক্তারবাবুর ব্যক্তিগত সচিবের মাধ্যমে), এইসব না হলে চিকিৎসকের ভারটা ঠিক জমে না, ধার যাই হোক না কেন।
'কীরকম বুঝলেন?' জিজ্ঞেস করায় নন্দকে তফাদার বলেছিলেন, 'ভেরি ব্যাড... আরো দিন কতক ওয়াচ না করলে ঠিক বলা যায় না। তবে সন্দেহ করছি cerebral tumour with strangulated ganglia। ট্রিফাইন করে মাথার খুলি ফুটো করে অস্ত্র করতে হবে, আর ঘাড় চিরে নার্ভের জট ছাড়াতে হবে। শর্ট-সার্কিট হয়ে গেছে।' এইসব জটিল মেডিকেল টার্ম শুনে রোগীর ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। নন্দ তাও সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'বাঁচবো তো?'
সুমনের দাদু-দিদা সে প্রশ্নও করেন না। দামী হাসপাতালের একগাদা পাশ করা ঘন ঘন বিলেত যাওয়া নামী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখে বীরেনদাই হাজার পনেরো টাকার ওষুধ ফি-মাসে নমিতাদির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেন। শারীরিক অবস্থার বিশেষ হেরফের না হলেও পনেরো হাজারি ওষুধের গুণমান বোঝার দরকার নেই সুমনের দাদু-দিদার। মোটা টাকার মেডিকেল ইন্সুরেন্স করা আছে। আউটডোর-ইনডোর সব সুবিধাই অন্তর্ভুক্ত। ফলে, ঘটিবাটি বেচার কোনও ভয় নেই। সকালে ঘুরঘুর করতে বেরিয়ে প্রায়ই মানুষ দুটোর সঙ্গে রাস্তা থেকে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দু-চারটে সুখ-দুঃখের কথা হয় আমার। বুঝতে পারি, চলৎশক্তি ঘরের বাইরে না গেলেও তাঁরা খুশি এবং আশ্বস্ত ওষুধ খেয়ে। ব্যতিক্রম থাকলেও এটাই আসল কথা।
বন্ধুদের সিমপ্যাথি আর কমে না। পরশুরামের গল্পে নন্দ এবার অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে হোমিওপ্যাথির দিকে পা বাড়ালেন। চোরবাগানের নেপাল ডাক্তারের বাড়ি। 'MBFTS - মস্ত হোমিওপ্যাথ। একটি প্রকাণ্ড ঘরের মেঝেতে ফরাশ পাতা। চারিদিকে স্তূপাকারে বহি সাজানো। বহির দেওয়ালের মধ্যে গল্পবর্ণিত শেয়ালের মতো বৃদ্ধ নেপালবাবু বসিয়া আছেন। মুখে গড়গড়ার নল, ঘরটি ধোঁয়ায় ঝাপসা হইয়া গিয়াছে।' নন্দকে নেপাল ডাক্তারের প্রশ্ন, 'শ্বাস উঠেছে?', নন্দ, 'আজ্ঞে?' নেপাল, 'রুগীর শেষ অবস্থা না হলে তো আমায় ডাকা হয় না, তাই জিজ্ঞেস করছি।' হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের মানসিকতার মোক্ষম বর্ণনা।
এগিয়ে যাই ১৯৭২'এর আশেপাশে আমার ছেলেবেলায়। পাত্রের নাম ও বয়স বদলাবে। নেপাল ডাক্তারের জায়গায় স্টিল-প্লান্টের দশটা-পাঁচটার কেরানি দেবুকাকু, যিনি সন্ধ্যায় হয়ে যেতেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। নন্দ'র জায়গায় আমি নিজে, সঙ্গে আমার মা। যথারীতি দেবুকাকুর ঘর হোমিওপ্যাথির মোটা মোটা বইতে ঠাসা আর ধোঁয়ার পরিমাণ একটু কম। গড়গড়ার জায়গায় সিগারেট। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। মন্টু সিং-এর মতো আমার বাবাও শরীর খারাপ হওয়াটা গর্হিত অপরাধ মনে করতেন। বিশেষ করে নিজের ছেলে-মেয়ের। তাতে অবশ্য স্নেহ যত্নআত্তিতে কিছু ক্ষান্তি রাখেননি। দেদার পুষ্টিকর জিনিসপত্র, মানে ফল শাকসবজি মাছ মাংস কিনে আনতেন পরিবারের জন্য। তাঁর নিজেরও সুঠাম নীরোগ শরীর ছিল। ওষুধ খেয়ে সুস্থ থাকাটা খুব একটা পছন্দ করতেন না। আমি কোনওরকমে মায়ের বকার হাত থেকে বাঁচার জন্য স্কুলের পড়াটুকু করে এ পাড়া ও পাড়ায় ক্রিকেট-ফুটবল গুলি ডাংগুলি খেলে বেড়াতাম। একদম শেষে বাড়ি ঢোকার মুখে দিদিদের সাথে তাচ্ছিল্যভরে কিতকিতও খেলতাম। সর্দিকাশি থেকে জ্বর লেগেই থাকত। মন্টু সিংয়ের মতো এমনিতে ঠিকও হয়ে যেত। মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি হলে বেশ কাবু হয়ে পড়তাম। বাবাকে বলা যাবে না। চাঁটি খাব। মা ঠিক বুঝতে পারতেন। ছেলে চুপ করে ঘরের কোণে বসে আছে মানে সন্ধ্যায় দেবুকাকুর বাড়ি যেতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতাম। হোমিওপ্যাথির পুরিয়া খেলে প্রথম দিকে জ্বর বেড়ে যেত। খুব বিরক্তিকর ছিল আমার কাছে। দেবুকাকু যত্ন করে পুরিয়া (সাদা চৌকোনো বিশেষ ধরনের ছোট ছোট কাগজের উপর সাদা রংয়ের মিষ্টি মিষ্টি গুঁড়ো) গুছিয়ে মাকে সব বুঝিয়ে দিতেন- কখন কোনটা কীভাবে খেতে হবে। শেষে রোগীকে ডাকতেন, কারণ তার হাতে অতিরিক্ত দু-চামচ সাদা মিষ্টি গুঁড়ো না দিলে সে তো ঘর থেকে বেরবে না। আমার তো দেবুকাকুর কাছে যাওয়ার ওটাই ছিল লোভ।
সস্তায় পুষ্টিকর খাবারের মতো অবস্থা হোমিওপ্যাথির, উচ্চারণ বিভ্রাটে কাউকে 'হোমোপাখি'ও বলতে শুনেছি। অ্যালোপ্যাথির সাথে তার প্যাথেটিক সম্পর্ক। গ্রাম ভারতের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলে এমনকি পাড়ায় একটা অন্তত হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার পাওয়া যাবেই। স্থানীয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে হোমিওপ্যাথির ডাক্তারবাবুরাই ভগবান। সেখানে তাঁদের দাপট এবং প্রতিপত্তিও গাড়ি-বাড়ি হাঁকিয়ে বিশাল। তবু দুঃখের বিষয়, ২০২১-এও সে যেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ত্যাজ্যপুত্র। কেউ অসুস্থ হয়ে হোমিওপ্যাথি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এমনটা আমি শুনিনি। হতেও পারে কোথাও কোথাও। টাইফয়েড হয়ে একবার অ্যালোপ্যাথি হাসপাতলে ভর্তি হওয়া ছাড়া কৈশোরের প্রায় পুরোটাই প্রয়োজনে হোমিওপ্যাথি পুরিয়া খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। অথচ কেন যে এই পরীক্ষিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা অর্জন করতে পারিনি, আমার নিজের কাছেই সেটা রহস্য। হতে পারে আমার চিন্তার দুর্বলতা। এই ধারার চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর ভরসা করেই দেশ-বিদেশের বিরাট অংশের মানুষ স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পেয়ে থাকেন। অথচ অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ফেল করলে জোড়া পাঁঠা মানত করে কালীমন্দিরে বলি দিয়েছে তবু হোমিওপ্যাথি ওষুধ খায়নি এমন উদাহরণও আমি দেখেছি। যাই হোক, দেবুকাকুর কল্যাণে আমার জ্বর সর্দি-কাশি কমলেও নন্দবাবুর কোনও উপকার নেপাল ডাক্তার করতে পারলেন না।
চিকিৎসা সঙ্কটের প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি। পরশুরাম নন্দকে এখন তারিণী কবিরাজের ডেরায় হাজির করেছেন।
'কবিরাজ মহাশয়ের বয়স ষাট, ক্ষীণ শরীর, দাড়ি-গোঁফ কামানো। তেল মাখিয়ে আটহাতী ধুতি পরিয়া একটি চেয়ারের উপর উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছেন। এই অবস্থাতেই তিনি প্রত্যহ রোগী দেখেন। ঘরে একটি তক্তপোশ, তাহার উপর তেলচিটে পাটি এবং কয়েকটি মলিন তাকিয়া। দেওয়ালের কোলে দুটি ঔষধের আলমারি।'
এ কথা সে কথার পর নন্দ'র রোগভোগের আনুপূর্বিক বর্ণনা শুনে তারিণী কোবরেজ এবার পথ্যে হাত দিলেন। 'কবিরাজ মহাশয় আলমারি হইতে একটি শিশি বাহির করিলেন, এবং তাহার মধ্যস্থিত বড়ির উদ্দেশ্যে বলিলেন- 'লাফাস নে থাম্ থাম্। আমার সব জীয়ন্ত ওষুধ, ডাকলি ডাক শোনে। এই বড়ি সকাল-সন্ধ্যি একটা করি খাবা। আবার তিনদিন পরে আসবা। বুঝেচ?' প্রত্যুত্তরে নন্দ বুঝেছেন বলায় তারিণীর উত্তর, 'ছাই বুজেচ। অনুপান দিতি হবে না? ট্যাবা লেবুর রস আর মধুর সাথি মাড়ি খাবা। ভাত খাবা না। ওলসিদ্ধ, কচুসিদ্ধ এইসব খাবা। নুন ছোবা না। মাগুর মাছের ঝোল একটু চ্যানি দিয়া রাধি খাতি পারো। গরম জল ঠাণ্ডা করি খাবা।'
বাবার কাছে তাঁর কবিরাজ ঠাকুরদার অনেক গল্প শুনেছি। বাংলাদেশের গাইবান্দায় তেনার কবিরাজির পসার ভালোই ছিল। গাঁয়ের লোকের ধন্বন্তরি ছিলেন নাকি। ইয়া বড় বড় গামলা, ঢাউস হামানদিস্তা, এ গাছ সে গাছের শিকড়-বাকড়, পাতা, ডালপালা নিয়ে সে সব কারবার। দার্জিলিং-এর কাছে রঙভঙের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়েছিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝলাম তিনি পাহাড়ের কবিরাজ। রাস্তার ধারে হিমালয়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গাছপালা থেকে চার-পাঁচ রকমের গাছ নিজের হাতে আমাকে দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন। কোনওটায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়, কোনওটায় সুগার বা কোনওটায় জ্বর সর্দি কাশি কমে। অবিশ্বাস করার কোনও জায়গাই নেই। পাহাড়ি গাঁয়ের উদয়াস্ত খেটে খাওয়া লোকজন তাঁর কাছ থেকেই ওষুধ নিয়ে সুস্থ হন। ওঁর কাছ থেকেই শোনা পাহাড়ে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রচুর, যা আমি ভাবতেও পারিনি।
হাজিক-উল-মুলক্ বিন লোকমান নুরুল্লা গজন ফুরল্লা অল হাকিম য়ুনানীর লোহার চিৎপুর রোডের বাসায় গিয়ে নন্দ'র সঙ্কট যাত্রা শেষ হয়েছিল। নন্দ'র মাথা টিপে হাকিম শুধু বলেছিলেন, 'হড্ডি পিলপিলায় গয়া', মানে নন্দ'র মাথার হাড় নাকি নরম হয়ে গেছে। সাধুসন্ত ওঝা পীরবাবা হাকিম কবিরাজ হোমিওপ্যাথি অ্যালোপ্যাথি এমন অজস্র চিকিৎসা ব্যবস্থায় মোড়া আমাদের দেশ। সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা বিশ্লেষণ পেতে গেলে ইন্টারনেটও ফেল করে যাবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আগ্রহ থাকলে আপনি যে কোনও একটায় ঝাঁপ দিতে পারেন। যাতে বিশ্বাস আপনার।
মহামারির কোপ আমাদের দেশ আগেও সহ্য করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু এছাড়াও বহু নিঃশব্দ ঘাতক রোগভোগ আছে যার চিকিৎসা আবহমানকাল ধরে দেশবাসী যে যার বিশ্বাস অনুযায়ী করিয়ে এসেছেন। এর কোনও ব্যতিক্রম হবে না। দু' একটা ছুটকো ছাটকা দুর্ঘটনা ছাড়া যে কোনও মাধ্যমের চিকিৎসক যেচে রোগীর ক্ষতি করতে চান না। এই বিশ্বাসটা রাখতে হবে আর মন খারাপ করলে অতি অবশ্যই রাজশেখর বসুর (পরশুরাম) 'চিকিৎসা সঙ্কট'এ বিপুলানন্দের সরস কাহিনি রসিয়ে পড়ে নেবেন। মন ভালো হয়ে যাবে। নিশ্চিত। রবি ঠাকুরও রাজশেখর বসুর লেখনির গুণগ্রাহী ছিলেন। আর আমার দাদামশাই ইন্দুভূষণ গুপ্তের হাতে রবীন্দ্রনাথের যে কোনও বই তুলে দিলে মুহূর্তে রোগভোগ ভুলে যেতেন, এও এক ধরনের চিকিৎসা।
সঞ্জয়দার লেখা মানেই দুর্দান্ত । এত ভালো লাগে পড়তে যে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত জায়গা থেকে ওঠা যায় না । আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বাস্তব ঘটনাকে অতি সুন্দরভাবে সরলভঙ্গিতে একেবারে মজলিশি মেজাজে লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন । খুব খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে । 🌹🤝🏼🥳
ReplyDeleteদারুণ রসালো লেখা। বাস্তবে পরিস্থিতি একশো বছরেও খুব একটা বদলায়নি সেটা সরস ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ReplyDelete