'শোককে ক্রোধে ক্রোধকে ঘৃণায় পরিণত করুন'
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
প্রায় ন' মাস বিনা বিচারে আটক থাকার পর আজ দুপুরে মুম্বাই হাইকোর্ট যখন ফাদার স্ট্যান স্বামীর বেইল আবেদনের মামলা শুনতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই তাঁর উকিল মিহির দেশাই আদালতকে জানান যে এই আবেদন শোনার আর কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ, অশীতিপর বৃদ্ধ ৮৪ বছর বয়সের ফাদার স্ট্যান স্বামী ইতিমধ্যে ইহলোক ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন।
এ শুধু এক মর্মান্তিক মৃত্যু নয়, এক পরিকল্পিত ও বর্বরোচিত খুন। পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত, কোভিডে বিধ্বস্ত, চলৎশক্তিহীন এক বৃদ্ধের প্রতি এমনতর আচরণ ও জিঘাংসা একমাত্র দেশের শাসনক্ষমতায় বিরাজমান দুই নৃশংস চরমপন্থী শাসক জুটির পক্ষেই সম্ভব। আর দেশের ভঙ্গুর বিচারব্যবস্থাও অসহায়ের মতো এই চরম জিঘাংসাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, সংবিধানে প্রদত্ত ব্যক্তির বুনিয়াদী স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলে এই চূড়ান্ত অন্যায়ের সামনে মাথা তুলে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি। এ শুধু আমাদের লজ্জা বললে অত্যুক্তি হবে। এ আমাদের পরাজয়, ফ্যাসিবাদকে দেশের তখত থেকে এখনও উচ্ছেদ না করতে পারার গ্লানি ও অনুশোচনা।
গত বছরের ৮ অক্টোবর ফাদার স্ট্যান স্বামীকে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) ঝাড়খণ্ড থেকে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্রের তালজোলা সেন্ট্রাল জেলে এনে বন্দী করে। এই এনআইএ হল হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো দিল্লির শাসকদের এমন এক সশস্ত্র দল যারা নির্দেশ পেলেই রাতের অন্ধকারে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে যে কোনও ব্যক্তিকে অপহরণ করে এনে বন্দী করতে পারে। ৮৪ বছরের ফাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল যে তিনি নাকি 'মাওবাদী'দের সঙ্গে যুক্ত এবং দেশের পক্ষে অতীব বিপজ্জনক। ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রে এলগার পরিষদের মামলার সঙ্গে তাঁকে জুড়ে দিয়ে এক নৃশংস অধ্যায়ের সূচনা করল দিল্লির শাসক শিবির।
স্ট্যান স্বামীর অপরাধ? তিনি আদিবাসীদের দাবি-দাওয়া ও অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, সংবিধানের পঞ্চম সিডিউলে প্রদত্ত আদিবাসীদের স্বার্থে আদিবাসী উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের অধিকার নিয়ে সরকারের এত টালবাহানা কেন? চরমপন্থী হিন্দুবাদী দল বিজেপি-আরএসএস পরিচালিত দিল্লি সরকারের পক্ষে জিসাইট ফাদার এই স্ট্যান স্বামীকে তাই সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। অনেক দিন ধরেই ও নানা ভাবে তারা চেষ্টা চালিয়েছিল এই প্রতিবাদী ও আদিবাসী স্বার্থে অটল ব্যক্তিটিকে শায়েস্তা করতে। অবশেষে এলগার পরিষদের মামলায় তাঁকে 'মাওবাদী' তকমা পরিয়ে বন্দী করার ফন্দিটি তাদের মাথায় আসে। উপরন্তু, ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিজেপি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কারণ, তাদের মনে হয় যে ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের মধ্যে ফাদার স্ট্যান স্বামীর অভূতপূর্ব সামাজিক কাজের সাফল্য তাদের নির্বাচনে ভরাডুবির অন্যতম কারণ। যদিও ফাদার বা তাঁর সংগঠন কোনও ভাবেই কোনও রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু ক্ষিপ্ত পাষণ্ডদের কে বোঝাবে যুক্তির বাণী!
নির্দয় এই হিন্দুবাদীরা ফাদারের ওপর এতই ক্ষিপ্ত ছিল যে পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত থরথর কম্পমান হাতে তিনি যখন গ্লাস তুলে জলটুকু পান করতে পারছেন না, তখন তাঁর সামান্য একটি স্ট্র'য়ের আবেদনে পর্যন্ত তারা সাড়া দেয়নি। সেই আবেদন যখন আদালতের দুয়ারে পৌছয়, তখনও এনআইএ ২০ দিন সময় নেয় সেই আবেদনের জবাব দিতে। কতটা নিষ্ঠুর হলে এমন জহ্লাদসম ব্যবহার করা যায়!
শুধুমাত্র এই স্ট্যান স্বামীই নন। একই মামলায় মাওবাদী তকমায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৮০-উর্ধ্ব কবি ভারভারা রাও, মানবাধিকার কর্মী গৌতম নাভালখা, অধ্যাপক সাইবাবা (যিনি প্রায় ৯০ শতাংশ বিশেষ সক্ষমতা-সম্পন্ন মানুষ), সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ সহ বহু কৃতী মানুষকে এবং একইভাবে তাঁদের বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, অধ্যাপক সাইবাবা'র শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় এবং যে কোনও সময় যে কোনও দুর্ঘটনা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এ প্রসঙ্গে মনে আসবে দখলিকৃত পোলান্ডে নাজী বাহিনীর অউজউইথজ (Auschwitz) বন্দী-শিবিরের কথা যেখানে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিলেন ইহুদি। আজ সারা দেশ কি এমনই অউজউইথজ হয়ে ওঠার পথে?
বলাই বাহুল্য, আমরা অত্যন্ত এক কঠিন সময়ের সামনে আজ এসে দাঁড়িয়েছি। গোটা দেশকে আজ এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে দিল্লির শাহেনশাহের দল। আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি, হিন্দুত্বের ত্রাস, পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর যথেচ্ছ সন্ত্রাস, সারা দেশ জুড়ে অঘোষিত জরুরি অবস্থা আর তারই মাঝে ৮৪ বছরের এক অথর্ব, রুগ্ন সমাজকর্মী ফাদারকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা- আমাদের অস্তিত্বকে চরম বিপর্যয়ের পাঁকে নিমজ্জিত করেছে। আমরা কোন পথে যাব?
আর কোনও ফিরে তাকানো নয়, কোনও অজুহাত নয়, এই নির্মম শাসককুলকে জনগণের রায়ে পরাজিত করেই আমরা তাদের সংবিধানের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবো।
ফাদার স্ট্যান স্বামী, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। আপনাকে কারাগারের বাইরে আমরা আনতে পারিনি। কিন্তু সারা দেশ এবার প্রস্তুত হচ্ছে দানবের তরে সম্মুখ সমরে।
ব্যাপক আন্দোলন ও জন জাগরণ ছাড়া এই মুহূর্তে আর দ্বিতীয় কোনও পথ খোলা নেই। এর পরেও যদি আমরা এক হয়ে এই হিংস্র শাসকের বিরুদ্ধে না দাঁড়াতে পারি তবে ভবিষৎ আমাদের ক্ষমা করবে না।
ReplyDelete👺👿 । 🙏🏼🌹♥️
ReplyDeleteহ্যাঁ রাষ্ট্র তো পরিকল্পনা করেই স্ট্যান স্বামীকে হত্যা করেছে । রাষ্ট্র তো এভাবেই বহু প্রতিবাদীকে মাওবাদী, নকশালবাদী তকমা দিয়ে আস্তে আস্তে যন্ত্রণা দিয়ে মারে । রাষ্ট্র তো এরকমই করে, করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরেই । এগুলো করতে না পারলে তো রাষ্ট্রের শান্তি নেই । অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজের কাজকর্ম করবে না কিন্তু অন্য কেউ কাজ করলেও তাতে তার অসুবিধা, প্রবল অস্বস্তি হয় । আর সেই রাগ থেকেই রাষ্ট্র প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সেই সব কাজ করা মানুষদেরকে খুন করে ।
স্ট্যান স্বামীর বহু লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমি দীর্ঘদিন ধরে পড়েছি । সেই থেকে ওনার প্রতি একটা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল । গত দু'বছর আগে মহাবোধি সোসাইটি হলের একটা সভায় উনি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন । আমিও সেই অনুষ্ঠানটা শুনেছিলাম । উনি বাংলায় বক্তৃতা দিতে পারেন না । তাই উপস্থিত শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি ইংরেজিতে না হিন্দিতে বলবেন । অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই হিন্দিতে ওনার বক্তব্য শুনতে চাওয়ায় উনি হিন্দিতেই অত্যন্ত সহজ সরলভাবে ওনার কাজকর্ম, মানুষের প্রতি ওনার অকৃত্রিম ভালোবাসা, এবং সেইহেতু ওনার প্রতি রাষ্ট্রের বিদ্বেষের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেছিলেন এবং সেই সাথে মানুষের জন্য কিভাবে কাজ করতে হয় তার বিভিন্ন দিকনির্দেশ করেছিলেন । বলেছিলেন ভালো মানুষদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে, না হলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করা যাবে না বা যেই সমস্ত কাজকর্ম করা হবে মানুষের জন্য সেগুলো খুব ভালো একটা রূপ পাবে না । কদিন আগেই ওনার কথা ভাবছিলাম । আর আজকে এই খবরটা শুনে খুব খারাপ লাগছে । ওনার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ও রাষ্ট্রের প্রতি ধিক্কার ও তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করলাম ।