Friday, 2 July 2021

তালাবন্দী বিশ্ব

প্রকৃতির খানিক বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল

মৃণাল মুখোপাধ্যায়

প্রীতম কংসবণিক


পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র টলোমলো। জিডিপির পিছনে ছুটে চলা এই পৃথিবী না পেরেছে সব মানুষের খাবারের জোগান দিতে, না পেরেছে পরিবেশের ক্ষত নিরাময় করতে। আসলে বিসমিল্লায় গলদ। শুধুমাত্র মুনাফা-লোভী উন্নয়নের এই প্যারাডাইমটা বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে কখনই পরিবেশ রক্ষার জন্য কোনও কার্যকরী দীর্ঘস্থায়ী নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না, তার বাস্তবায়ন তো অনেক দূরের কথা। কোভিড-১৯ জনিত ‘বিশ্বজোড়া তালাবন্দী' বিশ্ব-পরিবেশ একেবারে নতুন ভাবে ভাববার সুযোগও করে দিয়েছে। বহু নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করে যা আমরা করতে পারিনি, ‘বিশ্ব জোড়া তালাবন্দী’ অবস্থা আমাদের সেই বহু কাঙ্ক্ষিত নির্মল পরিবেশ খানিকটা ফিরিয়ে দিয়েছে। 

আমাদের দেশে দীর্ঘ দুই-আড়াই মাসের লকডাউনে শিল্পের যন্ত্র ছিল স্তব্ধ। পেট্রোল ও ডিজেল বাহিত গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ। শিল্প উৎপাদনও বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিতে ফসিল ফুয়েল অনেক কম ব্যবহৃত হয়েছে। লকডাউনের শেষে বাতাসে কার্বন পদাঙ্ক বা কার্বন ফুটপ্রিন্টের পরিমাণ আশ্চর্যজনক ভাবে কমে গিয়েছিল (দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক কারণে যে পরিমাণ কার্বন উৎপাদিত হয় তার পরিমাপ পদ্ধতিকে কার্বন পদাঙ্ক বা কার্বন ফুটপ্রিন্ট বলা হয়)। ভারতীয় গৃহস্থের দেড় বছরে গড় কার্বন ফুটপ্রিন্টের পরিমাপ ১২০০ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এছাড়া পরিবহন এবং কলকারখানার হিসেব ধরলে এর পরিমাণ আরও বেশি। গ্লোবাল জিডিপি’র সাপেক্ষে ২০২০ সালে সামগ্রিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হার অনেক কমেছে।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে যে মাত্র দু’ মাসের লকডাউনে চিনে ২৫ শতাংশ বায়ুদূষণ কমেছে যার ফলশ্রুতিতে ৪০০০ শিশু ও ৭৩০০০ বৃদ্ধ মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। ২০২০ সালে সমুদ্র পথে পণ্যবাহী জাহাজের যাতায়াত কমেছে ২০ শতাংশ। সারা পৃথিবী জুড়ে কমেছে জল দূষণের মাত্রা। কমেছে বায়ুদূষণের হারও। ইতিমধ্যে পৃথিবীর ওজোন স্তরের ক্ষত কিছুটা সেরে উঠেছে। ইউরোপ স্পেস এজেন্সির স্যাটেলাইট ইমেজে দেখতে পাওয়া গেছে, ইউরোপ ও আমেরিকার অধিকাংশ বড় শহরে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড’এর সাথে নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড’এর পরিমাণও অনেক কমে গিয়েছে। ফলত শ্বাসকষ্ট জনিত রোগের প্রকোপ অনেকাংশে কম এবং তজ্জনিত মৃত্যুও অনেক কমেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে। 

আমাদের দেশেরও নানা প্রান্তে মানুষের অযাচিত অনিয়ন্ত্রিত সক্রিয়তার অনুপস্থিতিতে প্রকৃতি তার ডানা মেলেছে। অন্য প্রাণীরা নির্ভয়ে বাঁচতে শুরু করেছে। জাতীয় পরিবেশ আদালত আমাদের রাজ্যের প্রায় ১৭টি নদীকে দূষিত হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে চূর্ণী, ইছামতী, মহানন্দা, গঙ্গা এবং বিদ্যাধরী নদী অন্যতম। লকডাউন ও পরবর্তী ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনের কারণে কম বর্জ্য পদার্থ নদীর জলের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ফলত এই সময় নদীর জল অনেকটাই দূষণ মুক্ত হয়েছে। লকডাউনের অব্যবহিত পরে নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে আশ্চর্যজনক ভাবে। নদীতে দেখা মিলেছে নানা প্রকার আঞ্চলিক মাছের, যেমন, ট্যাংরা, বাগদা, মীনের। দামোদরে ফিরে এসেছে বিলুপ্ত-প্রায় আঞ্চলিক মাছের প্রজাতিগুলি।

ভারতে লোকসভার সচিবালয় ২০২০’র মে মাসে লোকসভায় যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, লকডাউন ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের কারণে সারা দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশের গুণমান বেড়েছে। এই রিপোর্ট কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দেশে ৭৮ শতাংশ শহরে বাতাসের গুণমান ভালো, যা সাধারণত ৪৪ শতাংশ শহরে প্রত্যাশিত। লকডাউনে শিলিগুড়ি থেকে দেখা গিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, দেখা মিলেছে জলন্ধর থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের হিমাচলের ধাউলাধর রেঞ্জ। গত ৩০ বছরে এই দৃশ্যমানতা সর্বাধিক। এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে প্রায় সব বড় শহরগুলিতে মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়েস্টের পরিমাণ ২৫ শতাংশ থেকে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, লকডাউনের পূর্ববর্তী সময়ে উত্তরাখণ্ডের গঙ্গায় প্রতি লিটার জলে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বা বিওডি)’এর পরিমাণ ছিল ৫.৮ মিলিগ্রাম। লকডাউনের শেষের দিকে গঙ্গার জলে বিওডি’এর পরিমাণ প্রতি লিটারে কমে গেছে প্রায় ২ মিলিগ্রাম। গঙ্গা নদীর স্বাস্থ্য'র পক্ষে এই তথ্য অত্যন্ত ইতিবাচক। এই সময়ে দীঘার সমুদ্র সৈকতে বালি কলমির উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছে। এই গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ সামুদ্রিক ভূমিক্ষয় রোধ করে। তারা ফিরিয়ে এনেছে মাইক্রো-ইকোসিস্টেম যা বিভিন্ন রকম কীটপতঙ্গের জীববৈচিত্র্যের চক্রকে সচল রাখে। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ সামনে আসছে প্রতিদিন। যা মানুষ অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েও করে উঠতে পারেনি সদিচ্ছার অভাবে। প্রকৃতি নিজেই তা করে দেখিয়েছে। আমাদের খালি বিনয়ের সঙ্গে প্রকৃত প্রজ্ঞায় বুঝে নিতে হবে প্রকৃতির ইঙ্গিতকে। অতি সম্প্রতি উড়িষ্যা’র সমুদ্র উপকূলে লক্ষাধিক ওলিভ রিডেল টার্টল এসে জড়ো হয়েছে জনন ও বংশ বিস্তারের জন্য।

কোভিড-১৯ জনিত অতিমারিতে মানুষের মধ্যে পরিবেশ-অনুকূল অভ্যাসগত ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ করা গেছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণও নিয়ন্ত্রিত, অনেক সহজে অনাবশ্যক ভোগবিলাস কমানো, সাইকেল ও হাঁটার অভ্যেস, পুনর্নবীকরণ-যোগ্য শক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়া উল্লেখ্য। এই সময়ে বিশেষ করে ইউরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি ভারতেও অরণ্যের বিস্তার ঘটেছে। তবে এ কথাও স্মরণে রাখা জরুরি যে, কোভিড-১৯ জনিত অতিমারিতে ‘বিশ্বজোড়া তালাবন্দী’ অবস্থায় মাস্ক, গ্লাভস, প্লেক্সিগ্লাস, ডিসপোজেবল ব্যাগ ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাস্টিক উৎপাদন বেড়েছে, ফলে প্লাস্টিক জনিত দূষণের সম্ভাবনা বেড়েছে। উন্নত দেশগুলিতে সংক্রমণের ভয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতাও বেড়েছে। অনেক পরিবেশ সংক্রান্ত জরুরি আলোচনা-সিদ্ধান্ত আটকে আছে। উপযুক্ত নজরদারির অভাবে হয়তো অ্যামাজনের জঙ্গল কমেছে আরও কয়েক বর্গ মাইল। তবুও সামগ্রিক ভাবে কোভিড-১৯ জনিত অতিমারি আমাদের পরিবেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।

কোভিড-১৯ জনিত অতিমারিতে এই মৃত্যুমিছিল আমাদের উত্তরকালের প্রজন্মের জন্য একটি অশনি সঙ্কেত মাত্র। আমরা কি পারব বিজ্ঞান ভিত্তিক এমন শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যেখানে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হার হবে শূন্য? পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রগুলোর কাছে জনস্বাস্থ্য কি হয়ে উঠবে প্রধান বিবেচ্য বিষয়? পরিবেশ-বান্ধব শহর ও নগর পরিকল্পনার নীতি কি গ্রহণ করা যাবে? অন্যথায় অনতিবিলম্বেই আসবে নতুন মহামারি বা অতিমারি, আরও বেশি অমানবিক বিপন্নতার জন্য উত্তরকালের কাছে দায়ী থাকতে হবে আমাদের।     

এ কথা ঠিক, ভারত তথা গোটা পৃথিবীর অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের গতিতে একটি ছেদ বা যতি চিহ্ন পড়েছে। আমাদের পৃথিবীতে অসাম্যের চিত্রটা প্রকট হয়ে উঠেছে। মানুষের প্রয়োজনে আমাদের শিল্প উৎপাদন শুরু করতে হবে। কিন্তু তার নীতি কী হবে? লাভের ভাণ্ডার ভরে তুলতে ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা উৎপাদনকে হয়তো আরও কয়েক গুন বাড়িয়ে দেবেন। আমাদের এই প্রকৃতি তার অসুখকে এই কয়েক দিনে যতটা সারিয়ে নিয়েছিল সেই ক্ষতের প্রলেপ আবার হয়তো উন্মুক্ত হবে। আরও তীব্র ক্ষত তৈরি হবে প্রকৃতির শরীরে। মুনাফার প্রয়োজনে যদি আবার আমরা লাগামছাড়া হই, পৃথিবী আবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে, প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু এই লকডাউন, এই ধেয়ে আসা সংক্রমণের নতুন অভিঘাত আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেল- এই প্রকৃতির একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। ঠিক সেই কারণেই আমাদের উন্নয়নের বিকল্প পদ্ধতির খোঁজ করতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বিকল্প নীতির জন্যে লড়াই করতে হবেই। ব্যক্তিগত স্তরে যেমন পরিবেশ-বান্ধব আচরণ অনুশীলন প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রীয় স্তরে সুস্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো বিকল্প পদ্ধতি ও নীতি গ্রহণ এবং রূপায়ন আশু কর্তব্য। সে কাজ করতে পারলে তার লাভের গুড় আমরাই খাব চেটেপুটে। অনেকদিন বাঁচতে পারব, বাঁচাতেও পারব উত্তর-প্রজন্মকে।

এ সময় গভীর আত্মানুসন্ধানের। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানোর সময়। অনেক অপ্রয়োজনকে আমরা প্রয়োজন বলে জেনে এসেছি, সেই বাহুল্যকে ত্যাগ করার সময়। আমাদের ভোগের মাত্রা, আমাদের লোভের মাত্রা কমাতে পারলে সত্যিই আমরা এই পৃথিবীকে উত্তরকালের প্রজন্মের জন্যে বাসযোগ্য করে রেখে যেতে পারব।


2 comments:

  1. গত বছর থেকেই আমি lockdown এর পক্ষে, কারণ এটা করোনা সংক্রমণ আটকাতে সাহায্য করে, দুই এটা প্রকৃতিকে দূষণ মুক্ত করতে সাহায্য করে। কিন্তু বাজার অর্থনীতির কারণেই দূষণ এবং করোনা সংক্রমণের উৎপত্তি সেই বাজার অর্থনীতিকে কাঠগড়ায় তুলে প্রকৃতি বান্ধব অর্থনীতির দিকেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং তখন lockdown ঠিক মতন করাও যাবে কারণ অনাহার অর্ধাহার চাকরি চলে যাওয়ার প্রশ্ন থাকবে না।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। প্রকৃতির এই রূপ গত বছর আমরা সবাই অনুভব করেছি। কিন্তু উন্নয়ন র নীতি তো বিপথগামী এর থেকে কে বাচাবে । আগের টি ও পরেছি। প্রকৃতি হয়ত নিজেই রাস্তা দেখাবে সবাইকে।

    ReplyDelete