Saturday, 3 July 2021

'খাই খাই কর কেন'

খাদ্য বিপ্লবের বুটের শব্দ

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


‘খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে/ খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে’– সুকুমার রায়ের এই কবিতার সঙ্গে অপরিচিত বাঙালি বিশ্ব চরাচরে অমিল। বাঙালির জীবনের সঙ্গে ফুটবল আর ভোজন রসিকতা প্রায় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। স্ট্রিট ফুড হোক কিংবা সাবেকি ঘরোয়া খানাপিনা– সবেতেই বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগীন্দ্রনাথ সরকার থেকে সুকুমার সেন, বুদ্ধদেব বসু, শিবরাম চক্রবর্তী, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত প্রায় সকলেই নানাভাবে নিজেদের খাদ্যপ্রীতির কথা জানিয়েছেন। সেই ধারা এখনও বহাল তবিয়তে বহমান। তাছাড়া আমবাঙালি তো কানকো তুলে মাছ আর দীর্ঘ লাইন দিয়ে হলেও চোখের সামনে কেটে দেওয়া ‘আসল ও টাটকা’ মাংস (মুরগি, খাসি, বিফ যাই হোক) কিনে তবেই খুশিতে ডগমগ হয়েছে এতকাল। নইলে তো ঠিক পোষায়নি তার! 

কিন্তু একুশ শতকে ‘আসল ও টাটকা’ শব্দে বিশেষ আপত্তি দেখা দিয়েছে। এর প্রেক্ষিত হল তিনটি: প্রাণী-কল্যাণ, পরিবেশ রক্ষা ও খাদ্যাভাব-নিয়ন্ত্রণ। সারা বিশ্ব জুড়ে রসনাতৃপ্তির জন্য প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ করার কলরব উচ্চকিত। ‘গো ভেগান’ নামের আন্দোলনও বহুশ্রুত। তাছাড়া করোনা যে একটি জুনোটিক (পশুবাহিত) ব্যাধি সে-বিষয়েও যথেষ্ঠ তথ্য ইতিউতি বিদ্যমান। পক্ষান্তরে, মাংস উৎপাদন শিল্পের কারণে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির কথাও ধীরে-ধীরে প্রমাণিত হচ্ছে। পশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি ও জলের জোগান পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি করছে। নির্গমন হচ্ছে প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাসের। তাছাড়া কার্বন ফুটপ্রিন্টের মতো সমস্যায় পশুপালনের বিবিধ পন্থা ও পশুহত্যার ভূমিকা ইতিমধ্যেই সর্বজনবিদিত। এগুলি ব্যতিরেকেও কিছু দেশে, যেমন, চিন, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি, বিবিধ বন্যপ্রাণীর হত্যা করে খাওয়ার রীতি প্রচলিত। সেগুলি আমাদের দেশের খাদ্যরুচির সঙ্গে না মিললেও মিথ্যে নয়, বাস্তব। ফলে, অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রেও কুপ্রভাব ক্রমবর্ধমান। বলা ভালো, মানুষ তাই এক অকল্পনীয় বিপদের সম্মুখীন। 

সর্বোপরি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুমান, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ বিলিয়ন মানুষ পৃথিবীর জনসংখ্যায় সংযুক্ত হবে। ফলে, পাল্লা দিয়ে বাড়বে খাদ্যের (বিশেষ করে মাংসের) চাহিদাও। তাই তাদের পুষ্টিসম্মত আহারের বন্দোবস্ত করার জন্য বর্তমান উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটানো আশু প্রয়োজন। কিন্তু সেই পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য দরকারি ভূমি, উপকরণ ও কাঁচামালের জোগান কি আছে? এক কথায় উত্তর- না নেই। তাহলে কি মানুষ আগামী সময়ে না খেতে পেয়ে মারা যাবে? জেনেশুনে সেটাকে বাস্তবায়িত হতে দেওয়া অসম্ভব। ফলে পরিসমাপ্তিতে যেন নিরামিষাশী হওয়াই সম্ভবত একমাত্র বিধিলিপি। 

হিন্দুশাস্ত্রে এক কালে গো-মাংস ভক্ষণ প্রচলিত থাকলেও পরে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়, সম্ভবত পুজোআর্চায় দুগ্ধজাতের জোগান কিংবা স্বাস্থ্যবিধির কথা মাথায় রেখে। তাই নতুন করে আবার সেরকম কিছু আরোপিত হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু আবার প্রকৃতিই তো তার ভারসাম্য বজায় রেখে মানুষকে ক্যানাইন ও মোলার দাঁত দিয়ে ওমনিভোরাস প্রাণী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই তো মানুষ যুগপৎ মাংস ও শস্যদানা দুই-ই গ্রহণে সক্ষম। সে ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নিরামিষাশী হয়ে যাবার দাওয়াই কি জনমানসে চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে, নাকি মানুষ মেনে নেবে? তাহলে এই যুগপৎ দ্বন্দ্বে মধ্যমপন্থাটি কী, যার দ্বারা পশুহত্যাও বন্ধ হয় কিন্তু মানুষকে নিরামিষাশীও হতে না হয় ও খাদ্যাভাব দূর করে পরিবেশও রক্ষা করা যায়?


উপায়টি হল, কৃত্রিম মাংস ও শস্য উৎপাদন। অর্থাৎ, বিভিন্ন খাদ্যশস্য দানার অথবা প্রাণীর, যেমন, মুর্গি, খাসি, গরু, শুয়োর, টার্কি ইত্যাদি কোষকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে সেল-কালচারের মাধ্যমে বা পুষ্টিকর সিরামে পেশি কোষগুলির বৃদ্ধি ঘটিয়ে এবং পেশি-জাতীয় ফাইবারে রূপান্তরিত করে বিশেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা খাদ্যযোগ্য করে বাজারজাত করা। এর নাম ‘সেলুলার এগ্রিকালচার’। সুতরাং, আর ‘ওয়েট মার্কেট’ নয়, ভবিষ্যতে মুদিখানার দোকান কিংবা নির্দিষ্ট দোকানেই পাওয়া যাবে আকর্ষণীয় প্যাকেটের মোড়কে বাহারী প্রাণীর মাংস। ব্যাপারটা এই মুহূর্তে গা-ঘিনঘিনে হলেও এটাই ভবিতব্য। বিখ্যাত স্টিভ জোবস বলেছিলেন, ‘মানুষ যে কী চায় তা সে ততক্ষণ জানে না যতক্ষণ না বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুনতর পণ্যটির ব্যাপারে তাকে স্বপ্নাতুর করে তোলা হয়, আর এইভাবেই তৈরি করতে হয় বাজারের চাহিদা।' 

 

আর কেউ না জানুক, পুঁজিপতিরা জানে মুনাফার বাজারের সন্ধান। তাইতো বিল গেটস লাগাতার জমি কিনছেন ও বিনিয়োগ করছেন কৃত্রিম খাদ্যের নানান বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। বর্তমানে বিল গেটস ২৪২,০০০ একর জমির মালিক। তথ্য বলছে, তিনি হলেন এই মুহূর্তে দুনিয়ার সব থেকে বেশি ব্যক্তিগত কৃষিযোগ্য জমির মালিক। এছাড়া তিনি বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করছেন কৃত্রিম খাদ্য উৎপাদনের গবেষণায়। এই ব্যাপারটাই ইঙ্গিত দেয় আগামীর। নইলে কেন একজন শিল্পপতি আচমকা আগে থেকে এত এত জমি কিনে রাখতে যাবেন? কী উদ্দেশ্য তাঁর? আসলে তিনি যেন জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজমের মাধ্যমে দুনিয়াব্যাপী খাদ্য-উপনিবেশ বানানোর স্বপ্ন দেখছেন। অর্থাৎ, যাকে বলে কৃষকহীন খাদ্য-উৎপাদন ও পশুহীন মাংস-উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে সমগ্র মানবসভ্যতাকে করায়ত্ত করা। কেননা খাবারের জোগান একচেটিয়াভাবে যার হাতে থাকবে সেই তো সম্রাট। আর তাই ২০১৩ সাল থেকেই জলবায়ু রক্ষা ও পশুকল্যাণের আড়ালে শুরু হয়েছে অবিশ্রান্ত প্রজ্ঞাপন। 

কিন্তু তারপরেও কি মানুষের কাছে গৃহীত হবে এই নব্যপণ্য? কিংবা কতই বা মূল্য হবে এই নতুন খাদ্যের? অর্গানিক খাদ্যের দাম দেখে এ কথা আন্দাজ করাই যায় যে এই কৃত্রিম খাদ্যের মূল্য হবে আকাশছোঁয়া। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। কিংবা বলা যেতে, কেবলমাত্র উন্নত দেশগুলির কাছে থাকবে অ্যাফোর্ড করার ক্ষমতা। তাহলে কী হবে বাকি দেশগুলির? সেজন্যেই শুরু হয়েছে দ্বৈতনীতি– উন্নত দেশগুলির জন্য একরকমের নীতি ও উন্নয়নশীল দেশ কিংবা পিছিয়ে পড়া দেশগুলির জন্য ভিন্ন নীতি। উন্নত দেশগুলিতে কৃত্রিম খাদ্য চালু করে, পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে ব্যবহার করা হবে ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসাবে, যেটা হয়ে এসেছে এতকাল। তবে সেটা আর মাগনায় নয়। ভ্যাকসিনেসনের মাধ্যমে একদিকে তাদের ভয়াবহ রোগের হাত থেকে রক্ষা করা হবে ও বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদেরই জমি কিংবা পোল্ট্রি দখল করে তাদেরই শেখানো হবে নতুন নতুন উৎপাদনের কৌশল যা টেঁকসই উন্নয়নের গতিকে ধরে রাখবে।   

কল্পবিজ্ঞানের মতো হলেও এটার বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় চিন'এর তথ্য বলছে যে, ৫২.৯ শতাংশ মানুষ কৃত্রিম মাংস দ্বারা আসল মাংসের প্রতিস্থাপনে রাজি হয়েছেন। সিঙ্গাপুর থেকে আমেরিকা নানা দেশ লঘুগতিতে হলেও একে বাজারজাত করার অনুমতি দিচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ভারতে আইআইটি গুয়াহাটি সাফল্যের সঙ্গে পরীক্ষাগার জাত মাংস উৎপাদন করে এর সমর্থনে অভিমতও প্রকাশ করেছে। আইআইটি দিল্লির অধ্যাপক কাব্য দাশোড়া উদ্ভিদ-ভিত্তিক কৃত্রিম ডিমের উদ্ভাবন করে ইউএনডিপি’র দ্বারা বিশেষরূপে সম্মানিত হয়েছেন। 

 

অতঃকিম! কৃত্রিম খাদ্যই (মাংস কিংবা শস্যদানা) হতে চলেছে আগামীর রসনাবিলাসের উপকরণ। আর কথায় বলে, পেটে খেলে পিঠে সয়। সুতরাং, এই নব্যখাদ্যই আগামীর অর্থনীতির মূল নিয়ন্তা হতে চলেছে। ফলে, পিঠের ওপরে নতুন বোঝা চাপানোর প্রস্তুতিও মানুষকে নিতেই হবে। মানুষ আজীবন ব্যাধির মূল কারণের বদলে উপসর্গে মনোনিবেশ করেছে এবং তার অনিয়ন্ত্রিত মুনাফার লোভ জন্ম দিয়েছে এক উন্মত্ত সভ্যতার। ফলে, এখন আমরা প্রবেশ করেছি এক নতুন যুগভাষ্যে। এতদিনের যাবতীয় পুরনো চিন্তাপদ্ধতি সব বাতিল হতে চলেছে এক লহমায়। বদলে যেতে চলেছে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের মাত্রাটিও। যে-কথা প্রচলিত ছিল এতদিন- ‘অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান’- তারও আঙ্গিক পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এমতাবস্থায় মানুষ যদি আজও শনাক্ত না করে সমাজের মূল প্রতিপক্ষগুলিকে তবে বাঙালির চিরাচরিত ডাল-ভাত-তরকারি শুধু নয়, বিশ্ব জোড়া মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির পাতে আছে ধনপতিদের আস্তাকুঁড়।


3 comments:

  1. 👍🏼👌🏼 তথ্যভিত্তিক নতুন ধরণের একটা লেখা । ভালো । এই বিষয় সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য দেখেছি অল্প কিছুদিন আগেই ।

    ReplyDelete
  2. নতুন বিষয় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হলাম ।কৃত্রিম খাদ্যই যদি ভবিতব্য হয় তবে ভয়ঙ্কর আগামীদিন।পেস্টিসাইড ও রাসায়নিক সার বিক্রির বাজার তৈরির জন্য সোনাব্যঙ ধরে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল ৪০-৪৫ বৎসর আগে ।যে সোনা ব্যঙ ফসলের পোকামাকড় খেত আর কেঁচো প্রাকৃতিক উপায়ে জমির উর্বরতা ধরে রাখত।আগামীদিন আসছে প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করার দিন

    ReplyDelete
  3. যাই হোক,গরিব মানুষ যেন অভুক্ত না থাকে সেটা দেখাটা জরুরি।

    ReplyDelete