মোদিও কম যান না
শোভনলাল চক্রবর্তী
সম্প্রতি ফরাসি এনজিও 'রিপোটার্স উইথআউট বর্ডারস' (আরএসএফ) প্রকাশ করল দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ৩৭ জন নেতা-নেত্রীর ছবি, যাঁরা বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের শীর্ষে রয়েছেন। সাংবাদিকদের এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তি: সারা পৃথিবী জুড়ে কোন দেশ এবং সেই দেশের কোন নেতা বা নেত্রী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সর্বোচ্চ হস্তক্ষেপ করেছেন। এই নেতা-নেত্রীদের নাম দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার শিকারি বলে। এই শিকারিদের গড় বয়স ৬৬।
২০১৬ সালের পর আবার তারা প্রকাশ করল তাদের প্রতিবেদন, যেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বহু দেশের সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে নানাভাবে কেড়ে নিতে উদ্যত। কোনও দেশ ব্যবস্থা করেছে নানা ধরনের সেন্সরশিপ বা কাঁচির, কেউ আবার অপছন্দের সাংবাদিকদের ধরে সটাং জেলে পাচার করে দিচ্ছে, কিংবা লোক লাগিয়ে হত্যা করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। সন্দেহজনক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যা প্রত্যেক দেশে ক্রমশ বাড়ছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে তারা ১৯টি দেশকে শনাক্ত করেছে যেখানে সাংবাদিকতা বর্তমানে একটি বিপজ্জনক পেশা। ওই সংস্থা প্রকাশিত ম্যাপে সেই দেশগুলিকে লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারত সেই ১৯টি দেশের একটি। পাঁচ বছর আগে ভারতের অবস্থান ছিল ১৩৩, বর্তমানে যা আরও ৯ ধাপ নেমে এসে হয়েছে ১৪২। তারা ১৬টি দেশকে দিয়েছে কালো রং, যেখানে অবস্থা আরও খারাপ।
যেটা রীতিমতো চিন্তার সেটা এই যে, এই দেশগুলির এক-তৃতীয়াংশের অবস্থান এশিয়া প্যাসিফিকে। যে দুই মহিলা এই শিকারিদের তালিকায় নতুন স্থান পেয়েছেন, সেই দু'জনই এই অঞ্চলের দেশের নেত্রী। পশ্চিমি স্বাধীন গণমাধ্যমের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে ওই তালিকায় এই প্রথমবারের জন্য উঠে এসেছেন ইউরোপের এক দেশের নেতা। ১৭ জন শিকারি এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন এই প্রথমবার। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম এই তালিকায় রয়েছে তালিকার জন্মলগ্ন থেকেই। যে দু'জন মহিলা এই প্রথমবার তালিকায় এলেন তাঁদের একজন আমাদের পড়শি দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৯ সাল থেকে হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ, বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে প্রভূত উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ভারতের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে নিয়ে আসেন এক জনবিরোধী, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধকারী আইন: ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। এই আইনের ফাঁসে হাসিনা সরকার ৭০ জনেরও বেশি সাংবাদিক ও ব্লগারকে জেলের ঘানি টানিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় যে মহিলা এই তালিকায় রয়েছেন তিনি হংকং-এর বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের প্রধান শাসনকার্য পরিচালক ক্যারি ল্যাম। ল্যাম ২০১৭ সালে এই পদে আসীন হন এবং বর্তমানে চিন সরকারের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন। তিনি সংবাদমাধ্যম সহ সমস্ত মাধ্যমের ওপর খড়্গহস্ত। চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মূলত তাঁর কারসাজিতেই গত ২৪ জুন তারিখে বন্ধ হয়ে গেল হংকং-এর গণতন্ত্রমুখি সংবাদপত্র 'এপেল ডেইলি' এবং ওই সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা জিমি লাই'কে জেলে ঢোকানো হল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জিমি লাই ২০২০ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার লক্ষ্যে তাঁর নিরন্তর লড়াইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওর্বন এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনেরো এই প্রথমবার তালিকাভুক্ত হলেন। কারণ, তাঁরা করোনা অতিমারির সময় সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে ব্যস্ত ছিলেন। অ্যামাজনের আগুনের ছবিকে 'ডাহা মিথ্যা' বলে বোলসোনেরো সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে এক হাত নিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল প্রেসিডেন্ট নিজেই মিথ্যা বলেছেন। হাঙ্গেরির সংবাদমাধ্যম সেখানকার কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরতেই প্রধানমন্ত্রী ওর্বন সংবাদমাধ্যমকে কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী আক্রমণ করেন। এরপর তিনি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন।
সৌদি আরবের ৩৫ বছরের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর লাগানো থেকে শুরু করে হুমকি, অপহরণ করে নির্যাতন, খুন ইত্যাদি কিছু করতেই আর বাকি রাখেননি। তুর্কির সৌদি বিদেশ মন্ত্রকের অফিসের ভেতরে ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগী'র হত্যাতেও জড়িয়েছিল যুবরাজের নাম। তাই যুবরাজের জায়গা হয়েছে এই শিকারির দলে। এই শিকারির দলে রয়েছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বেসর্বা কিম জং, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদ, ইরানের সর্বময় কর্তা আলি খেমেনি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, বেলারুশের আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে এই প্রতিবেদনে দীর্ঘ একটি অনুচ্ছেদ লেখা হয়েছে। মোদির গণমাধ্যমকে পকেটে পোরার কায়দা হচ্ছে জাতীয়তাবাদে সুড়সুড়ি দেওয়া বক্তব্য এবং মিথ্যাচার। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ওই রাজ্যকে একটি ল্যাবরেটরি বানিয়েছিলেন মিথ্যা সংবাদ প্রচার ও নিয়ন্ত্রণের কায়দাকানুন রপ্ত করার জন্য। সেই সব কায়দাকানুন তিনি ২০১৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পর আরও বড় মাত্রায় ব্যবহার শুরু করেন। তাঁর গণমাধ্যম সামলাবার মূল অস্ত্র 'নৌটঙ্কি' । অর্থাৎ, নাটকীয় ভাবে নিজের তথাকথিত দেশপ্রেমী, জাতীয়তাবাদী, হিন্দু পরিচয়কে জাহির করা। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা বুঝেছিলেন যে বড় পুঁজিপতিদের দলে টেনে তারপর তাদের টাকা দিয়েই গণমাধ্যমকে কব্জা করা সম্ভব। আজ সেটাই তিনি করেছেন। বিভিন্ন শিল্পপতিদের টাকায় গণমাধ্যম চলছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখলে, কার্টুন আঁকলে, সরকারি প্রকল্পের সমালোচনা করলে সাংবাদিকের চাকরি চলে যাবে, যাচ্ছেও। তাই প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যা প্রচার দেদার চলছে।
এর পাশাপাশি তিনি একটি আইনি ব্যবস্থা খোলা রেখেছেন। বিভিন্ন ধরনের জনগণের কন্ঠরোধ করা আইন- যেখানে যাকে তাকে যখন তখন দেশদ্রোহী তকমা এঁটে গ্রেফতার করা যায়, তারপর জেলে পচিয়ে মেরে ফেলা যায়। যেমনটা আমরা সদ্য দেখলাম স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রে। চিনের জিং পিং-এর পরেই গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় হত্যাকারী হিসেবে রয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এ আমাদের লজ্জার এবং চিন্তার বিষয়। আমাদের উপমহাদেশের অন্যান্য দেশও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে তাঁর পিছু নিয়েছেন এটাও গভীর চিন্তার বিষয়।
বেশ ভালো তথ্যমূলক লেখা । 👌🏽🌹 আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদী একটা নির্লজ্জ, বেহায়া, কানকাটা, গণতন্ত্র হত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী । একে (এই নিকৃষ্ট মানবতার শত্রুকে) যতশীঘ্র উপড়ে ফেলা যায় ততই ভালো । 🐷🧹🔨👿
ReplyDelete