Friday, 30 July 2021

অতি চালাকের গলায় দড়ি!

ভারতের সার্বভৌমত্বের অন্তর্জলি যাত্রা

শোভনলাল চক্রবর্তী


বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের যা মনোভাব তাতে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক বিরোধী নেতা-নেত্রী, সাংবাদিক বা রাষ্ট্রদূতদের পিছনে টিকটিকি লাগিয়ে তাঁদের সম্পর্কে খবর জোগাড় করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে খুব একটা চমকে ওঠার কিছু নেই। কিন্তু ইজরায়েল থেকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার আনিয়ে তার সাহায্যে গোয়েন্দাগিরি বিশিষ্টতার দাবি করে। 

এই 'প্লাগ এন্ড প্লে' স্পাইওয়্যার যে কোনও মোবাইল ফোনকে পরিণত করে অতন্দ্র তত্ত্বাবধায়কে। আপাতত যা খবর পাওয়া গেছে তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই স্পাইওয়্যার ব্যবহারের ফলে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মূলে নেমে এসেছে কুঠারাঘাত। এর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সংসদীয় বিরোধী পক্ষ, ক্যাবিনেট স্তরের মন্ত্রী, সিবিআই প্রধান, শিল্পপতি এবং সংবাদমাধ্যম। পেগাসাস কাণ্ডে নানা মুনির নানা মত আমরা শুনছি। তবে এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে বিপদজনক সেটা হল, এ ক্ষেত্রে ভারতের সার্বভৌমত্ব সংকটের মুখে পড়ে গেল শুধু নয়, তার অন্তর্জলি যাত্রা করে দেওয়া হল। সেটা নিয়ে সরকার পক্ষ গভীর ভাবে ভেবে দেখেছে বলে মনে হয় না। 

পেগাসাস যে তথ্য সংগ্রহ করছে সেটা যে তৃতীয় কোনও দেশের হাতে পৌঁছে যাবে না, তার কোনও গ্যারান্টি আছে কী? মোদি সরকার পেগাসাস ব্যবহার করে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে এনেছে। আজ যদি কোনও তৃতীয় দেশ ভারতকে পেগাসাস থেকে গৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে তখন কী হবে? যে প্রতিষ্ঠানের কাছে সমস্ত হ্যাক হওয়া মোবাইল নম্বর আছে, তাদের কাছে সেই হ্যাক করা তথ্যও যে আছে, এটা একটা শিশুও বুঝবে। 

এখন প্রশ্ন হল, এই যে প্রায় ৫০,০০০ ফোন পেগাসাস দিয়ে হ্যাক করা হয়েছে, এই খবরটা বেরল কোথা থেকে? এই খবর ভারত থেকে বেরয়নি বা পেগাসাস যে সব দেশে ফোন হ্যাক করেছে সেই সব দেশ থেকেও নয়। তাহলে এই যে অক্টোপাসের শুঁড়গুলো দেখা যাচ্ছে কিন্তু মাথাটা কোথায়? এখানে সন্দেহের তির ধাবিত হচ্ছে এনএসও গ্রুপের দিকে যারা পেগাসাস স্পাইওয়্যার প্রস্তুত ও বিক্রি করে। যদিও তারা বলছে যে তাদের ক্রেতারা এটাকে কীভাবে ও কী কাজে ব্যবহার করছে সেটা তারা জানে না। সেটাই যদি সত্যি হবে তবে তারা এটা কী করে বলছে যে কেউ যদি তাদের স্পাইওয়্যারের অপব্যবহার করে তবে তারা সেই ক্রেতার স্পাইওয়্যার ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিতে পারে!

এর আগে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে তুর্কির সৌদি দূতাবাসের ভিতরে নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসগী'র ফোন, তাঁর বউ, ছেলে এবং তাঁর বহু বন্ধু-বান্ধবের ফোন এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে হ্যাক করা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তুর্কির প্রধান প্রসিকিউটরের ফোনও হ্যাক হয়েছিল এই পেগাসাস দিয়েই। সেই সময় এনএসও গ্রুপের তরফে জানানো হয়েছিল যে তাদের স্পাইওয়্যার দিয়ে খাসগী'র কোনও ছবি তোলা হয়নি বা কথা রেকর্ড করা হয়নি। এটা তারা কি জানাতে পারত যদি তাদের কাছে খাসগী'র ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকত? এনএসও'র স্পাইওয়্যারের অপব্যবহার করলে তারা যে ক্রেতার যোগাযোগ কেটে দেয় সেটা শুধু সামনের দরজার। পেছনের দরজা দিয়ে চলতে থাকে কাজকর্ম। 

এই এনএসও গ্রুপের নিবিড় সম্পর্ক ইজরায়েল সরকারের সঙ্গে। ইজরায়েল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সবুজ সংকেত ছাড়া এই স্পাইওয়্যার কেনাবেচা করা সম্ভব নয়। এনএসও'র মোট কর্মচারীর সংখ্যা ৭০০ যাঁদের প্রায় সবাই ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রাক্তনী। এঁদের প্রধানত নেওয়া হয় সেনাবাহিনীর গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত থাকেন তাঁদের মধ্য থেকে। ইজরায়েল সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উন্নত অংশ এই গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থার অংশটি। বর্তমান সময়ে যিনি এনএসও গ্রুপের প্রধান তিনি এক সময় ছিলেন ইজরায়েলের 'স্টেট সেন্সর' পদে। সেনাবাহিনীর কোন খবর বাইরে বেরবে তিনিই ছিলেন তার প্রধান নিয়ন্ত্রক। এই যখন এনএসও'র পরিচিতি, সেই পরিস্থিতিতে ইজরায়েল সরকার যখন বলে যে তারা এনএসও দ্বারা গৃহীত তথ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না, তখন হাসি পায়। 

এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে পেগাসাস যে সব খবর পাচ্ছে তা ইজরায়েল সরকারও পাচ্ছে। এনএসও সম্প্রতি জানিয়েছে যে তাদের পেগাসাস দিয়ে কোনও আমেরিকান ফোন হ্যাক করা সম্ভব নয়। যাঁরা পেগাসাস তৈরি করেছেন তাঁরা কি তবে জেনেশুনে এটা করেছেন? এ ব্যাপারে তদন্তে নেমে 'ওয়াশিংটন পোস্ট' সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা জানতে পেরেছেন যে পেগাসাস দিয়ে বিদেশে কর্মরত বহু আমেরিকানের ফোন হ্যাক করা হয়েছে। 'ওয়াশিংটন পোস্ট' আরও জানাচ্ছে যে পেগাসাস দিয়ে সেই সব দেশেই ফোন হ্যাক করা হয়েছে যে সব দেশে আমেরিকা ও ইজরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ যুক্ত। এখন প্রশ্ন, এই সব দেশ থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে পেগাসাস এবং তাদের দোসর ইজরায়েল বা আমেরিকা কী করতে পারে? 

ভারতের কথাই যদি ধরি, তাহলে এই তথ্য ভারতের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের জায়গা দখলের লড়াইয়ে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন চিন এই তথ্য কিনে তা ভারতের বিপক্ষে ব্যবহার করতেই পারে। সেটা ইতিপূর্বেও প্রকাশ্যে এসেছে, আগামী দিনেও আসবে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী কেন চিনের আগ্রাসন নিয়ে ভাসুর ননদের মতো আচরণ করেন তা আরও স্পষ্ট হবে। ইজরায়েলের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গলায় গলায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, তা এখন স্পষ্ট। বিরোধী মুক্ত ভারত গড়ার খোয়াব দেখতে গিয়ে সরকার বাহাদুর সবার পেছনে পেগাসাস লাগিয়ে দিল, কিন্তু বুঝল না আসলে পেগাসাস লেগে গেল দেশের পেছনে। তাই সরকারের পেগাসাস নীতি আসলে ডালে বসে সেই ডাল কাটার সামিল। কয়েক শো কোটি টাকা দিয়ে এই মূর্খের সরকার পেগাসাস কিনেছে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে আনতে। এবার দেখতে থাকুন, ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে চিন কি খেলাটা শুরু করে। পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে পুষ্ট করছে চিন, বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে জিডিপি'র উন্নতি ঘটিয়েছে চিন, শ্রীলঙ্কায় সামরিক ঘাঁটি খুলে বসে আছে চিন, আর আমাদের অর্বাচীন কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধীদের কান মূলে দিতে গিয়ে যে এখন নিজেরাই কানমলা খেয়ে গেল সেটা কি এই গো ভক্তদের মাথায় ঢুকছে?


No comments:

Post a Comment