উগ্র রক্ষণশীল রাজনীতিকে রুখতে তাকাতে হবে নিজেদের দিকে
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
এক সজ্জন বন্ধু একটি প্রশ্ন করে আমাকে উসকে দিলেন।
‘আচ্ছা, এত রক্ষণশীল, বিভেদকামী, ধর্মান্ধ হয়েও বিজেপি কী করে এত সংখ্যক মানুষের সমর্থন এখনও আদায় করে চলেছে?’
প্রশ্নটি যথাযথ। এবং স্বভাবতই অনেকে একে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। নতুবা, ‘মানুষ মোহগ্রস্ত’, ‘ভুল বুঝছে’, ‘ইভিএমের কেরামতি’ এইসব নানাবিধ দায়সারা উত্তর দিয়ে থাকেন। এতে সাপও মরে না লাঠিও ভাঙে না। বরং, এই প্রশ্নটিকে যথাযথ ভাবে মোকাবিলা করে নিলেই উগ্র মতান্ধতার বিপক্ষে একটি যথার্থ পরিসর গড়ে উঠতে পারে।
উগ্র রক্ষণশীলতার বীজ সমাজের প্রকোষ্ঠেই নানা ভাবে রোপিত হয়ে আছে। তা যেমন জনমানসে আছে, বিভিন্ন দল ও রাজনৈতিক অনুশীলনেও আছে। এ কথা সুবিদিত যে, সারা বিশ্ব জুড়েই গত দশ বছরে উগ্র রক্ষণশীল মতান্ধতা ক্রমেই সবলতর হয়েছে ও বহু রাষ্ট্রক্ষমতায় আসন পেয়েছে। এর মূল উৎস নিহিত আছে তার আগের পর্বে। যে পর্ব বিশ্বায়ন, উদারবাদী অর্থনীতি, তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মৌলবাদ, কর্পোরেট উগ্রবাদ ইত্যাকার বিবিধ অনুষঙ্গে ভরপুর হয়েছিল। আর তা থেকেই সাধারণজনের যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দারিদ্র্য, উষ্মা- তা নতুন ধরনের এক ন্যারেটিভ রচনায় বিরুদ্ধ শক্তিকে প্ররোচিত করে। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম হয়নি। স্বভাবতই, সংগঠিত রক্ষণশীল মতাদর্শের বয়ানে মতান্ধ শক্তির উত্থান এক শক্ত জমি পেয়ে গেল।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এর ভিত্তি ও লক্ষণগুলো ছিল কতকটা এমনতর:
এক) বৃটিশ-সৃষ্ট হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বকে হাতিয়ার করে আরএসএস-বিজেপি শক্তি মুসলমানদের একটি কাল্পনিক বিপদ হিসেবে বরাবর বাকী ভারতবাসীর সামনে দাঁড় করিয়ে এসেছে। বৃটিশ আগমনের আগে ভারতীয় শাসকদের ধর্মীয় পরিচয়কে ন্যাক্কারজনক ভাবে উচ্চকিত করে (অথচ বৃটিশ শাসকদের ধর্মীয় পরিচয়কে কিন্তু একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না) একটি ধর্মীয় সমাজকে, তাদের তরফে, শত্রু হিসেবে জনতার সামনে পেশ করা হয়। সে বাদে, অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশভাগের ধর্মীয় ইন্ধন, গত সত্তর বছরে নানা স্থানে দাঙ্গা, প্যান-ইস্লামিয় মৌলবাদের বাস্তবতা, আগের জমানার শাসকদের ক্ষমতার লোভে মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ (যেমন রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া ও শাহবানু মামলায় হেরে গিয়ে সংসদে নারীর অধিকারকে খর্ব করে আইন প্রণয়ন), সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থানকে নাকচ করে বিভিন্ন ধর্মের পেছনে তা’ দেওয়া ইত্যাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুশীলনে হিন্দু-মুসলমান নাগরিকদের মধ্যে বিভাজনের এক সহিংস বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল; যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকে সময় বিশেষে রাজনৈতিক ফায়দা তুলে ক্ষমতা দখলে মদত দিয়েছে। এই আবহে, হিন্দু সমাজের এক বড় অংশের মধ্যে (বিশেষত উচ্চবর্ণ) যে বিভ্রান্তি ও প্রতিহিংসামূলক ধর্মীয় চেতনা সুপ্ত ছিল, তাকে চাগাড় দিয়ে ও বিপন্নতার দোহাই তুলে আজকের রক্ষণশীলেরা (আরএসএস-বিজেপি) এক রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড নিজেদের ঘরে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে। তারা আপাত ভাবে বোঝাতে পেরেছে যে, বৃহত্তর হিন্দু সমাজ বিপন্ন, তাই তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি আর বিজেপি সেই ঐক্যের পাটাতন।
দুই) কংগ্রেস প্রণীত মিশ্র অর্থনীতি- যার সুবাদে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের সুবিশাল পরিসর- দেশের স্বল্পসংখ্যক মানুষকেই রুটিরুজি ও আশ্রয়ের সংস্থান দিতে পেরেছে। বহু জনমুখি প্রকল্প ঘোষিত হলেও তা আপামর দেশবাসীর কাছে মোটেই যথাযথ ভাবে পৌঁছতে পারেনি। এই ব্যর্থতার কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী স্বীকার করেছিলেন এ কথা বলে যে এক টাকার সরকারি সংস্থানের মাত্র ১৬ পয়সা নিচুতলায় মানুষের কাছে পৌঁছয়। এই যে বিশাল অপচয় ও ‘সমাজতন্ত্রের’ কথা বলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ও সরকারি দফতরে সাধারণ মানুষের নিত্য হেনস্থা, তা সরকারি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেই জনমানসে এক নেতিবাচক ধারণা নির্মাণ করেছিল। সেই ইস্যুটিকে রক্ষণশীলেরা কাজে লাগিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বিলোপসাধনের প্রস্তাব এনে ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার ডিজিটালকরণকে হাতিয়ার করে যে ব্যবস্থাগুচ্ছ তারা নিয়েছে তার প্রতি মানুষের একটা প্রাথমিক বিশ্বাস অবশ্যই তৈরি হয়েছে। যে কারণে বিমুদ্রাকরণের মতো অত ভয়ঙ্কর একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার ফলে মানুষের প্রভূত যাতনা ও মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও কোথাও তেমন কোনও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়নি, বরং দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা গ্রহণকে মানুষ আপেক্ষিক ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই গ্রহণ করেছে। যে কারণে এই ব্যবস্থাপনার পর পরই উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র বিপুল জয় সম্ভব হয়েছিল।
তিন) সবচেয়ে কার্যকরীভাবে রাজনীতির দাবিদাওয়ার মোড়টিকে আরএসএস-বিজেপি ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। জীবন-জীবিকার প্রশ্নটিকে হিমঘরে পাঠিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, ‘লাভ জেহাদ’, রামমন্দির, কাশ্মীরে ৩৭০ বিলোপ, সমস্ত সমস্যার মূলে পাকিস্তান, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সিএএ-এনআরসি ইত্যাদি এমন সমস্ত মুদ্দাকে তারা জনমানসে এনে ফেলে যে সাময়িক ভাবে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভাবতে শুরু করে যে এই সমস্ত সমস্যার সমাধানেই সম্ভবত তাদের বেঁচেবর্তে থাকার দিনলিপি লুকিয়ে আছে। নানারকমের গালগল্প, ফেক ভিডিও ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট ছড়িয়ে, নিজেদের নেটওয়ার্কে সেগুলিকে ভাইরাল করে তারা রাজনীতির এক নতুন বয়ান তৈরি করে বেশ সবলভাবে এক মিথ্যার জাল নির্মাণে সক্ষম হয়। তাদের বলা কথাগুলির মধ্যে কিছু সত্যের উপাদান হয়তো ছিল, যার সঙ্গে হিন্দু মানসিকতার মানুষ খানিক একাত্ম বোধ করে এবং তাদের উত্থাপিত কথাবার্তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পারে সহায়ক হয়। কিন্তু ক্রমেই ভেঙে পড়া অর্থনীতির কারণে এই মোহ অচিরেই কাটতে শুরু করে এবং গত বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এই ধোঁকাবাজির খেলা তাদের হাত থেকে কতকটা ফসকে যায়। এই প্রথম বিরোধীদের তোলা জীবন-জীবিকার মুদ্দা স্পষ্ট করে নির্বাচনী লড়াইয়ের এজেন্ডা হয়ে ওঠে এবং কোনওরকমে এনডিএ জিতে গেলেও বিরোধীরা জবরদস্ত লড়াইয়ের স্বাক্ষর রাখে। আর আজ দিল্লিকে ঘিরে কৃষকদের মহাজাগরণ এই গোটা পর্বটিতেই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই প্রথম দেখা গেল, উগ্র হিন্দুবাদী শিবির থতমত খেয়ে গেছে এবং ভারতীয় জনমানসে সাধারণজনের আসলি মুদ্দাগুলি আবার প্রধান জায়গায় ফেরত আসতে শুরু করেছে। একেবারে হালের হরিয়ানা পুরসভা ও আঞ্চলিক নির্বাচনে বিজেপি জোটের ভরাডুবি সেইদিকেই আবারও জোরালো ইঙ্গিত করল।
চার) এছাড়াও উল্লেখনীয়, ধর্ম-জাতপাত-জাতি-লিঙ্গ নিয়ে গত সত্তর বছরে তথাকথিত উদারবাদীরা (কংগ্রেস ও তার সহযোগী দল) যে সস্তা ও সুবিধাবাদী রাজনীতি করেছে তার দামও তাদের মেটাতে হয়েছে। সেই জনমোহিনী ও চটকদারি রাজনীতিরও পালটা হিসেবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা জনতার সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়। যেমন, মণ্ডল কমিশনের দৌলতে বিহার-উত্তরপ্রদেশ সহ অনেক রাজ্যে যে বিদ্বেষমূলক জাতপাতের রাজনীতির সূচনা হয় তার বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীরা এক ‘ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজের’ রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসে। তা তাদের কাজেও দেয়। এ কথা তো অস্বীকার করার নয়, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে যাদবতন্ত্রের অত্যাচারে বহু মানুষ নিষ্পেষিত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের মতোই যাদববাদ এমন এক নতুন ধরনের জাতপাতের রাজনীতির অনুশীলন আমদানি করে যে বাকী জাতের লোকেরা বিপন্নতা ও আক্রমণের শিকার হয়। এটা বাস্তব। একে অস্বীকার করে লাভ নেই। অনুরূপ ভাবে, ধর্মের নামে মুসলমানদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করা, ধর্মীয় গুরুদের নানা ভাবে হাতে নিয়ে মুসলমানদের ঘেটো ব্যবস্থায় নিক্ষিপ্ত করে শুধুমাত্র ভোটের জন্যই তাদের ব্যবহার করে নেওয়া- এই অনুশীলনও তো দীর্ঘদিন চলেছে। এ নিয়ে মুসলমান সমাজের মধ্যেও নানারকম ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল। বলাই বাহুল্য, এই নোংরা রাজনীতির কুফলের ফায়দা আরএসএস-বিজেপি সুচতুরভাবে ব্যবহার করতে সফল হয়েছে। পাশাপাশি, লিঙ্গ রাজনীতির বাড়াবাড়িও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষকে আহত করেছে। কারণ, এই বাড়াবাড়ির শিকার শুধুমাত্র পুরুষেরা হয়নি, নারীরাও হয়েছে। ভুরি ভুরি মিথ্যা অভিযোগের ঠেলায় শীর্ষ আদালতকেও ৪৯৮এ নিয়ে সংশোধনী আনতে হয়েছে। এ নিয়ে দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজের একটি অসাধারণ তথ্যচিত্রও আছে: ইন্ডিয়াজ সনস। অর্থাৎ, এক কথায়, ধর্ম-জাতপাত-লিঙ্গ সমতার নাম করে তথাকথিত উদারবাদী, গণতন্ত্রীরা যথেচ্ছ বিভদমূলক খেলা খেলেছে, নতুন ধরনের এক অসম ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে তুলেছে ও জনতাকে ধোঁকা দিয়েছে। আর এর সুযোগ তো উগ্র রক্ষণশীলেরা নেবেই। যেভাবে এক সময় শ্রমিকশ্রেণির নাম করে সোভিয়েত ইউনিয়নে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল এক দমবন্ধ করা আমলাতান্ত্রিক মৌলব্যবস্থা, যার পতনও তাই অনিবার্য ছিল।
তাই, আজ অনেক বেশি তাকাতে হবে নিজ রাজনীতি ও তার অনুশীলনের দিকে। যে ধর্মীয় উগ্রবাদের রাজনীতি আজ প্রায় গোটা দেশকে অনেকটাই কব্জা করেছে, তার বিরুদ্ধে তো প্রকৃত গণতান্ত্রিক, সমতা-ভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচির বাস্তবতাই আঁধার পেরতে সাহায্য করবে। সেটা না বুঝলে, হাজারও নীতিকথা আউড়ে, মরণকালে হরিনাম করে মৌলবাদের জনভিত্তিকে টলানো যাবে না। কারণ, বুঝতে হবে, ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে সংহত করে রাজনীতির অনুশীলন করছে, যে কাজটা আপেক্ষিক ভাবে অনেক সহজ। কেননা, ধর্মীয় আবেগ দ্রুত বহমান ও প্ররোচনামূলক। কিন্তু, গণতান্ত্রিক শক্তিকে জীবন-জীবিকা, ধর্ম-জাতপাত-লিঙ্গ সমতা ও বহুত্ববাদের কর্মসূচি নিয়েই জয় করতে হবে এ লড়াই। নয়তো, আমরা হারিয়ে যাব এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার জগতে। তাই কাজটা কঠিন কিন্তু বাস্তবতা সে জমি প্রস্তুত করেছে। সারা ভারতের ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন পথ দেখাচ্ছে।
সুন্দর লিখেছেন।
ReplyDeleteসমতাবাদি রাজনীতি জাতিয়স্তরে একদা সফল হয়েছিল।এবার সেটাকে বিশ্ব পটভূমিতে আনতে হবে। বিজেপি যাদের দালালি করছে তারা সব বহুজাতিক কর্পোরেট হাউস।
ReplyDelete