প্রতিবাদ মুখর ২০২০
সোমনাথ গুহ
বছরটা শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক শাহিন বাগ জমায়েত দিয়ে, শেষ হচ্ছে রাজধানী দিল্লির সীমান্তে উত্তাল কৃষক সমাবেশে। ইতিমধ্যে মহামারি নামক একটি বিস্মৃতপ্রায় শব্দ যা শুধু ইতিহাসের বইয়েই পাওয়া যায় বলে মানুষ নিশ্চিন্ত ছিল, তা এক শতাব্দী বাদে অমিত বিক্রমে ফিরে এসে বিশ্ব জুড়ে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে দিল। আট কোটির ওপর মানুষ সংক্রামিত, মৃত প্রায় ১৮ লক্ষ; আমাদের দেশে যা যথাক্রমে এক কোটি ও দেড় লক্ষ। সহস্র লক্ষ মানুষের জীবিকা চলে গেল, অধিকাংশ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হল। মারির প্রকোপের সুযোগ নিয়ে বাড়ল স্বৈরাচারের দাপট। আবার সংকটের সময়ে একই সাথে গড়ে উঠল সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতার আবহ, শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জোয়ার।
সংক্রমণের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করে যে আন্দোলন গড়ে তোলা যায় তা প্রথম দেখা গেল আমেরিকায়। মহামতি ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনা, অবিজ্ঞানমনস্কতার কারণে মারি তখন সেখানে লাগামছাড়া রূপ নিয়েছে। তাঁর এই চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার খেসারত দিতে হল প্রান্তিক কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসী মানুষদের। পুলিশি নৃশংসতায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু তাঁদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে ঘৃতাহুতি দিল এবং সারা আমেরিকা জুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন উল্কার বেগে ছড়িয়ে পড়ল। এই আন্দোলন ট্রাম্পের টলোমলো শাসনে অন্তিম পেরেকটা পুঁতে দিল যার প্রতিফলন ঘটল নভেম্বরের নির্বাচনে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় হল বটে কিন্তু দক্ষিণপন্থার অবসান ঘটল এমনটা বলা যাবে না, বরং পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে জনসমর্থন বুঝিয়ে দিল যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই হবে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী। রিপাব্লিকানদের হাত থেকে ক্ষমতার ব্যাটন ডেমোক্র্যাটদের হাতে হস্তান্তরের ফলে মার্কিনি নীতিতে বিরাট কোনও পরিবর্তন আসবে তাও নয়, কিন্তু এটা প্রমাণিত হল যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’এর মতো দুর্নিবার আন্দোলন ধাপে ধাপে জমানা বদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
করোনার আগমনের আগেই আমাদের দেশে সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দিল্লি পুলিশ নৃশংস আক্রমণ করে, লাইব্রেরি ভাঙচুর করে, পাঠরত পড়ুয়ারাও রেহাই পায় না। সেই রাত থেকেই ছাত্রছাত্রীদের উদ্বিগ্ন স্বজন, পড়শিরা অনতিদূরে একটা রাস্তায় ভিড় করে- যে জমায়েত পরের দিন থেকে ১০০ দিনব্যাপী শাহিন বাগ ধর্ণায় রূপান্তরিত হয়। এর কয়েকদিন বাদেই আক্রমণ নেমে আসে জেএনইউ'তে ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মুখোশধারী গুণ্ডারা বেছে বেছে বামপন্থী ইউনিয়নের সদস্য/সদস্যাদের ওপর হামলা করে। পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। শাসক ভেবেছিল দমনপীড়নের ভয়ে প্রতিবাদ স্তিমিত হয়ে যাবে। উল্টে শাহিন বাগের জমায়েত একটা সর্বজনীন রূপ পেয়ে যায়। নাগরিক সমাজ ও ছাত্রযুবদের একটা অংশ মুসলিম মহিলাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদে শামিল হলেন। শুধু দিল্লিতেই একই ধরনের আরও অনেক ধর্ণামঞ্চ গড়ে উঠল। কলকাতা, জয়পুর, নাগপুর, পুনে, এলাহাবাদ সহ আরও বহু শহরে নানা শাহিন বাগ পল্লবিত হল।
যে কোনও গণআন্দোলনের মোকাবিলায় বিজেপির ধরাবাঁধা প্রতিক্রিয়া হল কুৎসা, অপপ্রচার এবং তাতে কাজ না হলে হুমকি, সিবিআই, ইডি লেলিয়ে দেওয়া, এনআইএ’র ভয় দেখানো। বৈষম্যমূলক সিএএ’র বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে এই প্রতিবাদকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্দোলন বলে তকমা সেঁটে দেন যখন তিনি তাঁদের বিশেষ পোশাকের কথা উল্লেখ করেন। এরপর লাগামছাড়া কুৎসা-- পাকিস্তানি, টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং, সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী-- শুরু হয়ে গেল। প্রচার হল আন্দোলনকারীরা ধর্ণামঞ্চে হাজিরার জন্য ৫০০ টাকা পাচ্ছেন। ইসলাম ধর্মগুরু জাকির হোসেন নাকি বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করছেন। এমনকি দিল্লিতে ধর্ণামঞ্চের সামনে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটে গেল। উত্তরপ্রদেশে দমনপীড়ন ভয়াবহ আকার ধারণ করল। অন্তত কুড়ি জন পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করার অজুহাতে বহু আন্দোলনকারীকে জরিমানা করা হল। আদালতের আদেশ অমান্য করে তাঁদের ছবি শহরের রাস্তায় টাঙিয়ে দেওয়া হল, যেন তাঁরা দাগী আসামী। দিল্লি নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি শাহিন বাগকে ব্যবহার করে মেরুকরণের চেষ্টায় লাগামছাড়া মুসলিম বিরোধী প্রচার করল। বিজেপি নেতা মন্ত্রীদের সেই সব কুখ্যাত উক্তি ইতিমধ্যেই লোকগাথায় পরিণত হয়েছে। তবুও নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হল যা তাঁদের আরও ক্ষিপ্ত করে তুলল। একটি ধর্ণামঞ্চের সামনে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তাঁরা পূর্ব দিল্লিতে হিংসা ছড়িয়ে দিল। মুসলিম জীবন-জীবিকা আক্রান্ত হল, ৫৩ জন মারা গেলেন যাঁর মধ্যে ৪০ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তবুও শাহিন বাগের সমাবেশ অটুট রইল। প্রতিবাদকারীরা সদর্পে ঘোষণা করলেন, আমরা শাহিন বাগকে পূর্ব দিল্লি হতে দেব না। সরকারের প্রতিহিংসা, দমনপীড়ন সব কিছু উপেক্ষা করে ১০০ দিনের ওপর টিকে থাকার পর মহামারির আগমনের কারণে সংগঠকরা নিজেরাই সমাবেশ তুলে নিলেন।
কিন্তু নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ এমনটা বলা যাবে না। সিএএ কিন্তু এখনও চালু হয়নি। আইন পাস হওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত, সরকার এখনও এর বিধি প্রণয়নই করে উঠতে পারেনি। সরকার ফ্যাসাদে, নিজেদের কলে নিজেরাই আটকা পড়ে গেছে। তারা এখন পালিয়ে কূল পাচ্ছে না। একই সময়ে বাংলা, অসম দুটি রাজ্যে নির্বাচন; সিএএ লাগু করলে অসমে তার মারাত্মক ফল হবে, না লাগু করলে বাংলায় বিশেষত মতুয়া সম্প্রদায় বিরূপ হবে। এখন তারা পিছু হটছে। বলছে, টীকাকরণ হলে, করোনার আতঙ্ক দূর হলে তবেই এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে। ১৩০ কোটি মানুষের টীকাকরণ কবে হবে, করোনা কবে স্তিমিত হবে তা স্বয়ং ঈশ্বর স্বর্গ থেকে নেমে এলেও বলতে পারবেন না। অমিত শাহ বুঝে গেছেন বিধি বাম! মতুয়াদের ঘাঁটি বনগাঁয় নির্ধারিত সভা বাতিল করে দিয়েছেন এবং অসমে নির্বাচনী প্রচারের সূচনা করতে গিয়ে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি। অসমে এই আইনের বিরোধিতা এতটাই যে একে কেন্দ্র করে দুটি আঞ্চলিক দল তৈরি হয়ে গেছে। বাংলায়ও মতুয়াদের মধ্যে বিজেপির জনসমর্থনে ফাটল ধরেছে, এই দলের ধাপ্পাবাজি তাঁরা ধরে ফেলেছেন।
একই ভাবে কৃষি আইন নিয়েও সরকার ল্যাজেগোবরে। এখানেও বিজেপির আইটি সেল কুৎসার বন্যা বইয়ে দিয়েছে-- খালিস্তানি, পাকিস্তানি, নকশাল, মাওবাদী, এঁদের আন্দোলন নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এঁরা ধনী, এঁদের সর্বাঙ্গে আভিজাত্য উপচে পড়ছে। এঁরা জিনস পড়ে, মেসিন দিয়ে পা মালিশ করে, পিজ্জা খায়, স্করপিও নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ইত্যাদি। সংঘীরা কৃষকদের একশো বছর আগে নিরন্ন, ছন্নছাড়া, হতদরিদ্র, ল্যাঙ্গট পরিহিত কাঁধে লাঙল নেওয়া শীর্ণকায় চেহারার মানুষ হিসাবেই দেখতে চায়। আরে! চাষাভূষো লোকগুলোর এত পয়সা, এত দাপট! সরকারি অনুদান, সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এঁরা ফুলেফেঁপে উঠেছে, এঁদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বলীয়ান দেমাকি সরকারের ধারণা নেই যে ভারতবর্ষের কৃষক যুগ যুগ ধরে বহু কঠিন লড়াই ও অভিজ্ঞতার কারণে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, মনোবল ও আত্মত্যাগের ক্ষমতা অর্জন করেছেন। তাঁদের হেলাফেলা করা অত সহজ নয়। গুরুদ্বোয়ারে দেখনদারি দর্শন দিয়ে, কিছু তাঁবেদার কৃষকের সামনে ভাষণ মেরে, ২০০০ টাকা ছড়িয়ে দিয়ে তাঁদেরকে তোষামোদ করা যায় না। কৃষকরা কাঙাল নয়। ইতিমধ্যেই ৩৩ জন কৃষক শহীদ হয়েছেন, এক সন্ত আত্মবলিদান দিয়েছেন, বয়স এবং প্রবল শৈত্যপ্রবাহের কারণে অনেকে সংকটে তবুও তাঁরা সিংঘু, টিকরি, গাজিয়াবাদ ইত্যাদি সীমান্ত থেকে নড়বেন না।
আর শুধু কৃষকরা কেন, গত মাসেই তো দেশ জুড়ে শিল্প ধর্মঘট হয়ে গেছে। বিহারের নির্বাচনে বামপন্থীরা- বিশেষ করে সিপিআইএমএল (লিবারেশন) দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছে- মাত্র ২৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৬টি সিট জিতে নিয়েছেন। দেশ জাগছে। শাহিন বাগ পথ দেখিয়েছিল, বর্ষ শেষে কৃষক সংগ্রাম সেই রুপোলী ঝিলিককে আরও উজ্জ্বল করেছে।
বেশ উৎসাহব্যঞ্জক লেখা। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteআরও এমনি লেখা আসুক। খুবই প্রয়োজনীয় আজকের অবস্থায় //
ReplyDeleteবাহ্ , খুব ভাল লেখা!
ReplyDeleteএকটু অন্য রকমের ফিরে দেখা! আশার বছর, বেশ লাগলো!
ReplyDelete